
সৌমেন সুরঃ মারা যাওয়া পেনশন প্রাপকের বদলি লোক কিংবা গ্রামের অন্য কেউ প্রকিস দিয়ে পেনশন তুলছে। সুতরাং হার্শেল সাহেব তার হুগলি বিদ্যেটা কাজে লাগালেন। তিনি ঘোষণা করলেন, পেনশন প্রাপকের সাক্ষর ছাড়াও আঙুলের ছাপ দিতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে কাজ শুরু হবার পর ফল হাতেনাতে পাওয়া গেল। পেনশন প্রাপকদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে আরম্ভ করলো। এই ঘটনায় হার্শেল সাহেব উৎসাহিত হয়ে দলিল রেজিস্টেশনের ক্ষেত্রেও আঙুলের ছাপ নিতে আরম্ভ করলেন, যাতে বিক্রেতা অস্বীকার করতে না পারে এবং ক্রেতাও বিক্রেতার সই জাল করে জমি আত্মসাৎ করতে না পারে। কিন্তু হার্শেলের দুর্ভাগ্য কয়েদিদের শনাক্তকরনের ক্ষেত্রে তিনি এই পদ্ধতি প্রয়োগ সরকারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেন। তা না হলে সেইসময় ১৮৬০/৬২- তেই ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কার স্বীকৃত হতে পারতো।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং পূর্ণাঙ্গ হাতের ছাপ নিয়ে নানান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও প্রকৃত ফিঙ্গারপ্রিন্টের তদন্তের আনুষ্ঠানিক সূচনা কলকাতা থেকেই। বিখ্যাত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো অধিকর্তা বিদ্যুৎ নাগের একক প্রচেষ্টায় আজ প্রমণিত, কলকাতাই ফিঙ্গারপ্রিন্টের তদন্তের উৎস। এই প্রসঙ্গে তাঁর বর্ণনায় পাই, কর্মব্যস্ত একজন ইংরেজ আই সি অফিসার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি পুলিস ইনসপেক্টার জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব নিয়েই তিনি অপরাধী শনাক্তকরনে উঠেপড়ে লেগে যান।
বিজ্ঞানী গ্যালটনের প্রমাণিত সূ্ত্র ধরে হেনরি ফিঙ্গারপ্রিন্টকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিলেন শনাক্তকরনের ব্যাপারে। ফ্যান্সের দেহাঙ্গমিতির সংশোধিত রুপটি হেনরির চেষ্টায় বাংলা তথা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রশংসা পায়। ১৮৯৬ সালে পুলিসের সার্কুলারে আঙুলের ছাপকে প্রধান করে। হেনরি অবশেষে স্বীকার করেন, 'অঙ্গলিছাপ' সূ্ত্রটি একশো শতাংশ নির্ভুল রুপে মত দেন দুজন বাঙালি সাব ইন্সপেক্টর। একজন আজিজুল হক, অন্যজন হেমচন্দ্র বসু। তবে সূ্ত্রটি আজও হেনরি পদ্ধতি নামে সারা বিশ্বে প্রচলিত। ১৮৯৭ সালে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যাপারে অনুমোদন পাওয়ার পর ভারতবর্ষে বাংলার মূখ্যকার্যালয় রাইটার্স বিল্ডিং-য়ে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। (সমাপ্ত) তথ্যঋণ/ বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধায়
সৌমেন সুর: ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রথম সূ্ত্রপাত ১৮৫৮ সালে একটু ভিন্ন আকারে দেখা গিয়েছিল। উইলিয়াম হার্শেল তখন হুগলির কালেকটর ডাকাবুকো আইসিএস। মাত্র ২০ টাকার চুক্তিপত্র করে ঘুটিং সরবরাহ করার জন্য রাজ্যধর কোনাইকে অর্ডার দিলেন। কিন্তু অনেক সময় সরবরাহকারীরা চুক্তিপত্র ও সই অস্বীকার করে বিপদে ফেলেন। তাই সতর্ক হার্শেল সাহেব ঠিক করলেন, রাজ্যধরকে একটা প্রস্তাব দেওয়া যাক যে, তাঁকে চুক্তিপত্রর উপর হাতের ছাপ দিতে হবে। অফিসে স্ট্যাম্প দেওয়ার জন্য ভুসো কালির ব্যবহার করা হতো। তাই হাতে কালি মাখিয়ে রাজ্যধরের হাতের ছাপটা চুক্তিপত্রের উপর নেওয়া হল। রাজ্যধরও মজা পেলো সাহেবের এই অদ্ভুত প্রস্তাবে। কিন্তু এই হাতের ছাপটা আজকের বিশ্ব শনাক্তকরনের চূড়ান্ত পন্থা হিসেবে আঙুলের ছাপ ব্যবহারের গোড়াপত্তন করলো। হার্শেল সাহেব আরও অনেকের হাত ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতেন। তবে সবাই এটাকে হার্শেল সাহেবের পাগলামি বলে ধরে নিয়েই হাতের ছাপ দিতেন।
বিষয়টি যে পাগলামি ছিল না, তার প্রমাণ হাতে হাতে পেয়ে গেলেন হার্শেল সাহেব। দু'বছর পর নদীয়া জেলার ডিস্ট্রিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি সবে বদলি হয়েছেন। দেখলেন, মাসের প্রথম দিকে সিপাহি বিদ্রোহ যারা সরকারকে সাহায্য করেছিল, সেসব পেনশন প্রাপকের সংখ্যা বেশ ভালই। যদিও তারা সকলেই বেশ বয়স্ক, তবুও সংখ্যাটা কিছুতেই কমছে না। কিছুদিন পর তিনি বুঝতে পারলেন, মারা যাওয়া পেনশন প্রাপকের বদলি লোক প্রক্সি দিয়ে পেনশন তুলছে হাসিমুখে।
