
মণি ভট্টাচার্য: এও এক সন্ত্রাস। শিক্ষা দুর্নীতি সমন্ধে নিজের বক্তব্য জানিয়েছিলেন ১৮ বছরের প্রেরণা। তাই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের প্রতি ভাষা সন্ত্রাস নামিয়ে আনল 'অনুপ্রেরণার' দল। কদর্য বিদ্রুপ এবং অশালীন আক্রমণ। শুধু তাঁকে নয়, তাঁর বাবা মাকে লক্ষ্য করেও 'বাকস্বাধীনতার এই অবমাননা', 'এটাও কি বাংলার সংস্কৃতি', প্রশ্ন করছে সাধারণ মানুষ। যদিও সেসব মন্তব্যকারীদের উদ্দেশে সমবেদনা জানিয়েই প্রেরণা চুপ হয়ে যান।
'এই দুর্নীতিতে ভরা রাজ্য ঠিক আমার রাজ্য নয়, আমার বাংলা নয়।' লাইনটা কি খুব বেসামাল শোনালো? হয়ত নয়। কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের (Nabarun Bhattacharjee) কবিতার লাইন ধার করে এই উল্লেখটি করেছেন প্রেরণা। প্রেরণা উচ্চ মাধ্যমিকে (High secondary) যুগ্ম ভাবে চতুর্থ। যেখানে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী, শিক্ষা উপদেষ্টা সহ জনা ১৫ নেতা গারদের পিছনে, ঠিক সেখানে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়েই একপ্রকার এহেন মত প্রকাশ করেন প্রেরণা (Prerona Paul)। এইটুকু মাত্র অপরাধ! যার পরিবর্তে প্রেরণাকে পড়তে হচ্ছে তৃণমূলের সাইবার সেলের তীব্র কটাক্ষের মুখে। এ যেন ঠিক অনুপ্রেরণা বনাম প্রেরণার লড়াই। যদিও প্রেরণা নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, 'যারা এই মন্তব্যকে রাজনৈতিক রং দিচ্ছেন ভুল করছেন।' তাঁর মন্তব্য একেবারে নিজস্ব এবং অরাজনৈতিক।
'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়।' কবি নবারুণ ভট্টাচার্য্যের এই লাইন নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল, সে সময়ের সামজিক শাসনের বিরুদ্ধে এই কবিতা প্রতিবাদ জাগিয়ে তুলেছিল। তবে এক্ষেত্রে ওই লাইনটি ব্যবহার করে প্রতিবাদ নয় বরং নিজের আক্ষেপের কথা বোঝাতে চেয়েছেন প্রেরণা। যদিও এসবের জবাবে প্রেরণা হাঁটলেন উল্টো পথেই। যারা প্রেরণার নিন্দা করছেন, কুমন্তব্য করছেন তাঁদের ভালোবাসা ও সমবেদনা জানালেন। সিএন ডিজিটালকে শুক্রবার অনুপ্রেরণা বলেন, 'এসবের পর বাঙালির সংস্কৃতি মানসিকতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেটা বোঝা যায়।'
গোবরডাঙ্গা ইছাপুর হাইস্কুলের ছাত্রী প্রেরণা। তাঁর বাবা অশোক পাল ওই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক। রেজাল্টের পর দিন থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে কুরুচিকর মন্তব্যের শিকার অশোক পাল ও তাঁর পরিবার। শুক্রবার সিএন ডিজিটালকে অশোক পাল জানালেন, 'প্রেরণাকে কেউ প্রভাবিত করেনি, ও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছে। সমসাময়িক সময়ে এই রাজ্যের পরিস্থিতি দেখেছে, এটা ওর নিজের অবজারভেশন। যে বা যারা এটাকে নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করছে তাঁদেরকে কিছু বলার নেই।'
প্রেরণার বাবা অশোক পাল আরও জানিয়েছেন, তিনি এবিটিএ-র রাজ্য কমিটির সদস্য, এ ছাড়া তিনি স্থানীয় বামফ্রন্টের লোকাল কমিটির সদস্য। অভিযোগ, সেজন্যই প্রেরণাকে এবং তাঁর পরিবারকে সামাজিক মাধ্যমে আরও বেশি করে হেনস্থা হতে হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে প্রেরণা বলেন, 'যারা কম বোঝে তাঁদের বোঝানো যায়, কিন্তু যারা বেশি বোঝে তাঁদের বোঝানো যায় না। যারা সাধারণ মতপ্রকাশ ও কুৎসার মধ্যে পার্থক্য বোঝে না তাঁদের কিছু বলার নেই।' সোশ্যাল মাধ্যমে তৃণমূলের এই কটাক্ষ সমন্ধে জানতে চেয়ে তৃণমূলের সোশ্যাল মিডিয়া ইনচার্জ দেবাংশু ভট্টাচার্যকে ফোন করা হলে তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
মোটের উপর শিক্ষা নিয়োগ দুর্নীতি, তা নিয়ে চতুর্থ হওয়া একটা মেয়ের আক্ষেপ অতঃপর শাসক দলের সাইবার বুলিংয়ের শিকার। প্রেরণাই জানিয়েছে সে শিক্ষক হতে চায় না। এসবের মধ্যে কোথাও এটা স্পষ্ট যে শেখানো বুলি আওড়াতে শিখছে না নতুন প্রজন্ম। 'রাজা তোর কাপড় কোথায়?' এ প্রশ্নটা করার ক্ষমতা তাদের মধ্যে আছে। হয়ত প্রেরণা শিক্ষক হবেন না। কিন্তু প্রেরণার মত নতুন প্রজন্ম বিবেকানন্দের দেখানো সমাজের পথ প্রদর্শক হয়ে উঠবে। সেটাই প্রত্যাশা।