সৌমেন সুর: (দেবী দুর্গা সম্পর্কীয় ধারাবাহিক আলোচনা) আকাশের মেঘ আর রোদের খেলা দেখে, চোখ বুজে বলতে পারা যায় দুর্গাপুজো আসন্ন। এখন বেশকিছু মাঠের কিনারে সাদা কাশফুলের দোলা আর শিউলি ফুলের উল্লাস দেখে মনে হয়- মা আসছেন। মা অর্থাৎ দুর্গা মা। কোনো কোনো বাঙালির ঘরে কন্যা উমা মর্তে আসছেন। মায়ের কাছে কটা দিন মেয়ে আসছে তার পুত্রকন্যা নিয়ে। এই আনন্দে সারা বাংলায় সাজো সাজো রব।
দুর্গাপুজো মূলত শাক্ত পুজো। শক্তির আরাধনাই এখানে মূল বিষয়। রক্তের মাধ্যমে অশুভ অসুর শক্তি বিনাশ করে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। সুতরাং দুর্গাপুজো বা যে কোন শক্তির আরাধনায় পশুগুলি জড়িয়ে আছে রক্তপাতের মাধ্যমে শুভ শক্তির জয় আর অশুভ শক্তির পরাজয়। দুর্গাপূজোই পশু বলি নিয়ে নানা ঘটনার উল্লেখ আছে। মার্কেন্ডেয় পুরাণ-এর দেবী মাহাত্ম্য নিয়ে প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ও লোকশিল্পের গবেষক মোহিত রায় তাঁর 'রূপে রূপে দুর্গা' নামক বইটিতে লিখেছেন বোলপুরের আদি ইতিহাস। এক সময় রাজা সুরথ তাঁর রাজধানীর সুপুরে এক লক্ষ বলি দিয়ে দেবীকে পুজো দিয়েছিলেন। এক লক্ষ বলির পর তার রাজধানীর নাম বদলে হয় বলিপুর। কালক্রমের সেই বলিপুর হয়ে উঠল বোলপুর নামে।
খোদ কলকাতাতেই আছে ৪০০ বছরের পুরনো চিত্তেশ্বরী মন্দির। চিতপুরের চিতে ডাকাত এই মাকে পুজো করতেন। সুতরাং বলা যায় ডাকাত কালীর মতো ডাকাতের দুর্গাপুজোয় বলিদান নিত্য ঘটনা। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালনের জন্য বসন্তকালের দুর্গাপুজো শরৎকালে নিয়ে এসে নবপত্রিকা পুজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই কাজ করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র ও কলকাতার নবকৃষ্ণ দেব। এদের উৎসাহিত করেছিলেন লর্ড ক্লাইভ। প্রমাণ হচ্ছে সপারিষদ ক্লাইভের উপস্থিতি ও একশো এক টাকা দক্ষিনা ও ঝুড়ি ঝুড়ি ফলদান। তিনি নব কৃষ্ণের বাড়িতে পশুবলি সহ পুজো দিয়েছিলেন শোনা যায়।
বর্তমানে বিভিন্ন বারোয়ারি এবং অধিকাংশ রাজবাড়িতে পশুবলি না হয়ে সন্ধিপুজোয় আঁখ, চালকুমড়ো, শশা প্রভৃতি বলিদান প্রথায় অনুষঙ্গ হিসাবে বলি দেওয়া হয়ে থাকে। শাক্ত পুরুষ মাতৃভক্ত রামপ্রসাদ সেনের এই গানটি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক- " মেষ, ছাগ, মহিষাদি কাজ কিরে তোর বলিদানে/ তুই জয় কালী জয় কালী বলে বলি দাও ষড়রিপুগনে।" অবলা পশুদের হত্যা করে পুজো- মা কখনই তা চায় না। আসুন, আসন্ন দুর্গাপূজায় শপথ করি প্রাণী হত্যা করে পুজো আমরা কখনোই দেব না। এই প্রথায় আমরা ঘোরবিরোধী। তথ্য সংকেত- সুমিত তালুকদার
সৌমেন সুর: এমন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনায় নেমেছি- এক একসময় মনে হয় আমি কোন জগতে বাস করছি! সামান্য নিম্নবর্ণের মানুষ নদীতে স্নান করেছে বলে সেই নদীর জল অপবিত্র হয়ে গেছে। তাই তাকে উচ্চবর্ণের মানুষ অমানুষিকভাবে বাঁশপেটা করলো। বাঁশ নিয়ে যত শক্তি আছে শরীরে সেটা প্রয়োগ করা হলো। এটা সভ্যজগতের কাজ? আমরা বড়াই করি-সভ্যজগতে বাস করি, আমরা সভ্য। আসলে আমরা এখনো অসভ্য। কারণ আমরা এখনো দাঙ্গা লাগাই, দাঙ্গাই অংশ নিই। কুসংস্কারের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি, নিষ্পাপ শিশু কিশোরকে ধর্ষণ করি বর্বরোচিতভাবে। অদ্ভুদ এক সমাজে বাস করছি। এরপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। বিষয়-জাতিভেদ।
কোনো শিশু জন্মাবার সময় কোনো প্রতীকচিহ্ন নিয়ে জন্মায় না। কারণ সব মানুষই একটি জাতি। তাহলে দাঁড়াচ্ছে বিশ্বমানব এক জাতি। মানুষ মাত্রই এক জাতি, এই ধারণা জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা বিভাজনের খেলায় মেতে সমাজে অসংখ্য জাতির প্রাচীর তুলে দিয়েছি। ঋগবেদের যুগে জাতিভেদ বলে কিছুই ছিল না। পরবর্তীতে জাতি হয়ে ওঠে জন্মসূত্রে অর্জিত সামাজিক স্তর। অধ্যাপক ব্যাসামের মতে, ষোড়শ শতকে পোর্তুগীজরা হিন্দুদের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে উপজাতিতে চিহ্নিত করে। সেই সময় থেকে 'Caste' শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কুসংস্কার মানুষের মনের জমিতে এমন গভীরে শিকড় চালিয়ে দেয়েছে যে, আজও জাতপাতের ভিত্তিতে সামাজিক অবিচার, অনিয়ম। কবি নজরুল একে 'জাতের নামে বজ্জাতি সব' বলে তীব্র কটাক্ষ করেছেন। মানুষের কুসংস্কারকে আরও প্রশয় দিয়েছে ব্রিটিশ শাসক। কারণ এটা জিইয়ে থাকলে ওদের দিকে তাকাবার সময় থাকবে না। এদিকে মানুষের মুখটাকেও ঘুরিয়ে দেওয়া গেল। কালের চক্রে এটাই চলছে বর্তমানে। বর্তমানে রাজনীতির মধ্যে জাতিভেদের চিন্তাভাবনা প্রবেশ করায় সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। স্বাধীনোত্তর যুগে জাতপাত নিয়ে কতবার যে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। রাজনীতি থেকে জাতপাতের ভাবনাকে বিসর্জন না দিলে, জাতির সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।
