সৌমেন সুর: মৃত্যু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আত্মোপলব্ধি আত্মপ্রকাশ করেছে তাঁর সৃষ্টিতে বহুভাবে। তাঁর দীর্ঘ জীবনে অজস্র মৃত্যুর আঘাত তাঁর চিন্তায় চেতনায় ছড়িয়ে দিয়েছে গভীর নিমগ্ন ভাবকনাগুলো। যা তাঁকে দিয়ে বারবার উচ্চারণ করিয়েছে 'মৃত্যুকে লব অমৃত করিয়া তোমার চরণে ছোঁয়ায়ে।' রবীন্দ্র সাহিত্যে মৃত্যু কোথাও ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশ পায়নি। খুব সংক্ষিপ্ত কথায় মৃত্যুর ছবি আমরা পেয়েছি- এত স্বাভাবিক, গুরুত্বহীন বর্ণনা, অথচ তার অনুষঙ্গ কী গভীর এবং বেদনাময়। আবার কোথাও বা ছোট্ট একটা কথায়, একটা উপমায় বুনে দিয়েছেন গভীর আস্তরণ, যা আমাদের আবিষ্ট করে তোলে। রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের কিছু মৃত্যু দৃশ্য তুলে ধরলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
'ঘাটের কথা' ছোট গল্পে কুসুমের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ কী স্নেহকোমল করে তুলেছেন তাঁর বর্ণনায়- 'এতটুকু বেলা হইতে সে এই জলের ধারে কাটাইয়াছে, শ্রান্তির সময় এই জল যদি হাত বাড়াইয়া তাহাকে কোলে করিয়া না লইবে, তবে আর কে লইবে।' 'কঙ্কাল' গল্পে একজন নাসিসিষ্ট মেয়ে কীভাবে কঙ্কালে পরিণত হলো তার বর্ণনা। প্রেমে ব্যর্থতা এবং তার জন্য বিষ খেয়ে আত্মহত্যার কাহিনীতেও মৃত্যুকে রোমান্টিক করে তোলা হয়েছে নায়িকার অন্তিম ভাবনায়- 'ইচ্ছা ছিল যখন লোকে আসিয়া আমাকে দেখিবে তখন এই হাসিটুকু যেন রঙিন নেশার মতো আমার ঠোঁটের কাছে লাগিয়া থাকে।' (চলবে)
আজ থেকে ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বারাণসীতে 'নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের' উদ্বোধন করেছিলেন। মূলত সারা বিশ্বের বাঙালিকে এক করতে চেয়েছিলেন কবিগুরু। রবিবার কলকাতার সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো শতবর্ষ সমাপ্তির সূচনা। চলবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে তিন দিন ধরে।
রবিবারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এ যুগের সেরা বাঙালিদের এক বিরাট অংশ। অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করলেন যাঁরা তারা যথাক্রমে রাজ্যপাল ড. সিভি আনন্দ বোস এবং তাঁর পত্নী, প্রাক্তন স্পিকার মীরা কুমার, সভার অন্যতম আয়োজক সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য, বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ, সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, প্রাক্তন বিচারক ও রাজ্যপাল শ্যামল সেন, চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন প্রমুখ। কিন্তু মূল আকর্ষণ ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর এবং সৌরভ গাঙ্গুলি।
আজ যেন সেজে উঠেছিল বড়দিনে সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্চ থেকে পারঙ্গম। এই অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন সংস্থার চেয়ারম্যান সত্যম রায়চৌধুরী। উদ্বোধন হলো জাতীয় সংগীত দিয়ে এবং তার পরেই শ্লোক গীতি পরিবেশন করলেন অজয় চক্রবর্তী। এরপর উদ্বোধনী ভাষণে নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সত্যম রায়চৌধুরী জানালেন, বাংলার সাহিত্য,সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী কাজেই যা রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন আগামীতেও তা ধরে রাখতে হবে। সত্যমবাবু করোনা আবহের সময় ছাড়া প্রতি বছর বিদেশে বঙ্গ সংস্কৃতির উদ্যোগ নেন।
