সৌমেন সুর: গানের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট আনন্দ, অন্তরের অন্দরমহলে 'ফানা'কে প্রতিষ্ঠিত করে। সাঁই-দরবেশরা ঈশ্বরের অচিন্ত্যনীয় সত্তার মধ্যে মিশে যায়, পরিভাষায় তা হলো ফানা। আসলে সঙ্গীতময় মিলন সত্যই হলো সুফীতত্ত্বের 'সামা'। বাউল কবিদের ভাষায়- 'আমি কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে/ হারায়ে সেই মানুষে- তার উদিশে/ দেশবিদেশে বেড়াই ঘুরে।' কিন্তু লালনের বড় দুখ। কারণ লালনের কথায়- 'আপনারে আপনি চিনি নে'/ দীন দনের পর যার নাম অধর/ তারে চিনবো কেমনে।
এই 'আপনারে আপনি চেনা' ফ্রয়েডিয় মনোবিজ্ঞানের আত্মরতি নয়, তার কারণ এই আপন কিন্তু সেই চিদানন্দস্বরূপ অংশকলা। মায়ার ঘোরে চোখ বোজা থাকলে সাঁইয়ের রুপ চেনা যায় না। অথচ সাঁই এবং লালন এক জায়গাতেই থাকেন, তবু তাদের মধ্যে লক্ষযোজন দূরত্ব।
'মনের মধ্যে মনের মানুষ করো অন্বেষন'-এটাই বাউল দর্শনের মর্মবানী। এই অন্বেষনেরই কথা আমরা রবীন্দ্রনাথের গানেও পাই। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথও বাউল, রবি বাউল। রবি বাউল মনের মানুষকে চিহ্নিত করেছেন প্রাণের মানুষ রুপে।
বাউলদের মানুষতত্ত্ব ঠিক মানবতত্ত্ব নয়। মানুষ বলতে বাউলরা যা বোঝেন তা মানব নয়। মানুষ অচিন পাখির মতো খাঁচার ভেতর আসা যাওয়া করে। আরশী নগরে পড়শীর মতো বসত করে। বাউলরা মানুষকে যে স্থান দেয় তা অন্যরা দেয় ভগবানকে। লালন যেখানে শ্রেষ্ঠ, সেখানে তিনি মিষ্টিক। তাঁর কথাগুলো সহজ, কিন্তু তিনি যা বলতে চান তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
লালনের মনের মানুষ, গগন হরকরার মনের মানুষ, রবীন্দ্রনাথের প্রাণের মানুষ, হাসন রাজার অন্তরিয়া, প্রকৃতপক্ষে একই। লালনের মনের মানুষের এই যে অন্বেষন, কোথায় যেন আমাদের জীবনের অনুসন্ধান হয়ে দাঁড়ায়।