সৌমেন সুর: ঝড়ের গতিতে ভ্যান চলে আসে সুকুমার ব্যানার্জীর বাড়ি। কিশোর বলে, 'দিদি, ওই যে সুকুমার কাকুর বাড়ি।' নন্দিনী ভ্যান থেকে নেমে বলে, 'ভাই কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো সে ভাষা আমার নেই। যাক, তোমার কথা দেব বলো!' 'বেশি দিতে হবে না দিদি, ৫০ টাকা দিন।' নন্দিনী টাকাটা বের করে ওর হাতে দিতেই চমকে ওঠে। কিশোরের হাত বরফের মত ঠান্ডা। কিছু বোঝার আগেই ভ্যান চালিয়ে চলে যায় কিশোর। নন্দিনী ঠিক না, মনের ভুল এসব ভাবতে ভাবতে সুকুমারদার বাড়ি চলে আসে। গেটের হ্যাজবোল্ড নাড়াতেই সুকুমার বলে ওঠেন, ' এসো এসো নন্দিনী, এসো। নন্দিনী ঘরে ঢোকে। একটা চেয়ারে বসে। পথে তোমার একটু কষ্ট হল। 'প্যান্টোগ্রাফ ভেঙেছে বলে কিশোরকে বলে রেখেছিলাম, তোমাকে রিসিভ করবার জন্য।' ' ধন্যবাদ সুকুমার দা।' 'যাক স্ক্রিপ্টটা এনেছো?' ' হ্যাঁ এনেছি, এই নিন।' নন্দিনী সুকুমারদা কে দেয়। সুকুমারবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে বলেন, ' আলোচনা করবার আগে তোমার ভাবনাটাকে আমি পরিষ্কার করে দিই। তুমি কলেজে জিজ্ঞাসা করেছিলে, আমি গ্রামে থাকি কেন।' 'দেখ নন্দিনী, প্রথম দিকে আমি কলকাতাতেই থাকতাম। কিন্তু পরে শুনি, আমার অনেকটাই বাস্তু জমি রাজনৈতিক দল হড়প করে নেয়। খবর দেয় আমার জমির কেয়ারটেকার কিশোর আর তার দিদি। একদিন আমি পুলিশ নিয়ে এসে ওই রাজনৈতিক দলের দুজনকে ধরি। এরপর একদিন সন্ধ্যায় আমরা মানে, কিশোর, ওর দিদি আর আমি বেশ মজা করে মুড়ি তেলেভাজা খাচ্ছিলাম, এমন সময় রাজনৈতিক দলের গুন্ডারা হঠাৎই উপস্থিত হয়। কিশোরের দিদি। ' দাঁড়ান সুকুমার কাকু, বাকিটা, আমাকে বলতে দিন।' নন্দিনী খুলে তাকায়, কিশোরের দিকে ভালো করে দেখে। মেয়েটি কথা বলতে বলতে দুই পা এগিয়ে আসে। ' ওই গুন্ডারা প্রথমে সুকুমার কাকুর ঘর বাড়ি ভাঙচুর করে। তারপর আমাদের সবাইকে খুন করে।' নন্দিনী ঘরে তাকাতেই দেখে সুকুমার ব্যানার্জি অদৃশ্য। চকিতে অন্যদিকে ঘুরে তাকায়, দেখে মেয়েটি অদৃশ্য। নন্দিনী কি করবে ভেবে পায় না। ঘামতে থাকে। কাঁপতে থাকে সারা শরীর। নন্দিনী অজ্ঞান হয়ে যায়। (সমাপ্ত)
সৌমেন সুর: কিশোর আপনমনে ভ্যান চালাতে থাকে। নন্দিনী ভয়ে কিশোরকে জিজ্ঞাসা করে, 'এত জোরে ভ্যান চালাচ্ছ কেন, আস্তে চালাও না?' কিশোর উত্তর দেয়, 'দিদি, আমার জন্য আমার দিদি একটা গাছের তলায় অপেক্ষা করছে- তাই জোরে চালাচ্ছি। ভয় নেই আপনি পড়বেন না।' নন্দিনী আর কথা বলে না। সুকুমার দার কথা ভাবে। এত গুণী মানুষ, এত বড় একজন লেখক, সে কেন এই গ্রামে পড়ে আছে! আবার কলেজের লেকচারার। এখান থেকেই নন্দিনীর সাথে আলাপ। নন্দিনীর মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন সুকুমার ব্যানার্জি। ভবিষ্যতে নন্দিনী একজন ভালো প্রবন্ধকার হতে পারবে।
আজ নন্দিনী চলেছে নতুন একটা লেখা নিয়ে। সুকুমার বাবুই ওকে আসতে বলেছিলেন। আসতে গিয়ে যত বিপত্তি। সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ভ্যানটা থামে। নন্দিনী অবাক হয়ে বলে, 'ভ্যান থামালে কেন!' 'দিদি ওই গাছটার নিচে আমার দিদি অপেক্ষা করছে। আমি যাব আর আসবো।' কথা বলে কিশোর দৌড়ে চলে যায়। চারদিক নিকষ অন্ধকার। শুধু জোনাকির মিটমিটে আলো। দূরে কোথাও কুকুর ডেকে ওঠে। ভেসে উঠছে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার কান্না। রাত কত হল কে জানে। নন্দিনী ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে।
'শালাদের দেখা পেয়েছিস'- কিশোরের দিদি উত্তেজিত হয়ে বলে। কিশোর দিদিকে বলে, ' না দিদি। লাস্ট ট্রেনের একজন প্যাসেঞ্জার নামে। যে আমার গাড়িতে আছে।' 'কোথায় যাবে?' 'সুকুমারদার বাড়ি।' 'তাই! যা, ওনাকে নামিয়ে দিয়ে আয়।' কিশোর চলে আসে ভ্যানে। 'দিদি ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দিচ্ছি। টেনশন করবেন না।'
