
ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলার আগে নানা মন্দিরে যাওয়ার রীতি ছিল একসময়,যা আজও আছে কি না জানা নেই | তবে কালীঘাটের মন্দিরে পুজো দেওয়ার ব্যাপারে কে আগে যাবে, তা নিয়েও দৌড়ঝাঁপ ছিল | পুজোর ফুল মাথায় ঠেকিয়ে কপালে সিঁদুরের তিলক কেটে দিতেন দলের কর্মকর্তারা | প্রদীপ ব্যানার্জি বা পি কে ব্যানার্জিরও তুকতাক ছিল প্রচুর | তিনি সিজনের প্রথম ম্যাচে যে শার্ট বা প্যান্ট পরতেন, শেষ দিন অবধি ওই পোশাকই পরতেন | অমল দত্তের অবশ্য পোশাকের বিষয়ে কোনও বাছবিচার ছিল না |
মাঠে কোন দল আগে নামবে, তা নিয়েও অশান্তি হয়েছে বহুবার |
মোহনবাগানের এক সময়ের সম্পাদক ধীরেন দে খেলার দিন মাঠে আসতেন না | তিনি তাঁর গাড়ি নিয়ে গঙ্গার ধারে বসে থাকতেন। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। কাজেই মাঠে গোল বলে চিৎকার শুনলে ড্রাইভারকে পাঠাতেন জেনে আসতে, কে গোল দিল| খেলার শেষে মাঠে আসতেন | ইস্টবেঙ্গলের এক সমর্থক এই সেদিনও জার্সি-বুট পরে খেলা দেখতে আসতেন | চলচ্চিত্র অভিনেতা জহর গাঙ্গুলি নিজেই মাঠে যেতেন এবং নিজের জন্য একটি বসার জায়গা ঠিক রাখতেন| তিনি মোহনবাগানের গোঁড়া সমর্থক ছিলেন |
অন্যদিকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কাঠ বাঙালি এবং ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক | এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে মাঠে যেতেন এবং একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে টেনশন কাটাতেন |
মহানায়ক উত্তমকুমার ছিলেন মোহনবাগানের সমর্থক | তিনি মাঠে যেতেন না ঠিকই, কিন্তু ডার্বি থাকলে সহ অভিনেতা মন্টু ব্যানার্জিকে রেডিওর রিলে শুনতে বসাতেন | ১০ মিনিট বাদে বাদে মন্টুর কাজ ছিল 'গুরু'র কাছে রেজাল্ট বলে আসা | মোহনবাগান জিতলে নিজের ফ্ল্যাটে ওইদিন রাতে হুইস্কির আসর বসত | আসলে বিষয়টি তখন জীবনের অঙ্গ ছিল | উত্তমবাবু চাকরি জীবনে মাঠে যেতেন বলে জানা যায় | অন্যদিকে তাঁর নায়িকারা বেশিরভাগই ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের | সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং সুপ্রিয়া দেবীও পূর্ববঙ্গের মেয়ে ছিলেন, এমনকি লাল-হলুদের সমর্থকও |
(আগামী পর্বে চতুর্থ ভাগ)
শীতকালের পরিচিত সবজিগুলির মধ্যে সিম অন্যতম। সিম দিয়ে তৈরি অনেক লোভনীয় পদ সবাই খেয়েছেন। এবার শীতে গরম ভাত সহযোগে একবার সিমের ভর্তা খেয়ে দেখুন, এই পদটির প্রেমে পড়ে যাবেন। আড়াইশো গ্রাম সিম নিয়ে জলে ধুয়ে পরিষ্কার করুন। জলে আন্দাজমতো নুন দিয়ে সিম হালকা সিদ্ধ করে নিন। জল ঝরিয়ে ঠান্ডা করুন। তাওয়া আঁচে বসিয়ে তিনটে শুকনো লঙ্কা সেঁকে নিন। সিম ঠান্ডা হয়ে গেলে মিক্সিতে দিয়ে তিনটে তাওয়ায় সেঁকা শুকনো লঙ্কা, দুই টেবিল চামচ ধনেপাতা কুঁচি, তিনটে কাঁচালঙ্কা দিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করে নিন।