বক্তব্য রাখতে এসে বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ বলেন, আনন্দ বোস তাঁর একসময়ের সুহৃদ, অত্যন্ত গুণী সংস্কৃতি রুচিবান মানুষ। তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে বৈরিতা নেই। মীরা কুমার বলেন, তিনি বাংলার কোলের সন্তান। তাঁর প্রয়াত পিতা প্রাক্তন জগজীবন রাম বাংলা পড়তে ও বলতে পারতেন অনর্গল। জন্মদিনে জগজীবনবাবু মেয়েকে এক আলমারি বাংলা সাহিত্যের বই উপহার দেন। মীরাজি অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎ সাহিত্য ইত্যাদি পড়েছেন।
একটিও ইংরেজি উচ্চারণ না করে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের শর্মিলা খাঁটি বাংলায় তাঁর সাহিত্য অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। সৌরভকে এর আগে কবে বাংলায় বক্তৃতা করতে কেউ দেখেছেন কিনা শুভাপ্রসন্ন মনে করতে পারলেন না। বাংলার দাদাও ছিলেন সপ্রতিভ।
একদম শেষ বক্তা ছিলেন রাজ্যপাল। তাঁর অনর্গল সাহিত্য নিয়ে ভাষণ এবং বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্ব সাহিত্যের উপর দখল অসাধারণ। নানান উদাহরণ দিয়ে তিনি জানালেন, এটা সোনার বাংলা। আজ বাংলা যা ভাবে কাল বিশ্ব তাই নেয়। পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু চমৎকার জ্ঞানী এক রাজ্যপাল পেয়েছে। বোস বললেন, তাঁর ইচ্ছা ৫ বছরের মধ্যে তিনি যেমন নিয়মিত বই লেখেন, এবারে বাংলায় লিখবেন। একেবারে শেষে তাঁর অনুরোধ, তিনি দিতে এসেছেন, তাঁকে গ্রহণ করা হোক। অনুষ্ঠানের বিষয় যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুশি করবে বলাই বাহুল্য।
সৌমেন সুর: কবির মনে ইচ্ছা জাগে প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদলে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করার। এই ইচ্ছা প্রকাশ করেন জগদীশ চন্দ্র বসুকে চিঠি লিখে। তিনি লেখেন, 'শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীনকালে গুরুগৃহ বাসের মতো থাকবে নিয়ম। বিলাসিতার নাম গন্ধ থাকিবে না। ধনী-দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হইতে হইবে। উপযুক্ত শিক্ষক কিছুতেই খুঁজিয়া পাইতেছি না। এতদিনকার ইংরেজি বিদ্যায় আমাদের কাহাকেও তেমন কর্মযোগী করিতে পারিল না কেন? আমাদের এখানে সেরকম ত্যাগী অথচ কর্মী নেই কেন? ছেলেবেলা হইতে ব্রহ্মচর্য না শিখিলে আমরা প্রকৃত হিন্দু হইতে পারিবো না। অসংযত প্রবৃত্তি ও বিলাসিতায় আমাদিগকে ভ্রষ্ট করিতেছে। দারিদ্রকে সহজে গ্রহণ করিতে পারিতেছি না বলিয়াই সকল প্রকার দৈন্যে আমাদিগকে পরাভূত করিতেছে।'