সৌমেন সুর: রাতে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ট্রেনটা নিঝুমপুর স্টেশনে থামে। প্লাটফর্ম ফাঁকা। কোনো মানুষজন নেই। ট্রেন থেকে নন্দিনী নামে। হাত ঘড়ির দিকে তাকায় নন্দিনী। রাত প্রায় দেড়টা। চারিদিক শুনশান। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। নন্দিনীর একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। একা মেয়ে মানুষ। এই নির্জন স্টেশনে কোন মানুষের দেখা নেই। কিভাবে গন্তব্যস্থানে পৌঁছাবে! মোবাইলটা বার করে। তারপরেই চমকে ওঠে। নেট নেই। একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে মোবাইলটা রেখে দেয়। নন্দিনী নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। নিঝুমপুরে আরো তিন ঘন্টা আগে আসতে পারতো যদি না প্যানটোগ্রাফ ভেঙে পড়তো। ওটা সারাতেই তিন ঘন্টা চলে গেল। তারপর যে ট্রেনটা ছেড়েছে এটা ঠাকুরের অসীম কৃপা। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নন্দিনী আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে। একটা রিক্সা বা ভ্যান কিছুই চোখে পড়ছে না।
এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল নন্দিনী। সুকুমারদা বলেছিলেন, সব ঠিকঠাক পেয়ে যাবে। কোথায় ঠিকঠাক! তবে সুকুমার দা'র দোষ কোথায়। বাদ সাধলো তো প্যানটোগ্রাফ ভেঙ্গে। এইসব ভাবতে ভাবতে নন্দিনী লাইন পেরিয়ে রাস্তায় নামে। পিছন থেকে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে একটা গলা ভেসে ওঠে, 'দিদিভাই, কোথায় যাবেন?' চকিতে এদিক ওদিক তাকায় নন্দিনী। একটা ভ্যান ভেঁপু বাজিয়ে কাছে আসে। নন্দিনী ভ্যানচালকের পা থেকে মাথা অব্দি দেখে। পরক্ষণে ভ্যানচালক বলে, 'কোথায় যাবেন?' নন্দিনী কোনরকম ভণিতা না করে বলে, 'ঘোষপুর যাব।' 'ঘোষপুর কার বাড়িতে যাবেন?' 'সুকুমার ব্যানার্জীর বাড়ি।' 'ও, সুকুমার কাকুর বাড়ি যাবেন-বসুন বসুন। আপনাকে ওনার বাড়ি দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছি। বসুন' নন্দিনী আর কোনো কথা না বলে ভ্যানে উঠে পড়ে।
ভ্যান চলতে থাকে। চলতে চলতে কথাবার্তা বিনিময় হতে থাকে। অন্ধকার রাস্তা। চোখে কিছু ঠাওর করতে পারেনা নন্দিনী। অথচ কি দ্রুত ভ্যান চালাচ্ছে যুবক ছেলেটি। নন্দিনী একসময় বলে ওঠে, 'তুমি এত তাড়াতাড়ি ভ্যান চালিও না। অন্ধকার রাস্তা। পড়ে যাব।' ভ্যান চালকটি হাসিমুখে জবাব দেয়, 'কিছু চিন্তা করবেন না দিদি, এ রাস্তা আমার খুব চেনা। ' এমন সময় দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে ওঠে। নন্দিনী চমকে ওঠে। ভ্যান চলতে থাকে আপন মনে। নন্দিনী জিজ্ঞাসা করে, 'তোমার নাম কি ভাই?' 'আজ্ঞে কিশোর দাস।' 'আচ্ছা কিশোর, তুমি এত রাতে ভ্যান চালাও কেন? বাড়িতে রেস্ট নিতে পারো না?' হাসিমুখে কিশোর বলে, 'দিদি রাতে ভ্যান চালালে লাভ আছে। প্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে ডবল ভাড়া পাওয়া যায়।' 'তাই বুঝি, যাক আর কতদূর কিশোর!' 'দিদি, ঠিক ১০ মিনিটের মধ্যে কাকুর বাড়ি চলে আসবো।'
হঠাৎ ভ্যানের গতি বেড়ে যায় নন্দিনী শক্ত করে ভ্যানটা ধরে অবাক হয়ে তাকায় কিশোরের দিকে। ( চলবে)
সৌমেন সুর: ছুটির মধ্যে কোন কাজের তাড়া থাকেনা। সেখানে থাকে না কোনো আজ্ঞাপালনের নির্দেশ। থাকে না একঘেয়েমি, থাকে না ক্লান্তি। ছুটি মানুষের কাছে মহৎ প্রাপ্তি। ছুটির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একরাশ আনন্দ। ছুটি মানুষের চোখে পরিয়ে দেয় অনিন্দ্য সুন্দর মায়া কাজল। ছুটি তার অভ্যস্ত জীবন থেকে নিয়ে যায় সুন্দরের জগতে। ছুটির মধ্যেই রয়েছে জীবনের বিচিত্র লীলারঙ্গ। নতুন নতুন সৃষ্টি সুখের উল্লাস। কথা হলো, অবকাশ যাপনের রসিকরা জানে, অবকাশের মাহাত্ম্য কেমন, গতি কেমন। একটানা কাজের মধ্যে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে, অবসাদ তাকে ঘিরে ধরে, নিরানন্দে তার মন বিষাদে ভরে ওঠে, তখন ছুটিই তাকে দিতে পারে একমাত্র স্বস্তি।
ছুটি শব্দের মধ্যে রয়েছে এক গভীর দার্শনিক তাৎপর্য। একটানা কাজের মধ্যে হঠাৎ আলোর এক উদ্দাম ঝলকানি। এই ঝলকানির আলোয় যখন আলোকিত হয় মন, তখন অনুভব করা যায় ছুটির আনন্দে, ডুবে যায় সানন্দে। ছুটি শুধু জীবনের ছুটি নয়, জীবনের মধ্যে ছুটি। ছুটিই মানুষকে নতুন করে কাজের উৎসাহ দেয়। তার মধ্যে ফুটে ওঠে কাজ করবার এক যোজন উদ্দীপনা। কাজের পাহাড়ে যখন মানুষের উঠে আসে নাভিশ্বাস, তখন ছুটির হাতছানি তাকে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মানুষ বিচিত্র। বিচিত্র তার মন, তার রুচি। এই রুচি বৈচিত্র্যই ছুটিতে বৈচিত্র্যময় করে তোলে। কারন সে মুক্ত। এক মুক্ত বিহঙ্গ।
