সৌমেন সুরঃ বিষয়টির ওপর কিছু বলতে গিয়ে কয়েকটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেগুলো না বললে বিষয়টা সম্পূর্ণ হবে না। যেমন, প্রত্যাশিত প্রাপ্তিযোগে মনে আনন্দ আসে, কিন্তু যা অপ্রত্যাশিত, সেই প্রাপ্তিযোগ মনকে অসম্ভব নাড়া দেয়। শুধু টাকা, পয়সা বা মূল্যবান জিনিস নয়, অপ্রত্যাশিত যে কোনো জিনিস পাওয়া সুখপ্রদ। জীবনে বিভিন্ন অবিস্মরণীয় ঘটনা অপ্রত্যাশিত, তা নানা কুডিয়ে পাওয়ার উজ্জ্বল মুহূর্তের সমষ্ঠি, তাই নয় কি?
আমার ছেলেবেলা থেকে গল্পটা বলি। তখন আমি একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। কোনো কোনোদিন স্কুলে টিফিন নিয়ে যাই। তবে মজার ব্যাপার হলো, যেদিন দু-এক টাকা বড়দের কাছ থেকে পাই, সেদিন আমার ইচ্ছেমতো জিনিস কিনে খাওয়ার আনন্দে মনটা ভরপুর হয়ে ওঠে। এমনিই একটা দিন আমার। ঢোলা হাফ প্যান্ট আর হাফশার্ট পরে স্কুলের পথে চলেছি। মনের অজান্তে পকেটে হাত গলিয়ে অনুভব করি, আমার পকেটে একটা দু'টাকার নোট। বারবার মনে ঘুরেফিরে আসছে-কখন টিফিন হবে আর আমি আমার ইচ্ছেমতো আলুকাবলি বা ছোলামাখা, একটা সবুজ রঙের আইসক্রিম খাবো। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রায় স্কুলের সামনে চলে এসেছি। এমন সময় আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমার সহপাঠী আমার কাছে এসে বলে, তোমার পকেট থেকে এই দু'টাকা পড়ে গিয়েছিল, নাও ধরো। আমি দ্রুত আমার পকেটে হাত গলিয়ে দেখি, টাকাটা নেই। এইবার একই সঙ্গে হারানোর দুঃখ আর পর মুহুর্তে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আমি আত্মহারা, স্তব্ধবাক।
এরপর থেকে সহপাঠী বন্ধু আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে দাঁড়ায়। দু'জনে মিলে পথে ঘাটে মাঠে জঙ্গলে কতকিছু কুড়িয়ে বেড়িয়েছি, কুড়িয়ে পেয়েছি। তার সবকিছু আজ মনে পড়ে না। তবে সেইসব স্যাঁতস্যাঁতে ডাকটিকিট, তামার এক পয়সা, সোনালি পালক, আরো কতকিছু কুড়িয়ে পাওয়ার আনন্দ আজও বুকের মধ্যে ভিড় করে।
সৌমেন সুর: উপন্যাস এমন একটি শিল্পকর্ম যেখানে কাহিনীর সূত্র ধরে অজস্র চরিত্রের আনাগোনা ও স্রষ্টার জীবনদর্শন মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। 'তৃণখন্ড' থেকে শুরু করে 'হরিশচন্দ্র' পর্যন্ত সাহিত্য পরিক্রমায় বনফুল প্রায় ৬০টির মতো উপন্যাস লিখেছেন। এছাড়া লিখেছেন অজস্র ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটক। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস বিষয় বৈচিত্র্য অনন্য, তাঁর লেখার মধ্যে ছিল বিজ্ঞানীর বিশ্লেষনী দৃষ্টি। বনফুলের কষ্টিপাথর উপন্যাসটি পত্রের আকারে রচিত।
প্রায় ৫৩টি চিঠির মধ্যে দিয়ে এর কাহিনী উদ্ধৃত। এই উপন্যাসের মূল বিষয় নারী স্বাধীনতা ও সমাজে নারীর অবস্থান। অমিত ও হাসির দাম্পত্য সম্পর্ক ধরে বিষয়টি তিনি উপস্থাপন করেছেন। 'ডানা' উপন্যাসে প্রায় ১৫০ পাখির নাম আছে। এছাড়াও আছে তাদের নানা রঙের, নানা আকারের ডিমের কথা। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নতুন কিছু বলতে চেয়েছেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল কর অবজেকটিভ সাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর বিশেষত্বের কথা বলেছিলেন।