১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর স্থাপিত হয় শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মাচর্যাশ্রম বিদ্যালয়। শিলাইদহের পাট চুকিয়ে রবীন্দ্রনাথ পরিবার নিয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্র-জায়া মৃণালিনী দেবী হলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রম জননী। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেন তিনি। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় চালাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন ঋণগ্রস্ত। পৈতৃক ব্যবসার অংশীদার হয়ে সেই ব্যবসার ক্ষতির পুরো দায়ভার তাঁর উপর বর্তায়। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী স্বামীকে ঋণমুক্ত করার জন্য তাঁর সমস্ত গয়না কবির হাতে তুলে দেন। এদিকে রবীন্দ্রনাথের অর্থ নেই। ঋণ থেকে বাঁচার জন্য পুরীর বাড়ি বিক্রি করে দিয়েও রেহাই পেলেন না।
একে একে তিনি সব বিক্রি করতে লাগলেন। তবু ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়কে যেমন করে হোক বাঁচাতেই হবে। কবি নিজের লাইব্রেরি সব বই বিক্রি করে দিলেন। এমনকি, বিয়েতে যৌতুক পাওয়া সোনার ঘড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিলেন শরৎকুমারী চৌধুরানীকে ওরফে লাহোরীনিকে। বন্ধুপত্নীকে লাহোরীনি নামটা রবীন্দ্রনাথই দিয়েছিলেন। এভাবে কবি অনেক কিছুই বিক্রি করে দিলেন বটে। কিন্তু স্বপ্নের বিদ্যালয় অবশেষে বহু কষ্ট ও পরিশ্রমের মূল্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল। বিদ্যালয়ে প্রথমে ৫ জন ছাত্র, তারপর তো ইতিহাস।
সৌমেন সুর: 'মুক্তধারা' নাটকে এক জায়গায় ধনঞ্জয় বৈরাগী প্রজাদের বলেছেন, 'তোরা আমাকে ছেড়ে চলে যা। 'প্রজারা দ্বিধান্বিত, 'আচ্ছা ঠাকুর চললুম, কিন্তু– ধনঞ্জয় চটজলদি বলে উঠলেন, 'একেবারে নিষ্কিন্তু হয়ে চলে যা। 'এখানে' কিন্তু'র সংশয়টা তৎক্ষণাৎ চলে গেল।
এই সমস্ত শব্দ অভিধানে স্থান পাক, চেয়েছিলেন অধ্যাপক শশীভূষণ দাশগুপ্ত। কিন্তু প্রকাশকরা ঝুঁকি নিতে চান নি। তাহলে অভিযান এগোবে কি করে! ভাষা এগোবে কি করে? অভিধান ভাষা শিক্ষার উপকরণ। এই কাজে মেধা, শিক্ষা, সাধনা এরাই হলো উপাদান। শুধু শব্দ সংকলন করলেই হবে না, বা অর্থ পুস্তকেই শুধু নয়- ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, লেখক, ঘরোয়া সুষ্ঠু ব্যবহার হয় না বলে দুঃখ করেছেন– তথাপি এখনো অনেকে আচার্য, ভট্টাচার্য, আশ্চর্য, না লিখে 'আচার্য্য, ভট্টাচার্য্য, আশ্চর্য্য লেখেন। চিরকাল 'হঠাৎ' লিখেছি এখন ওটা 'হঠাৎ করে' হয়ে গেল কিভাবে কে জানে? বেশিদিন চললে এরা অভিধানে ঢুকে যাবে।
রবীন্দ্রনাথ 'শব্দতত্ত্ব' গ্রন্থে ধ্বন্যাত্মক শব্দ নিয়ে গবেষণার পরিচয় দিয়েছেন। দ্রুততা বোঝাতে তিনি 'সাঁ করিয়া', 'ধা করিয়া', 'ভোঁ করিয়া'– শব্দের ধ্বনিই অর্থটাকে সঠিক বুঝিয়ে দেয়। 'তীর বেগে গেল', অর্থাৎ তীর যেভাবে দ্রুত যায়। 'গটগট করিয়া গেল'– এখানে গমনের পার্থক্যটা বোঝানো হলো। যেসব শব্দ নির্মাণ এবং অর্থসূচক ধনাত্মক শব্দ উদারণ হিসেবে পাওয়া গেল– তাতে রবীন্দ্রনাথকে কি আমরা 'বাচস্পতি' বলতে পারি না? সুনীতি চট্টোপাধ্যায় কবিকে 'বাকপতি' বলে স্বীকার করেই নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ধ্বন্যাত্মক শব্দের আলোচনা দেখে উদ্দীপ্ত হয়ে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীও ঐ ধরনের শব্দ নিয়ে একটি বিশাল গবেষণা চালিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'শব্দতত্ত্ব' গ্রন্থে 'ভাষার ইঙ্গিত' নামের একটি সুন্দর আলোচনায় দেখিয়েছেন যে কেবলমাত্র ভাষার দ্বারাই আমরা সব ভাব প্রকাশ করতে পারি না। অনেক শব্দ আছে, তারা বাস্তধ্বনি নয়, বরং কল্পনা মাত্র। যেমন