কর্মের ফাঁকে ফাঁকে ছুটি পাওয়ার মধ্যে আছে গভীর আনন্দ। বর্তমানে রাজনৈতিক ডামাডোলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে আসছে- এই চরম হিংসা পরিস্থিতি থেকে নিজেকে আনন্দে দূরে সরিয়ে রাখতে, একমাত্র ছুটিই মানুষকে দিতে পারে এক অনাবিল আনন্দ। আসলে ছুটির মজাই আলাদা।
সৌমেন সুর: জলের আরেক নাম জীবন। তাই জলের জন্য যদি জীবন বিপর্যস্ত হয় তাহলে দায়ী আমরাই। আমাদের অসচেতনতা। কারণ অনেক সময় আমরা অযথা জল নষ্ট করি। জল যে আমাদের জীবনে কত বড় বন্ধু, তা মাঝেমাঝে সেটা আমরা ভুলে যাই। সমগ্র মানবকূলকে জলের প্রয়োজনে বাঁচতে প্রথমে চাই গণ-সচেতনতা। জল কোনোভাবেই নষ্ট করা চলবে না। আমাদের এই বিষয়ে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় রাস্তাঘাটে দেখা যায়, কল থেকে জল নির্গত হয়ে চলেছে অনর্গল, অথচ কেউ একজন এগিয়ে এসে কলটা বন্ধ করে দিচ্ছে নানা- এটা সম্পূর্ণভাবে মানব মনের অসচেতনতা। শুধু রাস্তাঘাট নয়, বাড়ির কলের ব্যাপারেও আমাদের জাগ্রত থাকতে হবে। জলের ব্যাপারে যেভাবে ভূগর্ভস্থ থেকে জল তোলা হচ্ছে তাতে একদিন না একদিন হয়তো দেশবাসীকে ওয়াটার ক্রাইসিসে ভুগতে হতে পারে। তাই এখন থেকে যদি আমরা সচেতন হই জল আমরা অযথা নষ্ট হতে দেব নানা, এই ভাবনা নিয়ে এখন থেকেই এগোতে হবে।
মানুষ যেসব রোগে আক্রান্ত হয়- তার অনেকগুলি জলবাহিত। সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- আমাশয়, কলেরা, জন্ডিস, চর্মরোগ। ইদানিং কোন কোন অঞ্চলে আর্সেনিক পরিমাণ মাত্রারিক্ত হওয়ার ফলে ভয়ংকর রোগ দেখা দেয়। এইগুলি আমাদের ভালোভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে। এসবের জন্য প্রয়োজন নাগরিক কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া। ২০০০ সাল থেকে রাষ্ট্রসংঘ W. H. O মাঝেমধ্যেই বিশুদ্ধ পরিশ্রুত জলের অভাব মেটাতে গড়ে উঠেছে এক নতুন শিল্প। জল শিল্প। কিছু সংস্থা বোতলে মিনারেল ওয়াটার তৈরি করে বাজারে ছেড়েছে। ১ লিটার মিনারেল ওয়াটার, এক লিটার দুধের দামের মধ্যে সামান্য পার্থক্য। তবে এইসব সংস্থার দাবি মতো, ওই পানীয় জল কতটা বিশুদ্ধ সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
প্রাত্যহিক জীবনে একটা দিন অনাহারে কাটানো যায়, কিন্তু জল ছাড়া একটা দিন ভাবা যায় না। সভ্যতার অগ্রগতি একটার পর একটা প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে। এবার জলের পালা। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, সমস্ত প্রাণীকুলকে বাঁচাতে জল যেন আমরা সংরক্ষণ করে রাখতে পারি। তেড়ে গণ আন্দোলন করা উচিত। আগামী দিনে জল অপচয় যেন আমরা না করি। অপচয় করলে একদিন না একদিন আমাদের বিশাল বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।
আদাহ শর্মা (Adah Sharma) নাম বলতেই মাথায় আসে, 'দ্য কেরালা স্টোরি' (The Kerala Story) সিনেমার কথা। আর এই ছবির টিজার শুরুর থেকেই শুরু হয়েছিল বিতর্ক-সমালোচনা। তবে এই বিতর্ককে সঙ্গী করেই বক্স অফিসে দারুণ সাড়া ফেলেছিল এই ছবি। প্রায় ৩০০ কোটির মতো ব্যবসা করেছে ছবিটি। এই ছবিতেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আদাহ শর্মা। বহু বছর পর সিনেমার পর্দায় তাঁকে দেখা গেলেও তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। আর এই ছবির পর থেকে তাঁর ভক্তও হয় অগুনতি। কিন্তু এবারে আদাহ শর্মার জন্যই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন তাঁরা। জানা গিয়েছে, আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আদাহ, কী হয়েছে তাঁর, কেমন আছেন তিনি, একাধিক প্রশ্ন তাঁর অনুরাগীদের মনে।
সূত্রের খবর, বুধবার সকাল থেকেই আদাহর শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। গতকাল সকাল থেকেই তাঁর বমি শুরু হয়। এরপরই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। জানা গিয়েছে, ডায়রিয়ায় ভুগছেন তিনি, এর পাশাপাশি ফুড অ্যালার্জিও হয়েছে তাঁর। বর্তমানে তিনি ব্যস্ত তাঁর আসন্ন ছবি 'কমান্ডো'-র প্রোমোশনের জন্য। সেই ছবির প্রোমোশনের মাঝেই হঠাৎ তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায় বলে খবর। আর এই কারণেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁকে এখন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তবে কীভাবে এই ফুড অ্যালার্জি, তার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