কড়া আঁচে বসিয়ে এক টেবিল চামচ সর্ষের তেল গরম করে ওর মধ্যে হাফ চা চামচ কালোজিরে ও তিনটে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে দেড় টেবিলচামচ রসুন কুঁচি দিয়ে হালকা ভেজে নিন । এবার ওর মধ্যে সিমবাটার মিশ্রণটা দিন। দুই চা চামচ কালো সরষেবাটা ভালো করে নেড়ে কষিয়ে নিন। আন্দাজমতো নুন ও চিনি দিয়ে নেড়ে ভালো করে মিশিয়ে আঁচ থেকে নামিয়ে নিন। গরম ভাত সহযোগে পরিবেশন করুন।
বাংলাদেশি টমেটোর ভর্তাও স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। যদিও বাজারে বারো মাসই টমেটো পাওয়া যায়, তবু শীতকালীন টমেটোর একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। টমেটো দিয়ে খুব চটজলদি এই পদটি তৈরি করা যায়। ভাতের সঙ্গে টমেটো ভার্তা বেশ মজাদার একটি পদ।
কড়া আঁচে বসিয়ে তার মধ্যে এক টেবিল চামচ সর্ষের তেল গরম করে চারটে শুকনো লঙ্কা ও দুই টেবিল চামচ থেঁতো করা রসুন দিয়ে হালকা ভেজে তুলে আলাদা করে রাখুন। এবার আরও এক টেবিল চামচ তেল গরম করে ওর মধ্যে গোটা ছয়েক আস্ত টমেটো দিয়ে নিভু আঁচে ভেজে ভাপিয়ে নিন। এবার টমেটোগুলো তুলে আলাদা করে রেখে ঠান্ডা করুন। একটি পাত্রে ভাপানো টমেটোর সঙ্গে আন্দাজমতো নুন, ভাজা রসুন, শুকনো লঙ্কা, দুটো বড় পেঁয়াজ কুঁচি, ছোট এক আঁটি ধনেপাতা কুঁচি, তিনটে কাঁচালঙ্কা কুঁচি ও এক টেবিল চামচ সর্ষের তেল দিয়ে হাতের সাহায্যে ভালো করে চটকে মেখে নিন। টমেটোর ভর্তা তৈরি হয়ে গেল। গরম ভাত সহযোগে পরিবেশন করুন।
ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান। দুই দলে খেলে গিয়েছেন বহু কৃতি ফুটবলার | কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। যেমন চূনী গোস্বামী, সুব্রত ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ চ্যাটার্জি কোনওদিন ইস্টবেঙ্গলে খেলেননি। এর মধ্যে চূনী এবং সুব্রত ঘোরতর বাঙালবাড়ির ছেলে ছিলেন | অন্যদিকে, প্রশান্ত সিংহ, রামবাহাদুর, শান্ত মিত্র ইস্টবেঙ্গলে খেলে গিয়েছেন, কোনওদিনও মোহনবাগানে খেলেননি। অথচ শান্তবাবু ও প্রশান্তবাবুর এই বাংলায় দেশ বলেই শোনা যায় | রামবাহাদুর তো নেপালি ফুটবলার ছিলেন। কস্মিনকালেও বাঙাল বলা যাবে না |
ইস্টবেঙ্গলের চোখের মণি ছিলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি একবার অভিমান করে মোহনবাগানে খেলেছিলেন। কিন্তু তাঁর পারফরম্য়ান্স ছিল খুব খারাপ। একই কথা বলা যায় তরুণদের বিষয়েও | অন্যদিকে সুব্রত ভট্টাচার্য একবার ইস্টবেঙ্গলের কোচ ছিলেন এবং সেবছর তাঁর দল খুব ভালো খেলেছিল | অনেকেই দুই দলে খেলেছেন এবং বেশ ভালো ছিল তাঁদের পারফরম্য়ান্স | এঁদের মধ্যে সুধীর কর্মকার, গৌতম সরকার, প্রশান্ত ব্যানার্জি, হাবিব, নাঈম, আকবর, চিমা, বাইচুং যখন যে দলে খেলেছেন, দুর্দান্ত ছিলেন | ভাস্কর গাঙ্গুলি ১৯৭৫ এ মোহনবাগানের গোলরক্ষক হিসাবে ৫ গোলের মধ্যে ৪ গোল খেয়েছিলেন | তাঁর এই ভয়াবহ পারফরম্য়ান্সে দল একপ্রকার তাঁকে বিদায় জানায় | ভাস্করকে ইস্টবেঙ্গলে নিয়ে আসেন কোচ অমল দত্ত। তারপর ইতিহাস | ভাস্কর ভারতের সর্বকালের অন্যতম গোলরক্ষক হয়েছিলেন |