দবদব করছে, টনটন করছে, কনকন করছে, রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে, ঘর গমগম করছে, ভয়ে ছমছম করছে– এই সব টুকরো টুকরো উদাহরণে ইঙ্গিতবহ ভাষাকে রবীন্দ্রনাথ চিনিয়ে দিয়েছেন। বাকপ্রতি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন– 'বঙ্গভাষা রাজভাষা নয়, উপার্জনের ভাষা নয়, ইহা শুধু মাতৃভাষা।' মাতৃভাষা ছাড়াও জীবন চলে। থাকা-খাওয়া, ভ্রমণ, ঐশ্বর্য দিয়ে ঘর সাজানো– সব হয়, কিন্তু কথা বলা, কথা শোনা, লেখালেখি, ভালবাসা এসব চলে না। চিন্তা ধ্বংস হয়। মন মরে যায়।
"সমাপ্ত"
তথ্য ঋণ/ পিনাকী ভাদুড়ী
সৌমেন সুর: কবি সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'কবিতা' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্য স্বরূপ' রচনাটি ছেপেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করে বলেছেন- লেখাটির উপসংহারে আমাদের আধুনিক কবিতার সঙ্গে 'হাড় বের করা', 'শিং ভাঙা', কাকের ঠোকর খাওয়া ক্ষতপৃষ্ট দুগ্ধহীন একটি গভীর তুলনা টেনে এনে রবীন্দ্রনাথ শেষে বাক্যটিতে বলেছিলেন যে, দৈবাৎ গরুটা যদি সুস্থ সুন্দর হয় তাহলে ভিক্টোরিয় যুগবতী অপবাদে লাঞ্ছিত হয়ে মরতে হবে সমালোচকদের কসাইখানায়।
ঠিক এভাবেই ছাপা হয়েছিল 'কবিতা' পত্রিকায়। কিন্তু কবির মৃত্যুর পরে রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশের যে কাজ চলছিল, তার মধ্যে দেখা গেল 'যুগবতী' কথাটা রূপান্তরিত হয়েছে 'যুগবতী'তে। বুদ্ধদেব বসু প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু শেষমেষ প্রতিবাদ কার্যকর হয়নি। যেহেতু প্রমাণ ছাড়া ইতিহাসে সিদ্ধ হয় না, তাই রবীন্দ্রনাথ রচিত একটা চমৎকার নতুন শব্দ স্থান পেল না বাংলা অভিধানে। রবীন্দ্রনাথের শব্দসৃষ্টির উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়, যা অভিধান প্রণেতারা গ্রহণ করেননি। কয়েকটি তুলে ধরলাম---
১) 'মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে' গানটিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে নৈরাশা গভীর অশ্রুজলে...'। এখানে নৈরাশা শব্দটি তাঁর বানানো। নিরাশায় যে আশাহীনতা, নৈরাশায় তার সঙ্গে যেন উদ্যমহীনতার ছায়া পড়েছে।
২) ওই যে শিমূল, ওই যে সজিনা, আমার বেঁধেছে ঋণে/কত যে আমার পাগলামি পাওয়া দিনে/কেটে গেছে বেলা শুধু চেয়ে থাকা মধুর মৈতালিতে... সেঁজুতি কাব্যের যাবার মুখে কবিতার এই উদ্ধৃত অংশে মৈতালি শব্দ নতুন। মিলনকে সুন্দর করা ও বর্ণনাকে মধুর করাই এর লক্ষ্য।
৩) আঁধার ঘনায় শূন্যে, নাহি জানে নাম/কী রুদ্র সন্ধানে সিন্ধু দুলিছে দুর্দাম-- এখানে দুর্দাম শব্দ কবির বানানো। দুর্দম শব্দের যেন জুড়ি এটা। এতে দুর্দামতা আছে, সেইসঙ্গে উদ্দামতা। (বাকি অংশ পরবর্তী পর্বে)
সৌমেন সুর: ১৮৭৩ সাল, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১১ বছর ৯ মাস। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সে সময় তাঁর উপনয়নের আয়োজন হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ ও নাতি সত্যপ্রসাদের উপনয়নের ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথের উপনয়নের সময় পুরোহিত ছিলেন শ্রী আনন্দচন্দ্র বেদান্ত বাগীশ এবং আচার্য ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পৈতের নিয়ম অনুসারে বিভিন্ন রকম আচার অনুষ্ঠানের পরে গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ব্রহ্মচারী 'ভবতি ভিক্ষাং মে দেহি' এই মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমেই মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজনের কাছে ভিক্ষা করে সেই ভিক্ষান্ন আচার্য গুরুকে দান করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্রহ্মচারী বাক সংযত হয়ে পরে গায়ত্রী মন্ত্র জপের পর হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন।
উপনয়নের পর গায়ত্রী মন্ত্র জপের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ মনে মনে কোনও এক অসীম শক্তির উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। এই মন্ত্র জপ করার সময় তিনি গ্রহমণ্ডলী এবং ব্রহ্মাণ্ডের বিরাট রূপকে কল্পনায় অনুভব করতেন। উপনয়নের পর তিনদিন নির্জন বাসের নিয়ম। এই তিনদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়। কারও মুখ দর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, একমাত্র মা ছাড়া। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'তিনজন তেতলার ঘরে তিন দিনের জন্য আবদ্ধ হইলাম। সে আমাদের ভারী মজা লাগিল। পরস্পরের কানের কুণ্ডল ধরিয়া টানাটানি বাঁধাইয়া দিতাম। একটা বায়া ঘরের কোণে পড়িয়াছিল, বারান্দায় দাঁড়াইয়া যখন দেখিতাম নীচের তলা দিয়া কোনও চাকর চলিয়া যাইতেছে-ধপাধপ শব্দে আওয়াজ করিতে থাকিতাম, তাহারা উপরে মুখ তুলিয়াই আমাদিগকে দেখিতে পাইয়া তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করিয়া অপরাধের আশঙ্কায় ছুটিয়া পালাইয়া যাইত।'
উপনয়ন শেষ হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ গায়ত্রী মন্ত্র আবৃত্তি এবং তাঁর অন্তরের উপলব্ধির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, আবৃত্তির সময় তাঁর চোখ বেয়ে জল পড়ত। কেন পড়ত সেটা বুঝতে পারতেন না। আসল কথা, অন্তরের অন্তঃপুরে যে কাজ চলছে, বুদ্ধির ক্ষেত্রে সব সময় তাঁর খবর এসে পৌছয় না। পরবর্তী জীবনে রবীন্দ্রনাথের নিজের ক্ষেত্রেও এই মুল্যবান তথ্যটি ভীষণভাবে প্রযোজ্য। তিনি জীবন স্মৃতিতে লিখেছেন, 'শান্তিনিকেতনে এসেই আমার জীবনে প্রথম সম্পূর্ণ ছাড়া পেয়েছি বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে। উপনয়নের পরেই আমি এখানে এসেছি, এখানে বিশ্বদেবতার কাছ থেকে পেলাম সেই দীক্ষা।'
আপাতত স্থগিত থাকবে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (RBU) বা আরবিইউ-র জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসের হেরিটেজ ভবন ভাঙার কাজ। সোমবার রাজ্যকে এই নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট (Calcutta High Court)। এই নির্দেশের পরেও যদি ভাঙার কাজ হয়, তাহলে জবাবদিহি রাজ্যকেই করতে হবে। এমন অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে আদালতের (Calcutta High Court) প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ। সোমবার বেঞ্চের নির্দেশ, রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থানে এখনই সব নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হবে। এ নিয়ে রাজ্যকে হলফনামার আকারে রিপোর্টও জমা দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে অভিযোগ ওঠে, জোড়াসাঁকোয় হেরিটেজ স্বীকৃতি পাওয়া ভবনের অব্যবহৃত ঘর ভেঙে নির্মাণকাজ চলছে। কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হয় জনস্বার্থ মামলা। মামলাকারীর তরফে অভিযোগ, 'জোড়াসাঁকো ভবন গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ। সেই ভবনেরই দু’টি ঘর ভেঙে ফেলা হচ্ছে।'