তথ্যঋণ: বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধায়
সৌমেন সুর: ১৮৯৭ সালের জানুয়ারী মাস, রাইটার্স বিল্ডিং তখন ইংরেজদের হেড অফিস। এখানেই প্রথম ফিংগারপ্রিন্টের কার্যালয় স্থাপিত হয়। তবে এখনও পর্যন্ত এফবিআই-এর এডগার নূভারের কর্মশালাটি পৃথিবীর বৃহত্তম সংগ্রহশালা। এই সংস্থার বিপুল ফিংগারপ্রিন্ট সংগ্রহের জন্য আমেরিকায় আজও কোনও অবাঞ্ছিত ব্যক্তি সরকারি চাকরি, মর্যাদাপূর্ন পদ, গুরুত্বপূ্র্ন পদে ঢুকতে পারে না। এভাবেই ওরা নিজেদের দেশকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ফিংগারপ্রিন্টকে বেছে নিয়েছে।
ফিংগারপ্রিন্ট নিয়ে নানা ঘটনা আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্ধমানের নিরুদ্দেশ রাজকুমার প্রতাপচাঁদের পরিচয় দিয়ে এক সন্ন্যাসী ১৪ বছর পরে ফিরে আসে। এই ঘটনা নিয়ো হুগলি আদালতে মামলা হয়। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের বড়দা সঞ্জীবচন্দ্রের বর্ণনায় দেখি-- রাজার এক দুষ্ট আত্মীয় নিজের ছেলেকে বৃদ্ধ রাজার দত্তকরুপে গ্রহণ করেছে বলে নিজে বর্ধমান জমিদারির পুরোটাই কৌশলে হস্তগত করে।
এর বহুদিন পর রাজকুমার সন্ন্যাসীরুপে ফিরে এলে বর্ধমানের জমিদার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাহায্যে তাঁকে জেলে পাঠায়। শেষ জীবনটা সন্ন্যাসীকে খুব দুখ কষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়। সেইসময় ফিংগারপ্রিন্ট সংগ্রহ ও শনাক্তকরন পদ্ধতি চালু থাকলে রাজকুমারকে এভাবে কেউ বিতাড়িত করতে পারতে না। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশই এখন নিজস্ব ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ফিংগারপ্রিন্টের সাহায্য গ্রহণ করে। এটা অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার যে, আজ থেকে একশো বছর আগে মহাকরনের একটি অংশ যে গবেষনা ও কর্মদ্যোগের সূচনা হয়েছিল, আজ তা বৃহৎ কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীর অপরাধ বিজ্ঞানীরা এই বিজ্ঞানের উদ্ভাবনের জন্য ভারত তথা বাংলার কাছে ঋণ স্বীকার করেন।
তথ্যঋন: বিশ্বজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: ঘরে বাইরে উপন্যাসে নিখিলেশের মুখে একটি সংলাপ ছিল, 'কেবল গরুই যদি অবাধ্য হয় আর যদি মোষ অবাধ্য না হয়, তবে ওটা ধর্ম নয়, ওটা অন্ধ সংস্কার।' এই একটি কথায় রবীন্দ্রনাথের সংস্কারমুক্ত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ধর্মের নাম করে এধরনের পশুহত্যার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি সার্বিকভাবে সমস্ত কুসংস্কার আর অন্ধ ধর্মমতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা তাঁকে চালিত করেছে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নির্মমভাবে লেখনী চালাতে। উদাহরনস্বরুপ মহাত্মা গান্ধীর মতো মানুষ যখন বিহারের ভূমিকম্পকে ঈশ্বরের অভিশাপ বা পাপের ফল হিসাবে অভিহিত করেছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ শুধু তার বিরোধিতাই করেননি, এই ধরনের মন্তব্য যে বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, তাও স্পষ্টভাবে বলতে দ্বিধা করেননি।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী মন্তব্য করেছেন, সৃষ্টি শুরু করা বা ব্রহ্মান্ডকে টিকিয়ে রাখার জন্য তথাকথিত ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা নেই।রবীন্দ্রনাথ অনেক আগে বুঝেছিলেন,নাস্তিকতা কুসংস্কার বিরোধী মানসিকতার চরম রুপ। তাই ৭৮ বছর বয়সে লেখা রবিবার ছোট গল্পের নায়ক অভীক একজন ঘোর নাস্তিক। রবীন্দ্রনাথ অভীকের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন যে, দেশে দিনরাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনেোখুনি, সেদেশে সব ধর্মকে মেলাবার পূন্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই।
শুধু ধর্ম নয়, বিজ্ঞানের মধ্যেও যে গোঁড়ামি লুকিয়ে আছে তা আসলে অবিজ্ঞান- এ বোধ রবীন্দ্রনাথেরই।
রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষান,কঙ্কাল, নিশীথে এইসব বিখ্যাত ছোটগল্পগুলিকে অনেক সমালোচক নিছক ভূতের গল্প বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায়,বর্ণনাকারীর মানসিক বিভ্রমই রচনা করেছে গল্পের শরীর।