দুই ক্লাবের একটা বাঙালি সংস্কৃতি ছিল | যে দল যখন জিতেছে, অন্য দলে তারা মিষ্টি পাঠিয়েছে | ৭০ দশকের আগে টাকাপয়সার কোনও গল্প ছিল না | চালু হয় হাবিব, নাঈম থেকে। তাও তাঁরা যৎসামান্য টাকা পেতেন এবং দুবেলা খাওয়া আর মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই দেওয়া হত | তারও আগে বহু অন্য প্রদেশের ফুটবলার এ রাজ্যে খেলে গিয়েছেন স্রেফ থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে| দলকে ভালোবাসার খামতি থাকত না তাঁদের খেলার | একবার দেশে যাওয়ার জন্য টাকার দরকার ছিল হাবিবের। কিন্তু তাঁর বুকের পাটা ছিল না টাকা চাইবার।
শেষ পর্যন্ত তাঁর হয়ে সুধীর কর্মকার নাকি ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তা জ্যোতিষ গুহর কাছে টাকা চেয়ে মাত্র একশো টাকা হাবিবের হাতে তুলে দেন | আসলে দল অন্ত প্রাণ ছিল তৎকালীন খেলোয়াড়দের | যান লড়িয়ে খেলতেন বলেই সমর্থকরা পাগলের মতো দলের জন্য গলা ফাটাতো | আজ পেশাদারির যুগ ভালো খেলোয়াড় নিশ্চই আছে, হয়তো আরও ভালো। কিন্তু তাদের খেলা পেশাদারিত্বতে ভরা, হৃদয়ের যোগ নেই বোধকরি |
(পরবতী পর্ব আগামীকাল)
শীতকালে নানা রকমের সবজির প্রাচুর্য দেখা যায় বাজারে। বাঁধাকপি তাদের মধ্যে অন্যতম। শীতকাল মানেই সুস্বাদু বাঁধাকপির তরকারি জিভে জল এনে দেয়। ভাত, রুটি, লুচি, পরোটা সব দিয়েই বাঁধাকপির তরকারি উপাদেয়। এবার বাঁধাকপি দিয়ে একটা স্ন্যাকসের পদ তৈরি করে ফেলুন। শীতের বিকেলে গরম চা বা কফি সহযোগে জমিয়ে খান বাঁধাকপির কাটলেট।
একটা মাঝারি সাইজের বাঁধাকপি সরু লম্বা লম্বা করে কেটে নিন। দুটো বড় গাজর, একটা ক্যাপসিকাম সরু লম্বা লম্বা করে কেটে নিন। চারটে আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে চটকে নিন। কড়া আঁচে বসিয়ে এক টেবিল চামচ সাদা তেল গরম করে ওর মধ্যে একটা বড় পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে ভেজে, এক টেবিল চামচ আদা, রসুনকুঁচি দিয়ে ভেজে নিন। এবার ওর মধ্যে সরু লম্বা লম্বা করে কাটা বাঁধাকপি, গাজর ও ক্যাপসিকাম দিয়ে পাঁচটা কাঁচালঙ্কা কুঁচি, আন্দাজমতো নুন, এক চা চামচ ধনে, জিরের গুঁড়ো দিয়ে ভলো করে নেড়ে কষে নিন।
যতক্ষণ না জল শুকিয়ে আসছে। অল্প চিনি দিন। আন্দাজমতো গরমমশলার গুঁড়ো, ধনেপাতা কুঁচি ছড়িয়ে নেড়ে মিশিয়ে নিন। আঁচ থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করুন। ঠান্ডা হয়ে গেলে ওর সাথে চটকানো আলু হাতের সাহায্যে মিশিয়ে নিন। এবার মিশ্রণগুলো হাতের সাহায্যে চেপে ছোট ছোট কাটলেটের শেপে করে নিন। একটা পাত্রে দুই টেবিল চামচ কর্নফ্লাওয়ার ও দুই টেবিল চামচ ময়দা নিয়ে আন্দাজমতো জলে গুলে একটা গোলা তৈরি করুন। এবার কাটলেটগুলো ওই গোলায় চুবিয়ে ব্রেড ক্রাম্ব লাগিয়ে হাতের সাহায্যে চেপে কাটলেট তৈরি করে নিন। কড়া আঁচে বসিয়ে আন্দাজমতো সাদা তেল গরম করে ডুবো তেলে কাটলেটগুলো হালকা বাদামি করে ভেজে নিন। হয়ে গেলে তেল ঝরিয়ে টমেটো সস সহযোগে গরম গরম পরিবেশন করুন ।