সৌমেন সুর: দেশপ্রেমের মূল কথা হল দেশকে ভালোবাসা। দেশপ্রেম মানুষের এক মহৎ উত্তরাধিকার। দেশপ্রেম, মানুষের আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে, পরার্থে জীবন দানে প্রেরণা দেয়। বর্তমানে দেশপ্রেম নিয়ে নানা কানাঘুষো শুনি, আসলে যে মানুষটি সত্যি সত্যি দেশপ্রেমে উদার হবে তাকে সর্বপ্রথমে ত্যাগী হতে হবে। সম্পূর্ণ নির্লোভী মানুষ হতে হবে, সংযমী হতে হবে। আহারে, পোশাকে, বাসস্থানে ও ব্যবহার্য জিনিসে, একটা অদ্ভুত অনিহা থাকবে। সর্বসময় তার মনে গুঞ্জরিত হবে দেশের মানুষ কিভাবে শান্তিতে থাকবে, সুখে থাকবে, তার চিন্তাতেই মগ্ন থাকবে তার মন। দেশপ্রেমী মানুষের মনে পরিশুদ্ধ ভাবাবেগের স্রোত প্রবাহিত হবে। এক গভীর আত্মসম্ভ্রম বোধই জন্ম নেয় দেশপ্রেমের। এই বিষয়ে কোনও রকম মিথ্যের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। চতুর্বৃত্তি প্রয়োগ করা যাবে না মানুষের উপর। দেশপ্রেমের উদ্বুদ্ধ মানুষটিকে দেখে মানুষের মাথা আপনিই নত হয়ে যাবে, তেমন মানুষ বর্তমানে দেশে কোথায়? যার কথায়, যার ব্যক্তিত্বে মাটি উঠবে কেঁপে, ঝড়ের গতিতে বাতাস বইতে শুরু করবে, তেমন কেউ দেশের মাটিতে এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। দেশপ্রেম তো দুর অস্ত।
দেশকে ভালোবেসে মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালোবাসা যায়। ভালোবাসা মানুষের এক চরম উপলব্ধি। দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম সেই উপলব্ধির অভিন্ন সত্তা। যেমন কবি আমাদের অনেক সহজ করে বলেছেন, 'ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা, তোমাতে বিশ্বময়ীর, বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা।' রাজনীতি সর্বস্ব দেশপ্রেম প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ও সর্বনাশের পথকে প্রশস্ত করে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই বর্তমানে মানুষের বৃহত্তর মঙ্গল চেতনায় বিনষ্ট। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হলে নিজেকে সেই ভাবে তৈরি করতে হবে। শুধু মুখের কথায় হবে না। দেশপ্রেম সম্পূর্ণ অন্য অঙ্গ, এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। বুঝতে হবে দেশপ্রেমের মধ্যেই মনুষ্যত্বের শুভ বোধন, এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
জীবজগতে মানুষ হল শ্রেষ্ঠ জীব। কখনো প্রতিকূলতার সঙ্গে সে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়েছে আবার কৌশলগত বুদ্ধির প্রয়োগেও কখনো সে এগিয়েছে। এগোনোর পেছনে আছে অনেক রক্তপাত, হিংসা, মারামারি, দলাদলি। আমরা সবাই জানি মানুষের মধ্যে আছে দুটো শক্তি, একটা শুভশক্তি আর একটা পশুশক্তি বা একটা দেবত্ব শক্তি, অন্যটা আসুরিক শক্তি। এই দুই শক্তির সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব।
এদিকে মানুষের সভ্যতা ধীরে ধীরে এগিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়ে জন্ম নিয়েছেন অনেক মহৎপ্রাণ মহাপুরুষ। তারা বোঝালেন মানুষের ধর্ম কী, বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়! দেখতে দেখতে জগতে এলো- সনাতন হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, ইসলাম ধর্ম। সব ধর্মের মূল কথা প্রেম। কিন্তু ধর্মের মূল বাণীটা মানুষ ভুলে গেল। সেখানে এলো ধর্মীয় গোঁড়ামি, হিংসা, মারামারি, কাটাকাটি। এর ফলে আমরা দেখতে পেলাম, ধর্মে ধর্মে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বাঁধলো সংঘাত। প্রকৃত ধর্মের মূল সত্যকে জানার বদলে প্রকাশ পেল স্বার্থচিন্তা। ফলে মানুষ ভুলে গেল প্রেম ও মৈত্রীর কথা। পরিবর্তে এলো রক্তপাত ও দাঙ্গা। ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে মানুষ বড় করে দেখলো। ধর্মকে মানুষ ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করলো। অন্যদিকে কিছু মানুষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের হাতিয়ার করলো।
আসলে একটা কথা বুঝতে হবে ঠান্ডা মাথায়, মানুষ কিন্তু মানব ধর্মের দিকে তপস্যা করতে বলছে, সেখানেই মানুষ সর্বজনীন। তাই তো মানুষ নিজের আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে, অন্যের আত্মার মধ্যে নিজের আত্মাকে জানে। যে জানে, সেই সত্যকে জানে। এই সত্যই হলো মানবধর্ম। এজন্যই 'সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।' এই ধর্মে রয়েছে অপার ধৈর্যশক্তি, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। যে ধর্মের মধ্যে সহনশীলতা আছে, শান্তির কথা আছে, সেই ধর্মই মানুষের ধর্ম। এই ধর্মেই একমাত্র মানুষ নির্মল নিঃশ্বাস পেতে পারে।