প্রসূন গুপ্ত: মঙ্গলবার ১৪ মার্চ থেকে শুরু হায়ার সেকেন্ডারি বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। প্রথমদিকে থাকছে প্রথম ভাষা, দ্বিতীয় ভাষার পরীক্ষা, তারপর শুরু হবে বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং কলা বিভাগের মূল বিষয়ের পরীক্ষা। এবার অন্তত সাড়ে ৮ লক্ষের বেশি পড়ুয়া এই পরীক্ষায় বসছেন। এর মধ্যে মহিলা পরীক্ষার্থী ৫৭.৪৩ শতাংশ এবং পুরুষ ৪২.৫৭%। নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিয়ে পড়ুয়াদের আগামি সুরক্ষিত হোক, তা আমাদের কাম্য। সিএন পোর্টালের তরফে সব পরীক্ষার্থীকে শুভেচ্ছা।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর কী? এই পরীক্ষা কিন্তু জীবনের সবচাইতে কঠিন এবং ভবিষ্যৎ গড়ার পরীক্ষা। এরপর উচ্চশিক্ষায় বা পেশাগত জীবনে সাফল্য পেতে পড়ুয়াদের ভাবতে হবে কী পড়বে বা কোন বিষয়ে নিয়ে পড়লে চাকুরি নিশ্চিত। অনেকে আবার ব্যবসা-বাণিজ্যকে পেশা করবেন। এদিকে প্রায় সাড়ে আট লক্ষ পড়ুয়াদের অনেকেই উচ্চমাধ্যমিকের পর আর উচ্চশিক্ষার দিকে ঝোঁকে না। এটা আজ নয় দীর্ঘদিন ধরেই এই রেওয়াজ চলে আসছে।
এর অন্যতম একটি কারণ অর্থের অভাব, অনেকের আবার মেধার অভাব। স্কুল বা সরকারি কলেজে হয়তো বেতন নেহাতই কম। কিন্তু উচ্চমার্গের শিক্ষায় দরকার ব্যক্তিগত শিক্ষক, যা ধরে অনেকেই আর এগোতে পারে না। বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বিষয়টি বেদনার। কিন্তু এমন শিক্ষা আছে বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষা যেখানে আলাদা প্রশিক্ষণের দরকার। দীর্ঘদিন ধরেই এই রাজ্যে আইটিআই শিক্ষা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তো পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন, এটা স্কিলডফুল কর্মীদের যুগ। পেশার জগতে চলতে গেলে স্কিল দরকার। অথচ অনেকেই সাধারণ পড়াশোনায় আগ্রহী হয়। আজকের দিনে বিএ, বিএসসি বা বিকম পাশ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কাজ কোথায়?
এটা নিশ্চিত বলা যেতে পারে শিক্ষার মান বাড়ানো দরকার। কিন্তু আজকের তৃতীয় বিশ্বে শিক্ষা মান এবং প্রসার বাড়ানোর অনেক দিক থাকলেও, কোন বিষয়ে পড়াশোনা করলে চাকরির বাজারটি ধরা যাবে, বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তা নিয়ে প্রচার কোথায়? দেশের জনসংখ্যার নিরিখে সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন নয় দুরূহও বটে। একইসঙ্গে চাকরির বাজারে যে অচলাবস্থা এবং অস্থির ভাব এসেছে, তা দেখে বর্তমান ছাত্রছাত্রীর কাছে বিষয়টি গভীর ভাবনার।
সৌমেন সুর: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বহু উপন্যাস, ছোটগল্প লিখলেও সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে সেই অর্থে কোনও উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনা করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম তাঁর দুরাশা গল্পটি যা আজও সিপাহি বিদ্রোহের সমকালীন সাহিত্য সৃ্ষ্টিকর পটভূমিকায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। গল্পে লেখকের সঙ্গে দার্জিলিং শৈলশহরে ক্যালকাটা রোডে হঠাত্ সাক্ষাত্ হয় বদ্রাত্তনের নবাব গোলামকাদের খাঁর পুত্রীর সঙ্গে। যার শিরায় প্রবাহিত দিল্লীর সম্রাট বংশের রক্ত।নবাব দুহিতার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে লেখক জানতে পারেন জনৈক হিন্দু ব্রাহ্মণ কেশরলালের সঙ্গে তাঁর অব্যক্ত গোপন প্রণয়ের কথা।
সেই সময় সিপাহি বিদ্রোহ আরম্ভ হলে উগ্র জাতীয়তাবাদী কেশরলাল, বদ্রাত্তনের ক্ষুদ্র কেল্লার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়। নবাব দুহিতার ভাষায়-এমন সময় কোম্পানি বাহাদুরের সহিত সিপাহিদের লড়াই বাঁধিল। আমাদের বদ্রাত্তনের ক্ষুদ্র কেল্লার মধ্যেও বিপ্লবের তরঙ্গ জাগিয়া উঠল। কেশরলাল বলিলেন, 'এবার গোখাদক গোরালোককে আর্যাবর্ত হইতে দূর করিয়া দিয়া আর একবার হিন্দুস্থানে হিন্দু মুসলমান রাজপদ লইয়া দ্যূত ক্রীড়া বসাইতে হইবে।'