হিন্দি ছবির বিখ্যাত নায়ক জিতেন্দ্র সাতের দশকে 'দিদার এ ইয়ার নামে' একটি ছবি প্রযোজনার কাজ শুরু করেন। জিতেন্দ্র একরাশ ছবির কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুণ এই ছবিটি তৈরি হতে প্রায় বছর চারেক সময় লাগে। এইচ এস রাওয়াল পরিচালিত ওই ছবিতে লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারিলালের সুরে কিশোর কুমার ও মহম্মদ রফি বেশ কিছু গান গেয়েছিলেন। ছবি শুরুর আগে কিছু গান রেকর্ডিং করা হয়। তখন মহম্মদ রফি গান প্রতি চার হাজার টাকা পারিশ্রমিক নিতেন।
তার বছর চারেক বাদে ছবির প্রয়োজনে জিতেন্দ্র ও ঋষি কাপুরের লিপে কিশোরকুমার ও মহম্মদ রফিকে দিয়ে আবার একটি ডুয়েট গান রেকর্ড করানো হয়। রেকর্ডিংয়ের পরে জিতেন্দ্রর প্রোডাকশন ম্যানেজার জিতেন্দ্রর কাছে জানতে চান, মহম্মদ রফিকে কত টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হবে? এবার জিতেন্দ্র চার বছর আগে রফি সাহেবকে গানের জন্য কত টাকা পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন, সেটা মনে করতে পারছিলেন না। তখন তিনি প্রোডাকশন ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করেন, কিশোর কুমারকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে ? উত্তরে প্রোডাকশন ম্যানেজার জানান, কিশোর কুমারকে কুড়ি হাজার টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে। তখন জিতেন্দ্র বলেন, রফি সাহেবকেও যেন একই পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।
সেইমতো মহম্মদ রফিকে কুড়ি হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাঠানো হয়। রফি সাহেব আর জিতেন্দ্র তখন কাছাকাছি থাকতেন। পরের দিন সকালে রফি সাহেব ওনার শ্যালক কাম সেক্রেটারিকে জিতেন্দ্রর বাড়িতে পাঠান। তিনি জিতেন্দ্রকে বলেন, মহম্মদ রফি জিতেন্দ্রর সঙ্গে কথা বলতে চান। জিতেন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন রফি সাহেবকে। রফি সাহেব জিতেন্দ্রকে বলেন, কী ব্যাপার, আমায় কুড়ি হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাঠিয়েছ কেন? উত্তরে জিতেন্দ্র জানান, কিশোরদা আর আপনাকে একই টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে। তখন হেসে রফি সাহেব বলেন, আরে, তোমার পয়সা কি বেশি হয়েছে ? আমার পারিশ্রমিক চার হাজার টাকা, আমি সেটাই নেব। বাকি টাকা আমি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। তখন রফি সাহেবের শ্যালক জিতেন্দ্রকে ষোলো হাজার টাকা ফেরত দিয়ে ফিরে যান।
ধর্ম নয়, কিন্তু ফুটবল এক সময় রেষারেষিতে পরিণত হয়েছিল বঙ্গ সমাজে | ৮০ র দশকের ঠিক আগে এই ঝগড়া শুধু কথায় নয়, মারামারিতে পরিণত হয়েছিল। যার জেরে ১৯৮০ তে দু-দলের খেলার মধ্যে ইডেন গার্ডেনে মৃত্যু হয়েছিল ১৬ জনের | বোধহয় এটাই সবচেয়ে কলঙ্কময় ১৬ অগাস্ট |