বনফুলের ছোটগল্পেও বৈচিত্র্যের সমাবেশ। এ বৈচিত্র্য বিষয়ে, আঙ্গিকে। জীবনে তিনি বহু ধরনের মানুষ দেখেছেন। জাতপাত ধর্মের বিচার না করে বহু মানুষের সঙ্গে তিনি মিশেছেন, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনার শরিক হয়েছেন। নানারকম মানুষের কথাই তাঁর ছোটগল্পের বিষয়। 'নিমগাছ' তাঁর অনবদ্য একটি গল্প। নিমগাছের উপর কত অত্যাচার হয়ে চলেছে। কিন্তু নিমগাছ তার প্রতিবাদ করে না। সবই নীরবে সহ্য করে। প্রথম থেকেই একটা টানটান আকর্ষন। শেষে দেখা যায়, এ তো নিমগাছের কথা নয়। গোটা নিমগাছটাই আমাদের পরিচিত পরিবারের সর্বংসহ গৃহবধূর প্রতীক হয়ে গিয়েছে। পরিবারের কাঠামো ভাঙছে, পুরোনো দিনের উদার উদার হৃদয় মানুষগুলোকেও আর দেখা যাচ্ছে না।
বনফুল তাঁর অজস্র সৃষ্টি সম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। জীবনে তিনি অনেক সরকারি বেসরকারি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু পাঠকের ভালবাসাকেই তিনি বড় পাওনা বলে মনে করেছেন। এর কাছে তাঁর 'পদ্মভূষন'-ও ম্লান হয়ে যায়। তিনি সাহিত্য সম্পর্কে যা রেখে গিয়েছেন, তা বাঙালি পাঠক কোনওদিন ভোলেনি, ভুলবেও না।
সৌমেন সুর: গানের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট আনন্দ, অন্তরের অন্দরমহলে 'ফানা'কে প্রতিষ্ঠিত করে। সাঁই-দরবেশরা ঈশ্বরের অচিন্ত্যনীয় সত্তার মধ্যে মিশে যায়, পরিভাষায় তা হলো ফানা। আসলে সঙ্গীতময় মিলন সত্যই হলো সুফীতত্ত্বের 'সামা'। বাউল কবিদের ভাষায়- 'আমি কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে/ হারায়ে সেই মানুষে- তার উদিশে/ দেশবিদেশে বেড়াই ঘুরে।' কিন্তু লালনের বড় দুখ। কারণ লালনের কথায়- 'আপনারে আপনি চিনি নে'/ দীন দনের পর যার নাম অধর/ তারে চিনবো কেমনে।
এই 'আপনারে আপনি চেনা' ফ্রয়েডিয় মনোবিজ্ঞানের আত্মরতি নয়, তার কারণ এই আপন কিন্তু সেই চিদানন্দস্বরূপ অংশকলা। মায়ার ঘোরে চোখ বোজা থাকলে সাঁইয়ের রুপ চেনা যায় না। অথচ সাঁই এবং লালন এক জায়গাতেই থাকেন, তবু তাদের মধ্যে লক্ষযোজন দূরত্ব।
'মনের মধ্যে মনের মানুষ করো অন্বেষন'-এটাই বাউল দর্শনের মর্মবানী। এই অন্বেষনেরই কথা আমরা রবীন্দ্রনাথের গানেও পাই। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথও বাউল, রবি বাউল। রবি বাউল মনের মানুষকে চিহ্নিত করেছেন প্রাণের মানুষ রুপে।
বাউলদের মানুষতত্ত্ব ঠিক মানবতত্ত্ব নয়। মানুষ বলতে বাউলরা যা বোঝেন তা মানব নয়। মানুষ অচিন পাখির মতো খাঁচার ভেতর আসা যাওয়া করে। আরশী নগরে পড়শীর মতো বসত করে। বাউলরা মানুষকে যে স্থান দেয় তা অন্যরা দেয় ভগবানকে। লালন যেখানে শ্রেষ্ঠ, সেখানে তিনি মিষ্টিক। তাঁর কথাগুলো সহজ, কিন্তু তিনি যা বলতে চান তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
লালনের মনের মানুষ, গগন হরকরার মনের মানুষ, রবীন্দ্রনাথের প্রাণের মানুষ, হাসন রাজার অন্তরিয়া, প্রকৃতপক্ষে একই। লালনের মনের মানুষের এই যে অন্বেষন, কোথায় যেন আমাদের জীবনের অনুসন্ধান হয়ে দাঁড়ায়।
সৌমেন সুর: গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত, সুফী মার্গ এবং সহজিয়া পথ--এই তিন ধারাতেই লালনের অভিষেক ছিল বলেই তাঁকে কোন একটি ধারায় চিহ্নিত করা যায় না। লালন ছিলেন একজন উচ্চাঙ্গের সাধক। তাঁর সম্বন্ধে বলা হয়, 'আউল বাউল দরবেশ সাঁই/ লালন সাঁইয়ের উপরে আর নাই।' লালনের গানে আমরা পাই- 'সব লোকে কয়, লালন কি জাত সংসারে/ লালন বলে, জাতের কিরুপ, দেখলাম না এই নজরে...।' বাউলের কাছে দেহভান্ডই হলো ব্রক্ষ্মান্ড। এই দেহ মন্দিরেই তাদের মনের মানুষ। জড় দেহের মধ্যে কীভাবে চিদানন্দময় অনন্তের স্বাদ পাওয়া যায়, বাউলরা তারই সন্ধান করেন। এই অধরা মনের মানুষকেই তাঁদের দেবতা জ্ঞান করেন, যিনি কোনও মন্দিরে বা মসজিদে থাকেন না, বাউলদের বানীই হলো- 'এই মানুষে আছে সেই মানুষ।' কিন্তু লালনের জীবনে 'এই মানুষে সেই মানুষের দর্শন লাভ অর্থাৎ অন্বেষন সম্পূর্ন হয়নি। তাঁর আত্মা অপরিতৃপ্ত।'
