
সৌমেন সুরঃ বিদ্য়াসাগরের মানবতাবাদ পাশ্চাত্য়ের মানবতাবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। তার মধ্য়ে ভারতের সনাতন ও শ্বাশত আদর্শের সঙ্গে আধুনিকতার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। যাই হোক রবীন্দ্রনাথ বিদ্য়াসাগরের মূল্য়ায়ন করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, 'তাহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।' বাংলা ভাষাকে আধুনিক রুপ দিয়েছেন বিদ্য়াসাগর। বাংলা ভাষায় এক নতুন শব্দ বিন্য়াস রীতির প্রচলন তাঁর অনন্য় কীর্তি।
বিদ্য়াসাগরের দয়াদাক্ষিণ্যে ও সমাজ সংস্কারের ছায়ায় অসংখ্য় মানুষ উপকৃত হয়েছিলেন। তবু তিনি পেয়েছিলেন কঠোর সমালোচনা ও নীতিহীন আক্রমণ। যে আক্রমণে তাঁর বীরসিংহ গ্রামও বাদ যায়নি। যে মানুষের জন্য় তিনি দিবারাত্র চিন্তায় মনোনিবেশ করতেন, কীভাবে মানুষকে একটু বাঁচানো যায়, জীবনপথে আলো দেখানো যায়। একদিন গ্রামে পালকি চড়ে যাওয়ার সময় তাঁকে অশ্রাব্য় গালাগাল করে এবং ইটবৃষ্টি বর্ষন করে। সেইসময় জমিদারের ছেলে তার লাঠিয়ালদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত না হলে বিদ্য়াসাগরের প্রাণ সংশয় পর্যন্ত ঘটতে পারতো। এরপর তিনি ঘৃণায় আর বীরসিংহ গ্রামে পা বাড়াননি। যখন বিদ্য়াসাগর দেহ রাখেন তখন চিৎপুর পতিতাপল্লীর মেয়েরা বিদ্য়াসাগরের ফটোতে মালা দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে আরাধনা করেন।
এতটাই ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল তাঁর ওপর। রাত নটার পর যখন তিনি হাটতে বেরোতেন, তখন এইসব মেয়েদের। দূরবস্থা দেখে তিনি টাকাপয়সার ব্য়বস্থা কোরে বাড়ি পাঠাতেন। যখন এই পল্লীর মেয়েরা জানতে পারলেন-লোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং বিদ্য়াসাগর। তখন তারা নি:শব্দে চোখের জল ফেলেছিলেন। যখন তাদের পরিত্রাতাই নেই পৃথিবীতে তখন তাদের মর্ম বুঝবে কে! যাই হোক তাঁর মৃত্য়ু ৩৫ বছর বাদে তার দুই কন্য়কে ভিক্ষে করতে হয়েছিল। বিদ্য়াসাগর তাঁর উইলে একমাত্র পুত্র নারায়নচন্দ্রকে সমস্ত সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, কিন্তু আইনের সুক্ষ মারপ্য়াচে সমস্ত সম্পত্তি হস্তগত করেছিলেন পুত্র নারায়নচন্দ্র।
আমরা অবাক হই, যে মানুষ সমগ্র বাঙালির কাছে পূজ্য়, তাঁর পরিবারের এমন হতশ্রী দশা, শুনে কষ্ট হয়। ভাবতে হবে পৃথিবীতে কেউ কেউ জন্মায়, যাদের মন মানুষের জন্য় কাঁদে, তাদের মধ্য়ে বিদ্য়াসাগর একজন অন্য়তম, একথা নি:সন্দেহে বলার অপেক্ষা রাখে না।