আসলে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুরা নিজেদের একটা ক্লাব থাকা উচিত মনে করে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তৈরি হয়নি। বরং অবিভক্ত বাংলায় ঘটি-বাঙাল বিভক্ত হয়েই এই ক্লাবের জন্ম ১০০ বছরের বেশি সময় আগে। কিন্তু দেশভাগের পর ওপার থেকে আসা বেশিরভাগ মানুষই ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক হয়ে যায় | অন্যদিকে আদি কলকাতার বিশিষ্ট মানুষদের সাথে এদেশীয়রা, যাদের ঘটি বলা হয়, তারা মোহনবাগান | খেলার দিন বিভিন্ন এলাকায় নিশ্চয়ই চায়ের কাপে তুফান উঠত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিষ্টিমুখ করে খেলার শেষে মিলনও হত |
কবে যে এই দুই দলের খেলার নাম ডার্বি হয়ে গেল, কে জানে | ইস্ট-মোহনের খাওয়াদাওয়াতেও কিন্তু সুক্ষ্ম ফারাক ছিল | মোহনবাগান মানেই নাকি চিংড়ি মাছ আর ইস্টবেঙ্গল মানেই ইলিশ মাছ | এটাও বেশ মজার। যদিও মোহনবাগানের ধীরেন দে ইলিশ মাছ খেতে ভালোবাসতেন। আবার ইস্টবেঙ্গলের জ্যোতিষ গুহ কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি খেতে ভালোবাসতেন |
এ বাংলার মানুষ যেমন লুচি, আলুর ছেঁচকি দিয়ে জলখাবার বা বিকেলের টিফিন সারতেন, তেমনই ওই বাংলার মানুষ জলখাবারের মধ্যে ভাতই পছন্দ করতেন | আজও উত্তরবঙ্গ কিংবা ত্রিপুরার মানুষ সকাল-বিকেল বা রাতে ভাত খেয়েই থাকেন, যা বাংলাদেশের মানুষেরও পছন্দের | কিন্তু নানান মিষ্টি খেতে বাঙালরা যেমন ঘটিবাড়িতে হানা দিতেন, তেমনই ঘটিরা সর্বদা বাঙালবাড়ির রান্না খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন | আজকাল অবশ্যই এসব নিয়ে কেউ ভাবে না। কারণ বাজারে রোল-চাউমিন কিংবা ধোসার আমদানি হয়েছে, যা বাংলার তৈরি খাদ্য নয় | ঘটিরা যেমন ঝাল খাবার ধরেছেন, তেমন বাঙালরা লঙ্কা কমিয়েছেন | এখন দুই বাঙালির মধ্যে বিবাহের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে | কিন্তু তাই বলে কি ইস্ট-মোহন নিজেদের ঐতিহ্য হারিয়েছে ? নিশ্চই না |
ভারতীয় সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তি গায়ক মান্না দে ছিলেন অত্যন্ত ভোজনরসিক। রান্নাবান্নাতেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন তিনি। সময়-সুযোগ পেলেই হাতা-খুন্তি নিয়ে নানা পদ রান্না করতে মেতে উঠতেন। খুব ভালো মাংস রান্না করতেন। নানা রকমের সুস্বাদু মাছের পদ রান্নাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। মান্না দের একটি প্রিয় পদ ছিল মাটন কিমা দিয়ে তৈরি খিচুড়ি। দুর্দান্ত রান্না করতেন এই পদটি। বন্ধুবান্ধব সহ অনেক বিখ্যাত মানুষকেই এই পদটি ও কষা মাংস রান্না করে খাইয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