এবার গোলামকাদের খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় জেলার কমিশনার সাহেব কেল্লার আত্মগোপনকারী কেশরলালকে যুদ্ধে পরাজিত করে। যমুনার তীরে মৃতপ্রায় কেশরলালকে জলদান করে বাঁচায় নবাবপুত্রী। কিন্তু সে তাঁকে প্রত্যাখান করে যমুনায় নৌকা করে পালিয়ে যায়। গৃহত্যাগী নবাবপুত্রী এরপর কাশীর শিবানন্দ স্বামীর কাছে সংস্কৃত শিক্ষা এবং হিন্দুধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। এরপর যোগীনির বেশে ৩৮ বছরের দীর্ঘ অন্বেষনে কেশরলালকে খুঁজে পায় দার্জিলিংয়ে।
একথা সত্য যে, উনবিংশ শতাব্দীর সিপাহিদের এই মহাবিদ্রোহ পরিণত হয়েছিল এক সাংঘাতিক গণবিদ্রোহ ও বিপ্লবে। এই গণবিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন তত্কালীন লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। বঙ্কিমচন্দ্র,দীনবন্ধু মিত্র,মধুসূদন, ভূদেব মুখ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত-র মতো আলোচ্য লেখকগন অত বিখ্যাত না হলেও সিপাহি বিদ্রোহে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
তথ্যঋণ: রবীন্দ্র রচনাবলী ৮ম খন্ড/সুরজিত্ ধর
সৌমেন সুরঃ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ প্রথম সশস্ত্র গণ অভ্যুত্থান-পরাধীন ভারতে। এই সালে মহাবিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ প্রথম অভিভক্ত বাংলাদেশে প্রজ্জ্বলিত হলেও বাঙালিরা সক্রিয়ভাবে এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেনি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার ফলে দেশের নব উদ্ভূদ জমিদার শ্রেণি বিদ্রোহীদের বিপক্ষে যোগদান করে এবং ইংরেজ প্রভুদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করে তাদের শ্রেণিস্বার্থ ও চরিত্র নগ্নভাবে প্রকাশ করে।
কিন্তু জমিদার শ্রেণির প্রধান সংগঠন 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন' বিদ্রোহী সিপাহীদের আচরণের নিন্দাসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করে। তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা 'সংবাদ প্রভাকর'-এ সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নির্মমভাবে বিদ্রোহের সমালোচনা করেন। সৃজনশীল রচনায় যেমন উপন্যাস ও ছোট গল্পে, সে সময়ের দুই দিকপাল সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রমেশ চন্দ্র দত্ত সিপাহী বিদ্রোহকে অবলম্বন করে কিছু সৃষ্টি করা থেকে আশ্চর্যরকম বিরত ছিলেন। কিছু স্বল্পখ্যাত লেখক সিপাহী বিদ্রোহের বীরগাথা উপজীব্য করে উপন্যাস রচনা করেছেন। মহাবিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা প্রথম উপন্যাস 'চিত্তবিনোদিনী' লেখক গোবিন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, প্রকাশকাল ১৮৭৪। এই উপন্যাসে লেখক প্রথম সচেতনভাবে সিপাহীযুদ্ধের পটভূমিকা অবলম্বনে কাহিনি রচনা করেন।
১৮৭৯ সালে প্রকাশিত উপেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের নানাসাহেব উপন্যাসে নানাসাহেবকে কেন্দ্র করে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস বিধৃত। নানাসাহেব তাঁর ছোট ভাই বল্লারাও-এর প্রেমিকা অহল্যার রুপে মুগ্ধ হয়ে, তাঁকে পাবার লোভে এত উন্মত্ত হয়েছেন যে, কর্তব্যকর্ম, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে অবহেলা করছেন। (চলবে) (তথ্যঋণ- সুমিত তালুকদার)
সৌমেন সুর: বাঙালির আমিষ-নিরামিষ দুটি রান্নার খ্যাতি একসময় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। চৈতন্য দেবের আচার্য অদৈত্বদেবের স্ত্রী সীতাদেবীর নিরামিষ রান্নার যে নিখুঁত বিবরণ আছে, তা বাঙালীর রান্নার ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। 'ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজ' গ্রন্থটির বিখ্যাত লেখক জেএ সান্ডারল্যান্ড, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর স্ত্রীয়ের হাতের রান্না খেয়ে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁকে আমেরিকায় রান্নার স্কুল খোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রাজা নবকৃষ্ণদেব তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধে সেইসময় কুড়ি লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। নিমন্ত্রিতদের আহার্য সব দোকান থেকে সংগ্রহ করার জন্য, সেদিন কলকাতার সব মুদি দোকানের চাল-ডালই ফুরিয়ে গিয়েছিল।
