সৌমেন সুর: 'মুক্তধারা' নাটকে এক জায়গায় ধনঞ্জয় বৈরাগী প্রজাদের বলেছেন, 'তোরা আমাকে ছেড়ে চলে যা। 'প্রজারা দ্বিধান্বিত, 'আচ্ছা ঠাকুর চললুম, কিন্তু– ধনঞ্জয় চটজলদি বলে উঠলেন, 'একেবারে নিষ্কিন্তু হয়ে চলে যা। 'এখানে' কিন্তু'র সংশয়টা তৎক্ষণাৎ চলে গেল।
এই সমস্ত শব্দ অভিধানে স্থান পাক, চেয়েছিলেন অধ্যাপক শশীভূষণ দাশগুপ্ত। কিন্তু প্রকাশকরা ঝুঁকি নিতে চান নি। তাহলে অভিযান এগোবে কি করে! ভাষা এগোবে কি করে? অভিধান ভাষা শিক্ষার উপকরণ। এই কাজে মেধা, শিক্ষা, সাধনা এরাই হলো উপাদান। শুধু শব্দ সংকলন করলেই হবে না, বা অর্থ পুস্তকেই শুধু নয়- ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, লেখক, ঘরোয়া সুষ্ঠু ব্যবহার হয় না বলে দুঃখ করেছেন– তথাপি এখনো অনেকে আচার্য, ভট্টাচার্য, আশ্চর্য, না লিখে 'আচার্য্য, ভট্টাচার্য্য, আশ্চর্য্য লেখেন। চিরকাল 'হঠাৎ' লিখেছি এখন ওটা 'হঠাৎ করে' হয়ে গেল কিভাবে কে জানে? বেশিদিন চললে এরা অভিধানে ঢুকে যাবে।
রবীন্দ্রনাথ 'শব্দতত্ত্ব' গ্রন্থে ধ্বন্যাত্মক শব্দ নিয়ে গবেষণার পরিচয় দিয়েছেন। দ্রুততা বোঝাতে তিনি 'সাঁ করিয়া', 'ধা করিয়া', 'ভোঁ করিয়া'– শব্দের ধ্বনিই অর্থটাকে সঠিক বুঝিয়ে দেয়। 'তীর বেগে গেল', অর্থাৎ তীর যেভাবে দ্রুত যায়। 'গটগট করিয়া গেল'– এখানে গমনের পার্থক্যটা বোঝানো হলো। যেসব শব্দ নির্মাণ এবং অর্থসূচক ধনাত্মক শব্দ উদারণ হিসেবে পাওয়া গেল– তাতে রবীন্দ্রনাথকে কি আমরা 'বাচস্পতি' বলতে পারি না? সুনীতি চট্টোপাধ্যায় কবিকে 'বাকপতি' বলে স্বীকার করেই নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ধ্বন্যাত্মক শব্দের আলোচনা দেখে উদ্দীপ্ত হয়ে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীও ঐ ধরনের শব্দ নিয়ে একটি বিশাল গবেষণা চালিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'শব্দতত্ত্ব' গ্রন্থে 'ভাষার ইঙ্গিত' নামের একটি সুন্দর আলোচনায় দেখিয়েছেন যে কেবলমাত্র ভাষার দ্বারাই আমরা সব ভাব প্রকাশ করতে পারি না। অনেক শব্দ আছে, তারা বাস্তধ্বনি নয়, বরং কল্পনা মাত্র। যেমন দবদব করছে, টনটন করছে, কনকন করছে, রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে, ঘর গমগম করছে, ভয়ে ছমছম করছে– এই সব টুকরো টুকরো উদাহরণে ইঙ্গিতবহ ভাষাকে রবীন্দ্রনাথ চিনিয়ে দিয়েছেন। বাকপ্রতি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন– 'বঙ্গভাষা রাজভাষা নয়, উপার্জনের ভাষা নয়, ইহা শুধু মাতৃভাষা।' মাতৃভাষা ছাড়াও জীবন চলে। থাকা-খাওয়া, ভ্রমণ, ঐশ্বর্য দিয়ে ঘর সাজানো– সব হয়, কিন্তু কথা বলা, কথা শোনা, লেখালেখি, ভালবাসা এসব চলে না। চিন্তা ধ্বংস হয়। মন মরে যায়।
"সমাপ্ত"
তথ্য ঋণ/ পিনাকী ভাদুড়ী