মামলাকারীর আরও দাবি, জোড়াসাঁকোর বাড়ির যে ঘরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম সাক্ষাৎ হয়, সেখানে শাসক দল তৃণমূলের ‘শিক্ষাবন্ধু সমিতি’ নামে এক সংগঠনের কার্যালয় তৈরি হয়েছে। কবিগুরুর ছবি খুলে তৃণমূলনেত্রীর ছবি টাঙানো হয়েছে। জানা গিয়েছে, এই মামলার পরবর্তী শুনানি ২১ নভেম্বর।
সৌমেন সুর: রবীন্দ্রনাথ ক্ষণজন্মা পুরুষ। এমন প্রতিভাবান পৃথিবীতে খুব কম দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করে না, এমন মানুষ বিরল। তাই এই মানুষ যদি রোগে ভোগে, তাহলে কার না কষ্ট হয় বলুন। তিনি নিজেই একজন প্যারালাল ডাক্তারের মতো ছিলেন। হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ওষুধকে তিনি বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করতেন। ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি তাঁর মূত্রাশয়ে সমস্যা শুরু হয়। প্রস্রাবে জ্বালা, প্রস্রাব কমে আসার মতো উপসর্গ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ দু'জন চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়।
একজন ডাক্তার নীলরতন সরকার, অপরজন বিধানচন্দ্র রায়। সেই সময় সিটি স্ক্যান, ইউএসজি-র মতো আধুনিক রোগ নির্ণয় পরীক্ষা আবিষ্কার হয়নি। কিছুটা অনুমানের উপর ভিত্তি করে কবিগুরু চিকিৎসা শুরু করেন এই দুই নামজাদা চিকিৎসক। ডাক্তার নীলরতন সরকার গুরুদেবকে দেখে বলেন, এই রোগীর অপারেশন করা ঠিক হবে না। অপারেশন না করলে গুরুদেব অনেকদিন বাঁচতে পারেন। কিন্তু বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন নাছোড়বান্দা তিনি আবার অপারেশনের পক্ষে। ডাক্তার সরকার রাগে, ক্ষভে এক বুক অভিমান নিয়ে চলে যান ঠাকুরবাড়ি থেকে।
গুরুদেবের প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়ায় কবিগুরুর মূত্রাশয়ে মূত্র থেকে যাচ্ছে। যার ফলে ইউরোমিয়া দেখা দিচ্ছে। অতএব অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিন জন ডাক্তার। রবীন্দ্রনাথের কোনও মানা শুনলেন না। বাড়ির সদস্যরাও অপারেশনে রাজি। অতঃপর শুরু হল ক্রিয়াকলাপ। অপারেশন টেবিল থেকে অপারেশনের পর ওকে খাটে শোয়ানো হল। এরপর তিন দিন যাওয়ার পর এল অভিশপ্ত ৭ অগাস্ট। কবি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করলেন। দেহ অদৃশ্য হল বটে কিন্তু আত্মা পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেল। বাংলার মানুষ আজও কবিকে বুকে আঁকড়ে রয়েছেন। সঙ্গে নিয়ে আছে বিশ্ব কবির অজস্র সৃষ্টিধর্মী কাজকে।
সৌমেন সুর: জাতীয় সঙ্গীত সব মানুষের অন্তরের মুখের ভাষা, বুকের আশা। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয় সঙ্গীত, জাতিকে দিয়েছে আত্মত্যাগের মহিমা। জাতীয় সঙ্গীতে জাতির স্বদেশপ্রীতি, ভাবাদর্শ, আত্মত্যাগ, স্বপ্নসাধনা মূর্ত হয়ে ওঠে।