কুমারটুলিতে একটিও মাটির হাড়ি ছিল না। ছিল না আশেপাশের কোনও কলাগাছের আস্ত পাতা। নবকৃষ্ণের এই নিমন্ত্রণ আজও ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। বিদ্যাসাগরের মা ভগবতীদেবীর রান্নার খুব যশ ছিল। তাঁর হাতের আমিষ রান্না খেয়ে, তত্কালীন শিক্ষাকর্তা হ্যারিসন সাহেব দারুন খুশি হয়েছিলেন। এই রান্নার গুণটি বিদ্যাসাগর মহাশয় ভীষণভাবে রপ্ত করেছিলেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে খাওয়া আর খাওয়ানোর ব্যাপারে বাঙালিদের মতো এমন ভোজনরসিক জাত সত্যিই বিরল। তবে এখন আর সেই নিমন্ত্রণের বহর নেই।পেটুকদেরও আর সেই ইজ্জত নেই। আছে শুধু হারিয়ে যাওয়া কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি।
তথ্যঋণ সুরজিত্ ধর।
সৌমেন সুর: সে একটা দিন গেছে। এখন আর তেমন কিছু চোখে পড়ে না। যখন মানুষ খেয়ে এবং খাইয়ে সমান তৃপ্তি পেতো। জিনিসপত্রের তেমন আকাল ছিল না। এক একজন খেতে পারতেনও প্রচুর। সেসব কথা শুনলে নেহাতই্ গল্পকথা মনে হবে। যেমন ধরুন রাজা রামমোহন রায়ের কথা। তিনি ছিলেন সুপুরুষ ও তেজস্বী। খাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনেকের উপরে। একটা গোটা পাঁঠার মাংস খাওয়া তার কাছে কোনও কঠিন ব্যাপার ছিল না। দিনে বারো সের দুধ খেতেন। পঞ্চাশটা আম আর এক কাঁদি কলা-নারকেল অনায়াসে সেবন করতেন। নিজের শারীরিক শক্তি সম্পর্কে ছিল প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস।
অন্যদিকে প্যারীমোহন সরকার, প্রথম জীবনে ছিলেন ভীষণ পেটুক। সে সময় তিনি জলখাবার সারতেন এক ধামা মুড়ি আর শ'খানেক মুলো খেয়ে। বারাসাতে এক নিমন্ত্রণ বাড়িতে তর্ক করে খেয়ে ফেলেছিলেন একসের ছানাবড়া। মাংস খাওয়ার ব্যাপারে বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন তার যোগ্য সহচর। পাঁঠা কাটা হলে দুই বন্ধু মিলে অর্ধেকটা সাবাড় করে দিতেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনও এ ব্যাপারে কম যান না। পেটভরে পোলাও মাংস খেয়ে, দু সের রসগোল্লা-অম্লান বদনে খেয়ে ফেলতেন। সেকালের খাওয়া নিয়ে কোনও কথা উঠলে ঠাকুরবাড়ির কথা চলে আসে অবিশ্বাস্যভাবে। দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ-- এঁরা প্রচুর খেতে না পারলেও খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ শৌখিন। রবীন্দ্রনাথ আবার এক খাবার দুবার খেতেন না। প্রখ্যাত লেখিকা পার্ল বাক বাঙালি রান্নার প্রশংসা করে গেছেন। সবুজ কলাপাতার উপরে অতি মিহি চালের ভাতের সঙ্গে নানা দর্শনধারী পদের গুন ও স্বাদুতাকে তিনি পোয়েটিক বলে বর্ণনা করে গেছেন।
তথ্যঋণ/ সুরজিত্ ধর
সৌমেন সুর: রঞ্জিতবাবু রবীন্দ্রনাথকে বিনম্র প্রণাম জানিয়ে বললেন,'কাজী নজরুল ইসলাম একটা খুব অন্যায় কাজ করে ফেলেছেন। তিনি আপনার 'নমো হো নমো' গানটির অনুকরনে একটি হাসির গান লিখে ফেলেছেন। আর তার থেকেও বেশি অন্যায় করে ফেলেছি আমি নিজে। আমি গানটি রেকর্ড করে ফেলেছি। অন্যায় জেনেও গানটি একবার শোনার অনুরোধ করছি। যদি মনে করেন তবেই অনুমোদন দেবেন।'
কবিগুরু গানটি চালাতে বললেন। শুনতে শুনতে কবির মনে কৌতুক প্রকাশ হল। আবার চালাতে বললেন। এবার শোনার পর বললেন,'অনুমতি দিতে পারি একটা শর্তে। বার্তাটি হল তিনটে রেকর্ড দিতে হবে।' সবাই শুনে হেসে ফেললেন। এভাবেই জন্ম হল প্যারোডি গানের। যাত্রা শুরু হল সেই তখনই। এরপর এই কাজে এগিয়ে আসেন তৎকালীন দুই কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ও সতীশ ঘটক। সতীশ ঘটক কবিগুরুর একটি গান, 'তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী'র অনুসরণ করে লেখেন, 'তুমি কেমন করো পান করো হে চুনি'। আর কুমুদরঞ্জন মল্লিক রবিঠাকুরের 'সে যে কাছে এসে' এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুসরনে লেখেন, 'আমার পাকার যখন কথা ছিল।' কিন্তু দু'জনের কারও অনুমতি পাওয়া হল না, কারণ গুরুদেব প্রয়াত হন।
মিন্টু দাশগুপ্ত ও দীপেন মুখোপাধ্যায় দু'জনেই অপেক্ষা করে বলেন, বিচিত্রানুষ্ঠানের স্বাদ বদলের জন্য থাকতো প্যারোডি গান, হাস্যকৌতুক, মুকাভিনয়, আবৃত্তি ইত্যাদি। কিন্তু হঠাৎ করেই এগুলো সব হারিয়ে গেল। দীপেনবাবুর কথায় 'লক্ষ্য করে দেখবেন জীবনমুখী, ব্যান্ডের নামে যেসব গান হচ্ছে তার অনেকগুলোই প্যারোডি। পাতালঘর ছবিতে খরাজ মুখার্জির গানটার কথা ভাবুন। তাহলে আমাদের বেলায আপত্তি কেন!'