এক রবিবার ছুটির দিনে মান্না দের স্ত্রী দুই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। বাড়িতে মান্না দে একা। ঠিক করলেন, জমিয়ে মাটন রান্না করে দুপুরে ভাত দিয়ে খাবেন। সেইমতো তিনি জোরকদমে রান্নার প্রস্তুতি শুরু করলেন। এমন সময় বেল বেজে উঠল। মান্না দে দরজা খুলে দেখেন, গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখেই বেজায় খুশি হলেন মান্না দে। অত্যন্ত সমাদরে পুলকবাবুকে ঘরে এনে বসালেন। পুলকবাবু দিন কয়েক হল মুম্বইতে এসেছেন। তাই রবিবার সকালে মান্না দের সাথে দেখা করতে এসেছেন। মান্না দে পুলকবাবুকে বললেন, খুব ভালো হয়েছে আপনি আজ এসেছেন। বাড়িতে কেউ নেই, তাই আমি মাংস রান্না করছি, দুপুরে দুজনে জমিয়ে খাবো। বলে মান্না দে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
পুলকবাবু সিগারেট ধরিয়ে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। কিছুক্ষণ বাদেই রান্নাঘর থেকে মাংস রান্নার সুবাস সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল। পুলকবাবুর তখন ঘ্রাণেই অর্ধভোজন হবার অবস্থা। আর থাকতে না পেরে পকেট থেকে পেন বার করে লিখতে শুরু করলেন, আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না। ইস্তানবুল হয়ে জাপান, কাবুল গিয়ে শিখেছি দারুণ এই রান্না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই লিখে ফেললেন সেই বিখ্যাত গানের কথা। রান্না শেষ করে মান্না দে ঘরে ঢুকতেই একগাল হেসে পুলকবাবু সেই লেখাটি পড়ে শোনালেন। শুনে আবেগে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জড়িয়ে ধরে মান্না দে বললেন, অসাধারণ লিখেছেন পুলকবাবু। তারপর দুই বন্ধু খেতে বসলেন। ভাত সহযোগে মান্না দের হাতের তৈরি মাটন কারি চেটেপুটে খেলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এর কিছুদিন পরে সুধীন দাশগুপ্তর সুরে এই গান রেকর্ড করলেন মান্না দে। তারপর তো ইতিহাস। আজও বাঙালিদের কাছে আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না সমান জনপ্রিয়।
ধুতি-পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরা বাঙালির সংস্কৃতিতে ছিল। কিন্তু আদৌ একে কি চিরকালীন বলা যায় ? বাংলা সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, ধুতি আদি ও অকৃত্রিম | পৌরাণিক যুগ বাদ দিলেও ইতিহাসের পাতা থেকে জানা গিয়েছে, ইসলামিক রাজ এদেশে শুরু হওয়ার আগে বাঙালি সেলাইহীন পোশাক পরতেন | তখন শীতকালে গায়ে গরম চাদর ছাড়া আর কিছুই পরার ছিল না |
ইসলামিক শাসন আসার পর সেলাই করা পাঞ্জাবি বা জামার প্রবেশ হয় | স্বাধীনতা উত্তর যুগেও ধুতি-পাঞ্জাবি বা ধুতি-শার্ট পরার সংস্কৃতি ছিল | তখনকার দিনে সিনেমার নায়করা ওই পোশাক পরতেন শতকরা ৯৫ জন | এরপর দিন পাল্টে গেলে প্যান্ট-শার্ট থেকে কোট-প্যান্ট ঢুকে গেল |
উত্তমকুমারের প্রিয় পোশাক ছিল ধুতি, গোল গলার পাঞ্জাবি একেবারে শেষদিন অবধি | স্কুলের শিক্ষকদের চিনতে গেলে ধুতি পরিহিত মানুষ দিয়ে চিনতে হত | আজ জিনসের যুগ, ধুতিপ্রিয় মানুষের বেশিরভাগ পরলোকে | আজ কলকাতা থেকে বাংলার যে কোনও শহরের দিকে তাকালে ধুতি পরা মানুষ পাওয়া যায় না, ব্যতিক্রম পুরোহিতরা | প্রশ্ন উঠেছে, ধুতি কি বিদায়ের পথে ?