সৌমেন সুর: যে রং তখন ছিল আজও সেই রং বহমান। প্রাচীন লগ্নে মানুষের গুহাবাসকালে হিংস্রতায়, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্বের কারণে জীবন হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ-আজও তেমনি বার্তা বয়ে চলেছে। সারা দেশ জুড়ে ক্ষমতার লড়াই। কে কাকে কোনঠাসা করতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ হিংসার ছোবলে প্রাণ হারাচ্ছে। আজও কত রক্তপাত, কত খুন, নির্লজ্জ বেআব্রুর বীভৎস ছবি। এত খুন এত রক্তপাত স্রেফ হিংসার জন্য। সভ্যতার সেই আদি যুগেও মানুষ মানুষের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চেয়েছে, এই প্রাধান্য বিস্তারের জন্যই সেদিন মারামারি কাটাকাটির শেষ ছিল না। পাশাপাশি রাজ্যগুলোর মধ্যে পরস্পর পরস্পরে ঠোকাঠুকি লেগেই থাকতো।
রাজ্য জয়ের নেশায় মেতে উঠতো দল। শুরু হতো ঘরবাড়ি জ্বালানো, মুড়ি মুড়কির মতো খুন। যুদ্ধ আর রক্তপাতের মধ্যে দিয়েই সূচনা হতো জয়যাত্রা। এমনি করেই দিন বদলায়। সমাজ বদলায়। মেন্টালিটি বদলায়। যুদ্ধ কিন্তু থামেনা। রূপ বদলে নতুন কৌশলে আবার আক্রমণ। আবার রক্তে হোলি খেলা। শুরু হয় অন্য মুডে খেলা। কত যে নিরীহ মানুষের প্রাণ অকালে চলে যায় সেদিকে দলের ভ্রুক্ষেপ নেই। সর্বত্র চলছে স্টান্টবাজির খেলা। বর্তমানে চলছে সমস্ত মানুষের শান্ত রিপুগুলোকে মিথ্যে ভাষণ দিয়ে ধ্বংস করে ফেলে, দলে তুলে নিয়ে এসো তাকে। তারজন্য তৈরি করে হিংসার ছক। যে ছকে পা দিলেই আজ নয়তো কাল মৃত্যু। দেওয়ালে ছবি হয়ে দলের সৌন্দর্য বাড়াও। যত ছবি টাঙ্গানো হবে-তত দলের আপডেট। দলের লোক খারাপ হলেও ভাল। আবার ভাল লোক অন্য দলের হলে খারাপ। এক অদ্ভুত খেলা। অদ্ভূদ যুক্তি।
আমার মতে, যদি আপনার মন সত্যি সত্যি মানুষের কাঁদে তাহলে নিঃস্বার্থভাবে আত্মশুদ্ধি করে, মানুষের পাশে দাঁড়ান। হিংসা দিয়ে সাময়িক ক্ষমতার জয় করা যায় অবশ্য, কিন্তু সেটা কখনো চিরস্থায়ী হয় না। আজ নয়তো কাল সরে যেতেই হবে। এটাই নিয়ম। কেউ যদি ভাবেন আমি সব পাল্টে দেব ক্ষমতার বলে, হিংসার আশ্রয়ে-তাহলে তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, হিংসা মানুষের জীবনে সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়। হিংসা দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় না।
সৌমেন সুরঃ ছুটির দিনে একটু অন্যভাবে দিন কাটাবো, এটা ভাবতেই শরীরের তন্দ্রীগুলো আনন্দে ঝনকে উঠলো। ছুটি মানে একটু থামা। ছুটি মানে চলমান জীবনে ক্ষনিকের বিশ্রাম। বর্তমানে চলমান জীবনে যা ঘটছে- গা যেমন শিউরে উঠছে তেমনি আতঙ্কও বাড়ছে। দেশের বর্তমান অবস্থা বড় ভয়াবহ। কখন যে কী হয়, আমরা কেউ জানি না। যাইহোক এমনি ডামাডোল অবস্থায় হাতে আসছে একটি ছুটির দিন। ভাবতেই মনটা পুলকে ভরে উঠছে। ছুটি মানে জীবনের মধ্যে ছুটি, ছুটি মানে জীবনের ছুটি নয়।
অবশেষে হাতে এলো ছুটির দিন। মহররমের ছুটি। মানে অফিস ছুটি। এদিকে শ্রাবণ মাস। বৃষ্টি ঝরার মাস। অনর্গল কোথায় বৃষ্টি পড়বে তা নয়, মাঝে মাঝে একটু বৃষ্টি, একটু রোদ, আবার মন ভার করে থাকা উড়ো মেঘের আনাগোনা। গ্লোবালাইজেশনের জন্য সব ভালো মুহূর্তগুলো হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। কী আর করা। সকাল হতেই জলখাবার খেয়ে অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবো বলে, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমি অজ গ্রামে থাকি। আমার সব বন্ধুরা শহরে থাকে। আমার বাড়ি থেকে শহর প্রায় চার মাইল। যাইহোক এক বুক আনন্দ নিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলেছি। আলের দুপাশে ধূ ধূ মাঠ। শুধু ধান আর পাট গাছ সারি সারি। যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। বৃষ্টির জল পড়ে প্রত্যেক গাছের পাতা যেন যৌবনবতী হয়ে গেছে। মাতাল হাওয়ায় ধানের শীষগুলো মাতালের মতো দোল খাচ্ছে। মনটা ভারী ভালো লাগছে। কারণ একটাই- আড্ডায় ছুটিটা উপভোগ করবো।
কথায় আছে- 'Man proposes, God disposes।' হালকা মেঘলা আকাশে হঠাৎ ভিড় করে আসে, পাহাড় প্রমাণ কালো মেঘ। আমি প্রাণপণে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম। আমাকে শহরে পৌঁছতেই হবে। কিন্তু হায় যখন দেখলাম পুকুরের হাঁস গুলো সাঁতার কেটে তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে এগোতে থাকছে, তখন বুঝলাম- আমার Journey এখানেই শেষ। দেখতে দেখতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমি সাইকেলটা নিয়ে একটা বটগাছের তলায় দাঁড়ালাম। ভিজছি অঝোরে। আর ভাবছি ছুটির দিনটা বৃথা গেল। ভাবনাটা এই মুহূর্তে আপনাদের হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার নয়। কারণ দূরে একঝাঁক বাচ্চা ছেলে পুকুরে সাঁতার কেটে খেলছে। আনন্দ করছে। ওদের দেখে তাৎক্ষণিক আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। আমিও তো একসময় ওদের মতই উদ্দাম ছিলাম। মুহূর্তে মনটা আমার আনন্দে ভরে গেল। ছুটির দিনটা আমার বৃথা গেল না। নাই বা দিতে পারলাম আড্ডা। কিন্তু প্রকৃতি তো এখন আমার সঙ্গে ছিল। একেবারে লাজুক বধূর মতো। এই উপলব্ধি যে আমার মনের একটা দরজা খুলে দিল, যা আগের মুহূর্ত পর্যন্ত টের পাইনি।