বাউলরা বেদ মানে না, কোরান মানে না, মন্দির মসজিদ মানে না, পূজা-পার্বন মানে না, রোজা নামাজ মানে না। দেবদেবী, অবতার, পয়গম্বর মানে না। এমনকি ঈশ্বর, আল্লাকেও ডাকে না। তাই বলে বাউলরা নিরশ্বরবাদী নয়। তাদের যিনি সাঁই তিনি অলখ মানুষ। সকলের অন্তরেই তিনি রয়েছেন। অন্তরেই তাঁকে পাওয়া যায়। লালন একেই মনের মানুষ বলেছেন।
মরমীয়া সাধক কবি হাসন রাজারও একই রকম উপলব্ধি হয়েছিল। একটা কিছু তাঁর সামনে ছিল, যা তিনি ধরেও ধরতে পারতেন না, তাকেই হাসন রাজা অন্তরিয়া বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিও একই ছিল। আসলে সাঁই-দরবেশের 'অহং' বোধ থাকে না। তারা ঈশ্বরের অচিন্তনীয় সত্ত্বার মধ্যে নিমজ্জিত হন। এই মিশে যাওয়ার পরিভাষা হলো 'ফানা'। 'ফানা' না হলে অটল প্রাপ্তি হয় না। আর প্রেমিক ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়াকে সামা বলে। এই মিলিত হওয়াকেই বাউলতত্ত্বে বলা হয় চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা- এটি সম্ভব নৃত্যগীতের মাধ্যমে।
সৌমেন সুর: সাহিত্য সমাজের(Special story) দর্পন, তার হুবহু অনুকরণ নয়। তবে এর সঙ্গে আছে কবি সাহিত্যিকদের আপন মনের মাধুরী। তখনই সৃষ্টি হয় ধ্রুপদী সাহিত্য, সাহিত্যের অর্থ পারস্পরিক সম্পর্কের যোগ। একের সঙ্গে বহুর মিলন ঘটিয়ে সাহিত্য আত্মীয়তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বর্তমান ব্যস্ত জীবনে সাহিত্যপাঠের(Literature) অবকাশ কমলেও সাহিত্যপাঠের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না।
সাহিত্য সমাজচিত্রের একটি বিচিত্র সংগ্রহশালা। সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক খুব নিবিড়। তাই সাহিত্য সমাজের মাটিতে ফুটন্ত ফুল। তবে হুবহু দর্পন নয়, তার সঙ্গে মিশে আছে সাহিত্যিকের মনস্তাস্ত্বিক বিশ্লেষণ। সাহিত্যিক সমাজ(Special Effect) থেকে উপকরন সংগ্রহ করে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে, গ্রহণ-বর্জন করে দেশ-কাল-পাত্রের বাইরে সময়ের বহমান ধারায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট, সমাজের উপদানে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা।
সমাজ তাকে উপাদান জোগায়। সমাজের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যেরও ঋতুবদল হয়। কিন্তু সূর্য থেকে নি:সৃত আলোয় চাঁদ শুধু আলোকিতই হয় না। সে আলোর বিকিরণও তার এক গৌরবী কৃতি। সমাজ থেকে উদ্ভূত সাহিত্যের তাই আজ আগামীকালের জন্য ঘুম থেকে জাগরনের সাধনা, জীবন থেকে মহাজীবন রচনার প্রেরণা।
সাহিত্য আমাদের আনন্দের আশ্রয়, দু:খের সান্ত্বনা এবং ন্যায়-বিচারের হাতিয়ার। সাহিত্যপাঠ আমাদের হৃদয়কে প্রস্ফুটিত করে। মনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে এবং বুদ্ধিকে তীক্ষ্ণ করে। সাহিত্য এককথায় জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। তাকে কিছুতেই বর্জন করা যায় না।
