সৌমেন সুর: রাতে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ট্রেনটা নিঝুমপুর স্টেশনে থামে। প্লাটফর্ম ফাঁকা। কোনো মানুষজন নেই। ট্রেন থেকে নন্দিনী নামে। হাত ঘড়ির দিকে তাকায় নন্দিনী। রাত প্রায় দেড়টা। চারিদিক শুনশান। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। নন্দিনীর একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। একা মেয়ে মানুষ। এই নির্জন স্টেশনে কোন মানুষের দেখা নেই। কিভাবে গন্তব্যস্থানে পৌঁছাবে! মোবাইলটা বার করে। তারপরেই চমকে ওঠে। নেট নেই। একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে মোবাইলটা রেখে দেয়। নন্দিনী নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। নিঝুমপুরে আরো তিন ঘন্টা আগে আসতে পারতো যদি না প্যানটোগ্রাফ ভেঙে পড়তো। ওটা সারাতেই তিন ঘন্টা চলে গেল। তারপর যে ট্রেনটা ছেড়েছে এটা ঠাকুরের অসীম কৃপা। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নন্দিনী আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে। একটা রিক্সা বা ভ্যান কিছুই চোখে পড়ছে না।
এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল নন্দিনী। সুকুমারদা বলেছিলেন, সব ঠিকঠাক পেয়ে যাবে। কোথায় ঠিকঠাক! তবে সুকুমার দা'র দোষ কোথায়। বাদ সাধলো তো প্যানটোগ্রাফ ভেঙ্গে। এইসব ভাবতে ভাবতে নন্দিনী লাইন পেরিয়ে রাস্তায় নামে। পিছন থেকে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে একটা গলা ভেসে ওঠে, 'দিদিভাই, কোথায় যাবেন?' চকিতে এদিক ওদিক তাকায় নন্দিনী। একটা ভ্যান ভেঁপু বাজিয়ে কাছে আসে। নন্দিনী ভ্যানচালকের পা থেকে মাথা অব্দি দেখে। পরক্ষণে ভ্যানচালক বলে, 'কোথায় যাবেন?' নন্দিনী কোনরকম ভণিতা না করে বলে, 'ঘোষপুর যাব।' 'ঘোষপুর কার বাড়িতে যাবেন?' 'সুকুমার ব্যানার্জীর বাড়ি।' 'ও, সুকুমার কাকুর বাড়ি যাবেন-বসুন বসুন। আপনাকে ওনার বাড়ি দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছি। বসুন' নন্দিনী আর কোনো কথা না বলে ভ্যানে উঠে পড়ে।
ভ্যান চলতে থাকে। চলতে চলতে কথাবার্তা বিনিময় হতে থাকে। অন্ধকার রাস্তা। চোখে কিছু ঠাওর করতে পারেনা নন্দিনী। অথচ কি দ্রুত ভ্যান চালাচ্ছে যুবক ছেলেটি। নন্দিনী একসময় বলে ওঠে, 'তুমি এত তাড়াতাড়ি ভ্যান চালিও না। অন্ধকার রাস্তা। পড়ে যাব।' ভ্যান চালকটি হাসিমুখে জবাব দেয়, 'কিছু চিন্তা করবেন না দিদি, এ রাস্তা আমার খুব চেনা। ' এমন সময় দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে ওঠে। নন্দিনী চমকে ওঠে। ভ্যান চলতে থাকে আপন মনে। নন্দিনী জিজ্ঞাসা করে, 'তোমার নাম কি ভাই?' 'আজ্ঞে কিশোর দাস।' 'আচ্ছা কিশোর, তুমি এত রাতে ভ্যান চালাও কেন? বাড়িতে রেস্ট নিতে পারো না?' হাসিমুখে কিশোর বলে, 'দিদি রাতে ভ্যান চালালে লাভ আছে। প্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে ডবল ভাড়া পাওয়া যায়।' 'তাই বুঝি, যাক আর কতদূর কিশোর!' 'দিদি, ঠিক ১০ মিনিটের মধ্যে কাকুর বাড়ি চলে আসবো।'
হঠাৎ ভ্যানের গতি বেড়ে যায় নন্দিনী শক্ত করে ভ্যানটা ধরে অবাক হয়ে তাকায় কিশোরের দিকে। ( চলবে)