সবশেষে বলতে হয়, বর্তমানে হাসি জীবন থেকে প্রায় উঠে গিয়েছে। সেখানে যদি প্যারোডি গান হাসির মোড়কে জীবন যন্ত্রণার কথা তুলে ধরা যায়-তাতে ফল ভালো ছাড়া খারাপ কোথায়! আশা করছি-আবার যেন বাজারে প্যারোডি গানে রমরমিয়ে ওঠে। তথ্যঋন- দীপক মজুমদার। (সমাপ্ত)
সৌমেন সুরঃ প্যারোডি গানে একমসয় দর্শককে মাতিয়ে রেখেছিলেন শিল্পী মিন্টু দাশগুপ্ত, দীপেন মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত রায়, অমল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। মিন্টুবাবুর গলায় বিষাদের সুর, 'আমাদের গান শেষ হয়ে গেল।' তাঁর আক্ষেপ যে ভুল নয় আজকের সংগীত জগতের দিকে তাকালে তা মর্মে-মর্মে টের পাওয়া যায়। নতুন প্রজন্মের এই ধরনের গানের ব্যাপারে তেমন কোনও আগ্রহ নেই।
প্যারোডি গান মিন্টুবাবুর হাত ধরে আসেনি। ওর মতে এ ধরনের গান-এর স্রষ্টা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু হাসির গান লিখেছেন। কাজী নজরুল ইসলামও পিছিয়ে নেই। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দও অবশ্য গান ভেবে লেখেননি। লিখেছেন কবিতা। সেই কবিতায় দুর্দান্ত সুরের মায়াজালে সনৎ সিংহের গাওয়ার গুনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্যারোডি গানের আলোচনা করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের রচনাতেই। রবীন্দ্রসংগীতের প্যারোডি করেন স্বয়ং কাজী নজরুল।
তিনি রবীন্দ্রসংগীতের আদলে একটি গান লেখেন। জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত 'আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো, নমো হে নমো'-র অনুকরণে নজরুল লেখেন, 'একবার নাম হে নাম।' নজরুলের বাড়িতে প্রায়ই গানের আড্ডা বসতো। সেই আড্ডায় রঞ্জিত রায়ও থাকতেন। যিনি একাধারে অভিনেতা ও গায়ক। গান গাইলেও তিনি মূলত ছিলেন হাসির গানের শিল্পী। একবার 'নাম হে নাম' গানটি শুনে তিনি ঠিক করেন গানটি রের্কড করবেন। করলেনও এবার প্রকাশ হবে কীভাবে। রবীন্দ্রগানের অনুকরণ যেহেতু, তাই গুরুদেবের অনুমতির প্রয়োজন। ঠিক হলো জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যাওয়ার। রঞ্জিতবাবু এইচএমভি রিজিওন্যাল ম্যানেজার হেম সোমকে সঙ্গে নিলেন। যথারীতি প্রণাম ও আলাপ পর্ব শেষে রঞ্জিতবাবু আসল কারণটাই নিবেদন করলেন বিনীতভাবে। (চলবে) তথ্যঋণ/ দীপক মজুমদার।
সৌমেন সুর: ভারতজুড়ে হোলি আর সমগ্র বাংলাজুড়ে এই দোল উত্সবে রঙ আর আবীরের খেলায় মেতে ওঠেন সবাই। এই দোল উত্সব একসময় ছিল রাজ-রাজড়া জমিদার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। খেলতেন নবাব-বেগমরাও। ১৪৮৬ সালে এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় দোলযাত্রার দিন সন্ধ্যাবেলায় আর্বিভূত হয়েছিলেন এক মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব। চৈতন্যদেবের নগরসংকীর্তন, দোল উত্সবে ফাগ ও আবীরের সঙ্গে সেই নগরকীর্তন অন্য মাত্রা পেতো।
দোলে আবীর একটা মস্ত পার্ট। ভীষণ ঐতিহ্যময়, বেশ লাগে-এই আবীর খেলায়।রঙ খেলা ছাড়া এই আবীর কোথা থেকে এলো? আবীর কীভাবে তৈরি হয়? আবীরের তত্ত্ব-তালাশ জানতে প্রথমেই মনে পড়ে, রাজস্থানের এক উচ্চবিত্ত পরিবারের পদম সিং ১৫০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় কলকাতায় আছেন। কলকাতায় সর্বপ্রথম তার ঠাকুরদা উদয়চাঁদ মানত আবীরের ব্যবসা শুরু করেন। বড়বামরের উদয়চাঁদ রঞ্জিত সিং-এর দোকানে ৫০ বছর আগেও জার্মানি থেকে রঙ আসতো, গুণগতমান ভাল রাখার জন্য। এছাড়া বুড়ো প্রোডাক্টের প্রদীপ সাঁতরা।বয়স ৫০। আবীর তৈরিই তার ধ্যান-জ্ঞান।