আজ বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানকার প্রধানমন্ত্রী থেকে কাজে বেরনো মহিলাদের বেশিরভাগ নারী ব্যবহার করেন শাড়ি | ওপারের বাঙালিরা শাড়ির ঐতিহ্য রেখে চলেছেন | শেখ হাসিনা নাকি জানিয়েছিলেন, স্কুল বা কলেজের একটু বড় মেয়েরা শাড়ি পরেই ক্লাসে যায় | তিনি গর্ব করে শাড়ি নিয়ে বলেন, বাঙালি নারী চেনা যায় শাড়িতে | এদেশেও শাড়ির চল আছে। আজও গ্রামের মহিলারা সারা ভারতে শাড়ি পরেন |
আধুনিক শহরে অবশ্য আজকের মেয়েরা শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-স্যুট পরা শুরু করেছে | অন্য পোশাকও আছে, যথা জিন্স টপ কিংবা ছোট গাউন | এরা বলে, ট্রামে বাসে চলতে গেলে শাড়ি চলে না | সুচিত্রা সেন থেকে অপর্ণা সেনের প্রিয় পোশাক শাড়ি | আধুনিক শাড়ির দিকে ঝোঁক কিন্তু নারীর আছে। তাই বোধহয় আজকেও বিয়েবাড়ির প্রধান উপহার শাড়ি। সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ বা শাল | ধুতি বিদায় নিলেও শাড়ি থাকছে |
শীতকাল মানেই নারকেল বা ক্ষীরের পুরভর্তি গরম গরম পাটিসাপটা। প্রতি বাড়িতেই শীতকালে পাটিসাপটা তৈরি ও খাওয়ার চল বহুদিনের। তবে এখন অনেকে শারীরিক কারণে বা লোকবলের অভাবে দোকান থেকে পাটিসাপটা কিনে এনে খেয়ে থাকেন। কিন্তু আজকের দিনে মধুমেয় রোগে অনেকেই আক্রান্ত। তাই তাঁদের বাড়িতে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পাটিসাপটা তৈরি করা হয় না। কিন্তু মধুমেয় রোগীরা এবার শীতে জমিয়ে পাটিসাপটা তৈরি করে খেতে পারেন। তবে নারকেল বা ক্ষীরের পুরের পাটিসাপটা নয়, মাছের পুরভর্তি পাটিসাপটা।
এবার দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে তৈরি করবেন এই পাটিসাপটা। দুশো গ্রাম পাকা কাতলা মাছের পেটি, আন্দাজমতো নুন ও হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করুন। ঠান্ডা করে কাঁটা ও ছাল ছাড়িয়ে নিন। কড়া আঁচে বসিয়ে ৫০ গ্রাম সরষের তেল গরম করুন। ওর মধ্যে একটা মাঝারি পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে হলকা বাদামি করে ভেজে নিন। এক টেবিল চামচ আদা, রসুনবাটা দিন। ভেজে নিয়ে দু চা-চামচ শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, এক চা-চামচ হলুদ, এক চা-চামচ জিরের গুঁড়ো দিন। এবার সিদ্ধ করে কাটা ও ছাল ছাড়ানো মাছটা হাতের সাহায্যে চটকে ওর মধ্যে দিন। ভলো করে নেড়ে কষে নিন। হাফ চা-চামচ চিনি, আন্দাজমতো নুন ও এক চা-চামচ ধনেপাতা কুঁচি চড়িয়ে ভলো করে নেড়ে মিশিয়ে নিন। হয়ে গেলে নামিয়ে ঠান্ডা করুন। পুর তৈরি হয়ে গেল।
পুর তৈরি হয়ে গেলে পরের অংশ প্যানকেক তৈরির পদ্ধতি। একটি পাত্রে একশো গ্রাম ময়দা, পঁচাত্তর গ্রাম কর্নফ্লাওয়ার, দেড়খানা ডিমের গোলা, আন্দাজমতো নুন, চিনি ও জল দিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিয়ে গোলা বা ব্যাটার তৈরি করে নিন। একটা ননস্টিকি ফ্রাইংপ্যান আঁচে বসিয়ে এক টেবিল-চামচ মাখন দিন। মাখনটা ছড়িয়ে দিন। এবার এক হাতা করে গোলা বা ব্যাটার তুলে প্যানের মধ্যে দিয়ে, নিভু আঁচে মিনিট তিনেক রাখুন। হলকা বাদামি রং করে গোলাকার গোলা রুটির মতো প্যানকেক তৈরি করুন। প্যানকেকের মধ্যে রান্না করা মাছের পুর ভরে পাটিসাপটার মতো রোল করে নিন। তাওয়া আঁচে বসিয়ে দু চা-চামচ করে সাদা তেল দিয়ে গরম করে পুরভর্তি পাটিসাপটাগুলোর দুপিঠ ভাল করে সেঁকে নিন। কাসুন্দি সহযোগে পরিবেশন করুন।