সৌমেন সুর: যার সম্বন্ধে লিখতে বসেছি তিনি বাংলার মানুষের একমাত্র ম্যাটিনী-আইডল। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছেন বুঝি? না ভাবনার কিছু নেই। ম্যাটিনী আইডল বাংলা সিনেমা জগতে একজনই, সে উত্তম কুমার। কেন উত্তম কুমার? অন্যদেরই বা মানুষ মনে রাখেন না কেন! সিনেমার জগতে মহানায়ক তিনি উত্তম কুমার। তিনি 'নায়ক' ছবি করেছেন, আবার 'অমানুষ' করেছেন। দুটো ছবি আকাশ পাতাল তফাৎ। অথচ উত্তম কুমারের বিচরণ সর্বত্র। 'নায়ক' এর মত ছবিতে সুপার্ব অভিনয়। উত্তম কুমার আবার অমানুষ ছবিতেও অনবদ্য। আসলে মহানায়ককে বিচার করা বড় দুষ্কর। বাংলা ছবিতে এমন এমন কিছু চরিত্র করেছেন যা আলোচনার ঊর্ধ্বে। তিনি এক কথায় সিনেমা জগতে সব্যসাচী ছিলেন, গান গাইতে পারতেন, সুর দিতে পারতেন, ছবি প্রযোজনা করেছেন, এমনকি পরিচালনা পর্যন্ত করেছেন। এরপরেও তো আছে অভিনয়। আজ ৪৩ বছর হয়ে গেল উত্তম কুমার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এত বছর বাদেও তিনি সমান জনপ্রিয়। 'নায়ক' ছবিতে ওই অসম্ভব সুন্দর সংলাপ ডেলিভারি আজও বহু মানুষের মুখে মুখে, 'I will go to the top, The top, The top'। ৪৩ বছর পেরিয়েও মুছে যাননি মহানায়ক। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাণিজ্যকারি সংস্থা ছবি প্রদর্শন করেন সেই উত্তম কুমাররেরই। এতেই বোঝা যায়, জনপ্রিয়তা এতটুকু ভাটা পড়েননি। তাঁর ক্রেজ তাঁর ইমেজ, আজও আমরা সিনেমার অভিনয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে উত্তম কুমারের প্রসঙ্গ চলে আসে। বেশ কিছু ছবির মহানায়কের অনবদ্য অভিনয় বাংলার মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। হয়তো ছবি বিশ্বাসকে মানুষ ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু উত্তম কুমার বাংলার মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আরও অনেক অনেক দিন।
অভিনয় পর্ব ছাড়া দান ধ্যান কর্মে ছিলেন মানুষের মনের মনিকোঠায়। অবশ্য এই পর্বটি ছিল অত্যন্ত গোপন অবস্থায়, কেউ জানতে পারতেন না, একমাত্র গ্রহীতা ছাড়া। যুগে যুগে অবতার যেমনই মাটিতে নামেন তার কর্ম মানুষের কাছে ফলপ্রসূ করতে। তেমনই উত্তম কুমার বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়ে তার কর্মের শিষ্টতা দেখে আজও মানুষ তাকে ভুলতে পারেননি। তিনি যে কত বড় মানুষ ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়, তার মহাপ্রস্থানের পথের সময় চাক্ষুষ কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল, মহানায়ককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। উত্তম কুমার একবারই জন্ম নেয়, এবার হয়ত তাকে পাবো, অন্য নামে অন্য কোনও খানে, তবে বাংলার মানুষের কাছে উত্তম কুমার ছিলেন, আছেন, থাকবেনও।
সৌমেন সুর: এই বিষয়টি নব প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই। তারাই দেশের আগামী শেকড়। তাদেরকে সুন্দরভাবে বাঁচতে হবে। বাঁচতে গেলে রসদ চাই। সেই রসদের একটা অংশ- সাহিত্য। সাহিত্যকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। এই প্রজন্ম, মন্মথ রায় কে জানে না। রমাপদ চৌধুরীকে চেনে না, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের নাম শোনেনি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনে না- শুনে আমি ভীষণ স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এরপর ভাবলাম, আমার কর্তব্যটুকু অন্তত করি। সাহিত্যের উপযোগিতাটা তুলে ধরি। প্রথমে বলি, ' Feeling is not a particular content, but the whole universe Subspecie intuition। ' সাহিত্য সমাজের দর্পণ, তবে হুবহু অনুকরণ নয়, এর সাথে আছে কবি- সাহিত্যিকের আপন মনের মাধুরী, তখনই সৃষ্টি হয় ধ্রুপদী সাহিত্য। সাহিত্যের অর্থ হলো পারস্পরিক যোগ। একেরসঙ্গে বহুর মিলন ঘটিয়ে সাহিত্য আত্মীয়তার সূত্র তৈরি করে। তবে বর্তমানে ব্যস্ত জীবনে সাহিত্য পাঠের অবকাশ কমলেও এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। মানুষ আর প্রকৃতি নিয়েই সাহিত্যের জীবন। সাহিত্য না পড়লে জ্ঞান সঞ্চয় হয় না। একজন জ্ঞানী মানুষ আর একজন অজ্ঞান মানুষ আকাশ পাতাল তফাৎ।