প্রদীপবাবুর আবীর নির্মাণ পদ্ধতি একটু আলাদা। একটা গামলায় ফ্রেঞ্চচক, রঙ, জল, বোরিক অ্যাসিড ও সেন্ট মিশিয়ে ভাল করে মেখে রোদে দেওয়া হয়। গন্ধের জন্য ব্যবহার করা হয় জেসমিন-রোজ। আর চামড়ার ক্ষতি না হওয়ার জন্য বোরিক অ্যাসিড। দোল সত্যি একটা উত্সব বটে। বিশেষ করে আবীর খেলা। আবীর ছুঁয়ে শপথ করি আমরা-রঙ হোক ঐক্যতায়, সহমর্মিতায়, আমরা যেন একে অপরের হাত ধরে চলতে পারি। বসন্তের হাওয়ার পূর্ণ হোক আমাদের নির্মল মন।
তথ্যঋণ/ সুজাতা হালদার
সৌমেন সুর: মেদিনীপুরের মেয়ে সৌদামিনী। আইন অমান্য আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৩২ সালের ১১ ডিসেম্বরে বাগবাজারে সভা করতে যাওয়ার সময় পুলিশ লাঠি চালায় তাঁদের উপর। সৌদামিনীকে রাস্তা দিয়ে টেনে-হিচঁড়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময়, পুলিশের সামনেই চিৎকার করতে করতে দেশবাসীর উদ্দেশে দৃপ্তকন্ঠে বলেছিলেন, প্রতিটা জিনিস কেনার সময় চিন্তা করে দেখবেন সেটা ভারতে তৈরি কিনা।
শুধু তাই নয়, বিচারের সময় তিনি বিচারককে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, আইন ভাঙলে আপনারা যাকে খুশি গ্রেফতার করতে পারেন। কিন্তু মহিলাদের প্রতি পুলিশ খারাপ কথা বলতে পারে কোন আইনে? জনতার উপর লাঠি চালানো হয় কোন আইনে? তাঁর প্রশ্নের কোনো উত্তর বিচারকের কাছে ছিল না। তবুও বিচারক তাঁকে ছ'মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
চামেলী গুপ্ত কলকাতার নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি বড়বাজারে শোভাযাত্রা, পিকেটিং করতেন পুরুষদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে। বড়বাজার বিলাতি বস্ত্রের ব্যবসায়ীরা রীতিমত ভয় পেতো এই উত্তরপ্রদেশের কন্যাকে দেখে। তিনি গর্ভবতী অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। সরকার থেকে বন্ড লিখতে বললেও তিনি রাজি হননি। তাই ছাড়া পাননি।
জেলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন চামেলী। জেলের মধ্যে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর শরীর আরও খারাপ হলে,সরকার বিনা শর্তে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যায়। কয়েকদিন পরে চামেলী ও শিশু পুত্র মারা গিয়েছে। দেশের জন্য তাঁর এই আত্মত্যাগের কথা না খাতাতে, না স্মৃতিতে কোথাও নেই। তথ্যঋণ: সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: সময় যতই আধুনিক হোক না কেন, রাধা কিন্তু তার থেকেও আধুনিক। প্রত্যেকের ভাবনায় আলাদাভাবে রাধা ধরা দেন। যত দিন যাচ্ছে, রাধা যেন আবিষ্কৃত হচ্ছেন নতুন রুপে। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেমিকা রাইকিশোরী, কালক্রমে পরিণত হলেন শ্রীকৃষ্ণের নায়িকায়। তিনি মহাভাবময়ী। তাঁর জাগতিক প্রেম পরিণত হলো স্বর্গীয় অনুভূতিতে। শ্রীরাধা, এই নামটি আমাদের চির চেনা,আবার অচেনাও। তিনি কাছের হয়েও অধরা। রাধা মানেই প্রেম, আবার রাধা মানে সাধনা। প্রেম ও সাধনাকে একাকার করেছে রাধা নাম।