প্রথম জাতীয় সঙ্গীত বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে। সেখানে সন্তান দল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। মাতৃবন্দনার মহামন্ত্রে উচ্চারিত হল 'বন্দেমাতরম।' ১৮৯৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ওই মাতৃবন্দনাকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করে। আসলে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে জাতির আত্মপ্রকাশের বীজ প্রকট হয়ে ওঠে। এই মাতৃমন্ত্র উচ্চারণ করে কত মুক্তিযোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জাতীয় সঙ্গীতের গভীরতায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ হয়ে ওঠে সোচ্চার। কোনও শক্তি আত্মত্যাগী স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষকে রোধ করতে পারে না।
স্বাধীনতার পর জাতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত হয়। বলা হয়, 'বন্দে মাতরম' সঙ্গীতটি অত্যন্ত দীর্ঘ এবং সুরসৃষ্টিতে অসুবিধা। তাই এর একটি স্তবকে হয় জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি দান। তবে ১৯৫০ সালের ২০ জানুয়ারি 'জনগণমন' সঙ্গীতের প্রথম অংশ জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি পায়। স্রষ্টা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রত্যেক রাষ্ট্র এবং জাতির থাকে জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় সঙ্গীত তাঁর মর্যাদা এবং অহঙ্কার। জাতীয় সঙ্গীতের অপমান মানে গোটা জাতির অপমান। জাতীয় সঙ্গীতের অমর্যাদা আমাদের কলঙ্ক। বুঝতে হবে মানুষের আত্মদানের মধ্যে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। জাতীয় সঙ্গীত আমাদের প্রাণ, আমাদের বিবেক।
সৌমেন সুরঃ বিজয়ার বিষাদের মধ্যে কোথায় যেন সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র লুকিয়ে থাকে। এই ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রত্যক্ষ সংস্কৃতি কম দেখা গেলেও, অভিজাত, সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারগুলোতে আজও বিজয়ার মিলনক্ষেত্র বিরাজমান।
'বিজয়া' প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির কথা ফুটে উঠলো মনে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শুধু তাঁর প্রিয়জনদের বিজয়ার আশীর্বাদ জানাতেন না। বিজয়ার দিন কেউ তাঁকে আশ্রমে প্রণাম করতে এলে, চিরাচরিত হিন্দু প্রথা অনুযায়ী তিনি মিষ্টিমুখ করাতেন। তিনি ব্রাক্ষ্ম ছিলেন। তবে সংস্কারে কবি ছিলেন ঊর্ধ্বে।
একটা চিঠিতে নির্মলকুমারী মহলানবীশকে লিখেছিলেন-'বিজয়ার বার্ষিক প্রণাম এখনও তোমার কাছ থেকে দাবি করতে পারি।' রবীন্দ্রনাথ শুধু বিজয়ার বার্ষিক প্রণাম দাবি করতেন না, সেই প্রণামের বিনিময়ে তাঁর প্রিয়জনদের জানাতেন তাঁর আন্তরিক আশীর্বাদ।
আসলে রবীন্দ্রনাথ চিরকালই উপলব্ধি করেছেন বিষাদের মধ্যে আনন্দকে। বিসর্জনের মধ্যে আবাহনকে। তাই তিনি বিজয়ার আশীর্বাদের মধ্যে আস্বাদ পেয়েছেন পবিত্রতার, পূর্ণতার এবং প্রণামের। সেই মনিমানিক্যের মধ্যে উপলব্ধির কথা আমরা জানতে পারি রানী চন্দের লেখা একটি বই থেকে। ভালবাসার পাত্রীকে বিজয়ার দিনে কবি একটি নিজের আঁকা ছবি উপহার দেন। রানী পরম স্নেহে প্রণাম করে সেই ছবি গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই ছিল আংশিক বিজয়ার ছবি।
তথ্যঋণ- স্বপন বক্সী