সাহিত্য সমাজের মাটিতে ফোঁটা ফুল। তবে হুবহু দর্পণ নয়, তার সঙ্গে মিশে আছে আপন মনের মাধুরী। সাহিত্য সমাজের একটি বিচিত্র সুন্দর সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালা থেকে আহরণ করে নিতে হবে অজানা তত্ত্ব। আসলে পড়তে হবে। পড়লে দোষ কোথায়! পড়লে বরং জ্ঞান বাড়ে। না পড়লে অজ্ঞানী হয়ে থাকতে হয়। কোনটা শ্রেয়, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। কে নাট্যকার, কে কবি, কে সাহিত্যিক, কে লেখক- তারা কি লিখেছেন, তারা কেন নক্ষত্র, এগুলো বুঝতে হবে। জানতে হবে।
সবশেষে বলি, সাহিত্য হল আমাদের আনন্দের আশ্রয়, অবকাশের সঙ্গী, দুঃখের সান্ত্বনা এবং ন্যায় বিচারের হাতিয়ার। সাহিত্য আমাদের হৃদয়কে প্রস্ফুটিত করে। নব প্রজন্মকে অনুরোধ- সাহিত্যকে মনে প্রাণে ভালোবেসে- অফুরন্ত জ্ঞান আহরণ কোরে, নিজেকে প্রকাশ করুন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে।
সৌমেন সুর: আজ বিষয়টা একটু অন্যদিকে ঘোরাবো। প্রতিদিন খুনখারাবি, মারামারি, মিছিল, হাম বড়াভাব, বৌদ্ধত্য এসব দেখতে দেখতে মনটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। মন একটু বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু চাইলে তো সব ঠিকঠাক হয় না। তাই ঠিক করলাম আজ একটু আধ্যাত্মিক পথের কথা বলে মনটাকে অন্য পথে চালিত করবো। ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও মা সারদাকে কে না চেনে, কে না জানে। ঠাকুর অত্যন্ত সহজ সরল ভাবে অধ্যাত্ম ও উপনিষদের কথা ব্যাখ্যা করে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। এত সহজ কথা অথচ কী গভীর তার অর্থ। আমরা বৃন্দাবনকে চিনি জানি। কিন্তু বৃন্দাবন যে বাংলায় অবস্থিত আছে এটা আমরা অনেকেই জানিনা। ঠাকুর আমাদেরকে নিয়ে গেলেন বিষ্ণুপুর। এখানেই তিনি অনুভব করেন বৃন্দাবনের পরশ। উচ্চারণ করে বলেন এই হল গুপ্ত বৃন্দাবন।
আজ আমি মা সারদাকে নিয়ে বিষয়কেন্দ্রিক গল্প বলতে বলতে এগিয়ে যাব। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা বীরহাম্বিরের হাত ধরে বিষ্ণুপুরের মানুষ ভেসেছিল বৈষ্ণব ধর্মের জোয়ারে। বিষ্ণুপুরকে সাজানো হয় বৃন্দাবনের মতো করে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাই বিষ্ণুপুর বলতে গুপ্ত বৃন্দাবনের কথা বলতেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও সারদা দেবী কামারপুকুর ও জয়রামবাটী এই দুই স্থানে আবির্ভাব হয়েছিলেন। এই দুই স্থান থেকে বিষ্ণুপুর খুব দূরে নয়। ঠাকুর বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন একটা মামলার সাক্ষ্য দিতে। তখন রাজার তৈরি মায়ের মন্দিরে মৃন্ময়ী মাকে তিনি দর্শন করেন আর সারদা মাকে জানান, 'তুমি বিষ্ণুপুরে গুপ্ত বৃন্দাবন দেখো।' উত্তরে মা সারদা বলেন, 'আমি মেয়েমানুষ, কি করে দেখবো।' ঠাকুর বলেন, 'দেখবে দেখবে, ঠিক দেখবে।' একদিন ঠাকুরের কথা ফলে যায়। বিষ্ণুপুর হয়ে বেঙ্গল নাগপুর ট্রেন চালু হয়। আগে বিষ্ণুপুর দুর্গম ছিল এখন সুগম হয়। মা তখন জয়রামবাটী থেকে বিষ্ণুপুর আসতেন ট্রেনে করে। ঠাকুরের ভবিষ্যৎবাণীকে কেন্দ্র করে মা একদিন সর্বমঙ্গলা মন্দিরের প্রাঙ্গণে বসে বলেন, 'ঠাকুরের কথা আজ সত্যি হল। ' মা প্রথম বিষ্ণুপুর যান ১৩১২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে, কলকাতা থেকে জয়রামবাটী যাওয়ার পথে। আরেকবার মা বিষ্ণুপুর স্টেশন এ অপেক্ষা করছিলেন, তখন একজন অব বাঙালি কুলি মাকে দেবী ভেবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। কি করবেন মনস্থির করতে পারেন না- এত আনন্দ উদ্ভব হয়েছিল তার মনে। সম্ভবত স্বপ্নে হয়তো মাকে দেখেছিলেন। ১৯২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মা বিষ্ণুপুর থেকে কলকাতা বাগবাজার অঞ্চলে উদ্বোধনের পথে শেষবার গমন করেন।
ভাবের কথা বললাম বলে সবটাই ভাব নয়। তবে ভাবেই ভক্তি। আর ভক্তিতেই মুক্তি। সংসার আবদ্ধ জীব আমরা। সংসারের মধ্যে থেকে যদি দিনান্তে একবার তাঁকে স্মরণ করা যায়, তাহলে আমাদের উতক্ত রিপু গুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে, মন শান্ত হবে। তখন মনে হবে অনেক ভুলভাল কর্ম করেছি, আর নয়। এবার ঈশ্বরকে স্মরণ করে পথ চলব।
আজ বিষ্ণুপুর তাই শুধু গুপ্ত বৃন্দাবন, মন্দিরের দেশ, সংগীতের পিঠস্থানই নয়, গর্বিত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদার পদধূলিতে ধন্য হলো ভুবন।