বাঙালি মাত্রই চিনে খাবারের প্রতি একটা দুর্বলতা রয়েছে। প্রায়শই গিন্নি বা ছেলেমেয়েদের চাপে চিনে রেস্তোরাঁয় সপরিবারে চিনে খাবার খেতে যেতে হয় অনেককেই। তাতে রেস্ত বেশ ভালোই খরচ হয়ে যায়। রেস্তোরাঁয় খেতে না নিয়ে গেলে অনলাইনেও অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নেওয়া যায়। খরচ তাতেও কম নয়। তাই ছুটির দিনে নিজেই রেসিপি দেখে বাড়িতে চিনে খাবার রান্না করে খরচও বাঁচাতে পারবেন এবং গিন্নি ও ছেলেমেয়েদের খুশি করে হিরোও বনে যেতে পারবেন। দেখুন চেষ্টা করে। বানিয়ে ফেলুন জম্পেস হংকং চিলি চিকেন।
৩০০ গ্রাম চিকেন লেগ বোনলেস থেকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে, জলে ধুয়ে নিন। একটা পাত্রে চিকেনের খণ্ডগুলো রাখুন। ওর মধ্যে আন্দাজমতো নুন ও গোলমরিচের গুঁড়ো, এক টেবিল চামচ টমেটো কেচাপ, দেড় টেবিল চামচ শুকনো লঙ্কা বাটা, এক চা চামচ চিকেন ব্রথ পাউডার, এক চা চামচ লাইট সোয়াস, তিনটে কাঁচা লঙ্কা কুঁচি, দুই চা চামচ সাদা তেল, অর্ধেক ডিমের গোলা, এক টেবিল চামচ ময়দা, এক টেবিল চামচ এরারুট নিয়ে হাতের সাহায্যে ভালো করে মেখে নিন। এই অবস্থায় আধ ঘণ্টা রেখে দিন। কড়া আঁচে বসিয়ে আন্দাজমতো সাদা তেল গরম করে ডুবো তেলে মিশ্রণ মাখানো চিকেনের খণ্ডগুলো সোনালি রং করে ভেজে তুলে নিন। তেল ঝরিয়ে আলাদা করে রাখুন।
এবার অন্য একটি কড়া আঁচে বসিয়ে এক টেবিল চামচ সাদা তেল গরম করে দুই চা চামচ রসুন কুঁচি দিয়ে একটু ভেজে নিন। একটা বড় পেঁয়াজের স্লাইস দিয়ে নেড়ে ভাজুন। এক চা চামচ চিলি ফ্লেক্স দিন। এবার ভাজা চিকেনের খণ্ডগুলো দিয়ে আন্দাজমতো নুন ও গোলমরিচের গুঁড়ো, হাফ চা চামচ চিকেন ব্রথ পাউডার, এক চিমটে চিনি, এক চা চামচ ডার্ক সোয়া সস, এক টেবিল চামচ টমেটো কেচাপ দিন। আঁচ বাড়িয়ে ভালো করে নেড়ে মেশান। উপর থেকে এক মুঠো স্প্রিং অনিয়ন কুঁচি ছড়িয়ে নেড়ে মিশিয়ে নামিয়ে নিন। গরম গরম পরিবেশন করুন।
প্রবাসী বাঙালি হলেও মনেপ্রাণে কিশোর কুমার ছিলেন শতকরা একশো ভাগ বাঙালি । বাঙালি খাবারের প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিল। লুচি, ছোলার ডাল, বেগুন ভাজা তাঁর খুব প্রিয় ছিল । তবে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা ছিল রকমারি বাঙালি মাছের পদ আর মিষ্টির প্রতি । মা গৌরী দেবী রকমারি বাঙালি রান্না করে খাওয়াতেন । বড় বৌদি শোভা দেবীও ছিলেন কলকাতার মেয়ে। তিনি নানান রকমের মাছের পদ রান্না করে আদরের ছোট দেওরকে খাওয়াতেন।
প্রথমা স্ত্রী রুমা দেবী ছিলেন কলকাতার বাঙালি। ওনার রান্নার হাতও ছিল খুব ভালো । তিনি নানান রকমের মাছ, মাংসের বাঙালি পদ রান্না করে কিশোর কুমারকে খাওয়াতেন। ইলিশ ভাপা, ট্যাংরার ঝাল, ভেটকি সর্ষে, চিংড়ির মালাইকারি, কাতলা কালিয়া প্রভৃতি মাছের পদ ওনার খুব প্রিয় ছিল।
কলকাতায় এলে উত্তম কুমারের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকত । সুপ্রিয়া দেবী নিজের হাতে ইলিশ ভাপা, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছের ঝোল রান্না করতেন । উত্তম কুমারের পাশে মাটিতে বসে কলাপাতায় জমিয়ে খেতেন কিশোর কুমার ।