রাধা ডুবে গেলেন কৃষ্ণ প্রেমে। ইন্দ্রিয়র স্বাভাবিক আর্কষণ তাঁকে টেনে এনেছে কৃষ্ণের কাছে। বৈষ্ণব কবিদের নিপুন কলমে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলার বর্ণনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রস সাহিত্যের উদাহরণ। প্রেম যখন গভীর, তখন কৃষ্ণ ব্যাকুল রাধাকে একবার চোখে দেখবার জন্য, রাধার অবস্থাও তাই।
তোমার জন্য তোমাকে চাই-এটাই হলো রাধাতত্ত্বের আধুনিক দর্শন। পার্থিব চাহিদামতো জগৎ এই একটি উচ্চারণে অপার্থিব অলৌকিক হয়ে ওঠে। রাধার প্রেমের কৃতিত্ব এখানে। রাধা চির আধুনিক এই কারণে love for, love sake। ভালোবাসার দুরন্ত বাণী-তোমার জন্য তোমাকে চাই, রাধার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো। আধুনিকতার এমন নির্দশন রাধা ছাড়া, অন্য কোনও মধ্যে দেখি না।
সবাই যখন বলেন আমি কৃষ্ণের, একমাএ রাধা বলেন-মানুষের সঙ্গেই হোক বা ভগবানের সঙ্গে- প্রেমে সম্পূর্ণ সমর্পণ। আত্মনিবেদন না থাকলে অধিকার আসে না। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী মানবীয় ভাবে উঠে এলেও মূলত ঈশ্বরের প্রতি বা মুক্তির প্রতি জীবকূলের চরম আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। কৃষ্ণ যদি মুক্তির স্বরুপ পরমাত্মা হন, রাধা তবে জীবাত্মার প্রতীক।
সৌমেন সুর: রাস্তা দিয়ে বিয়ের শোভাযাত্রা দেখে রাজকুমারী চোখের পলক পড়ে না। সোজা মায়ের কাছে আবদার করে, 'মা আমার বর কই।' মা পড়লেন মহাফ্যাসাদে। কী করে মেয়েকে শান্ত করাবেন। অবশেষে মেয়েকে ধরে সোজা ঠাকুরঘরে এসে গিরিধারীলালকে দেখিয়ে বলেন,'এই যে তোমার বর মেঘে তারিখে দেখে আপ্লুত হয়ে যায়।' প্রথম পর্বের পর...
মীরা যখন আপন মনে ধ্যান করতে করতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, সেই সময় বিজয়বর্গীয় নামে একজন এসে, ক্ষুধার্ত মীরাকে দুধ এনে দেয়। মীরা দুধের বাটি এনে নিবেদন করেন গিরিধারীলালকে। এরপর চরণামৃত জ্ঞানে সবটুকু খেয়ে ফেলেন। এদিকে বিজয়বর্গীয় ভয়ে কাঁপতে থাকেন। কারণ দুধে রানা মিশিয়ে দিয়েছেন বিষ। কিন্তু কৃষ্ণভক্তির জেরে বিষ অমৃত হয়ে যায়। মীরা কৌটো খুলে সাপটাকে মালা ভেবে গলায় ধারণ করে। মীরার প্রতি এরকম অনেক রকম অত্যাচার শুরু হয়। কিন্তু প্রতিবারই কৃষ্ণ মীরাকে বাঁচিয়ে দেয়।
মীরা সেই শৈশব থেকে শ্যামকে ভালবেসেছে। গিরিধারীলালের পুজোয় দেহমন সব সমর্পণ করেছে। ওই কালো রূপে মন মজেছে। কালো রূপে মগ্ন মীরা ব্যাকুল, চর্মচক্ষুতে কৃষ্ণের দর্শনে। সিংহাসনে শ্যমকে বসিয়ে কখনও হাসছেন, কখনও কাঁদছেন। দু'জনে শুধু মন দেওয়া-নেওয়া। ভক্ত আর ভগবানের মাঝে সেতুবন্ধন হলো মীরার ভজন। এরপর অনেক ধরনের অত্যাচার করেও রানা পরিশ্রান্ত, তখন মীরাকে চিতোর ত্যাগ করার আদেশ দিলেন।
কৃষ্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাতের অন্ধকারে কাউকে কিছু না বলে মীরা দ্বারকার পথে পা বাড়ালেন। আসলে ভক্তিতেই মুক্তির সন্ধান। মীরা আজ সিদ্ধা। মীরার শরীরে কৃষ্ণপ্রেমের পূর্ণ প্রকাশ। মীরা আজ গিরিধারীলালের প্রেমিকা। কলঙ্কের ভাগী হয়ে ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিলেন মীরা। শুধু নিজের প্রেমকে বিসর্জন দেবেন না বলে।
কৃষ্ণলীলার স্বরূপ সন্ধানে শুধু রাধা নয়, মীরার আত্মনিবেদনের নির্যাসকে আত্মস্থ করতে হয়। আর এখানেই অমরত্ব পেয়েছেন মানবী মীরাবাঈ।