সৌমেন সুরঃ মারা যাওয়া পেনশন প্রাপকের বদলি লোক কিংবা গ্রামের অন্য কেউ প্রকিস দিয়ে পেনশন তুলছে। সুতরাং হার্শেল সাহেব তার হুগলি বিদ্যেটা কাজে লাগালেন। তিনি ঘোষণা করলেন, পেনশন প্রাপকের সাক্ষর ছাড়াও আঙুলের ছাপ দিতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে কাজ শুরু হবার পর ফল হাতেনাতে পাওয়া গেল। পেনশন প্রাপকদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে আরম্ভ করলো। এই ঘটনায় হার্শেল সাহেব উৎসাহিত হয়ে দলিল রেজিস্টেশনের ক্ষেত্রেও আঙুলের ছাপ নিতে আরম্ভ করলেন, যাতে বিক্রেতা অস্বীকার করতে না পারে এবং ক্রেতাও বিক্রেতার সই জাল করে জমি আত্মসাৎ করতে না পারে। কিন্তু হার্শেলের দুর্ভাগ্য কয়েদিদের শনাক্তকরনের ক্ষেত্রে তিনি এই পদ্ধতি প্রয়োগ সরকারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেন। তা না হলে সেইসময় ১৮৬০/৬২- তেই ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কার স্বীকৃত হতে পারতো।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং পূর্ণাঙ্গ হাতের ছাপ নিয়ে নানান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও প্রকৃত ফিঙ্গারপ্রিন্টের তদন্তের আনুষ্ঠানিক সূচনা কলকাতা থেকেই। বিখ্যাত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো অধিকর্তা বিদ্যুৎ নাগের একক প্রচেষ্টায় আজ প্রমণিত, কলকাতাই ফিঙ্গারপ্রিন্টের তদন্তের উৎস। এই প্রসঙ্গে তাঁর বর্ণনায় পাই, কর্মব্যস্ত একজন ইংরেজ আই সি অফিসার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি পুলিস ইনসপেক্টার জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব নিয়েই তিনি অপরাধী শনাক্তকরনে উঠেপড়ে লেগে যান।
বিজ্ঞানী গ্যালটনের প্রমাণিত সূ্ত্র ধরে হেনরি ফিঙ্গারপ্রিন্টকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিলেন শনাক্তকরনের ব্যাপারে। ফ্যান্সের দেহাঙ্গমিতির সংশোধিত রুপটি হেনরির চেষ্টায় বাংলা তথা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রশংসা পায়। ১৮৯৬ সালে পুলিসের সার্কুলারে আঙুলের ছাপকে প্রধান করে। হেনরি অবশেষে স্বীকার করেন, 'অঙ্গলিছাপ' সূ্ত্রটি একশো শতাংশ নির্ভুল রুপে মত দেন দুজন বাঙালি সাব ইন্সপেক্টর। একজন আজিজুল হক, অন্যজন হেমচন্দ্র বসু। তবে সূ্ত্রটি আজও হেনরি পদ্ধতি নামে সারা বিশ্বে প্রচলিত। ১৮৯৭ সালে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যাপারে অনুমোদন পাওয়ার পর ভারতবর্ষে বাংলার মূখ্যকার্যালয় রাইটার্স বিল্ডিং-য়ে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। (সমাপ্ত) তথ্যঋণ/ বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধায়
সৌমেন সুর: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বহু উপন্যাস, ছোটগল্প লিখলেও সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে সেই অর্থে কোনও উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনা করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম তাঁর দুরাশা গল্পটি যা আজও সিপাহি বিদ্রোহের সমকালীন সাহিত্য সৃ্ষ্টিকর পটভূমিকায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। গল্পে লেখকের সঙ্গে দার্জিলিং শৈলশহরে ক্যালকাটা রোডে হঠাত্ সাক্ষাত্ হয় বদ্রাত্তনের নবাব গোলামকাদের খাঁর পুত্রীর সঙ্গে। যার শিরায় প্রবাহিত দিল্লীর সম্রাট বংশের রক্ত।নবাব দুহিতার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে লেখক জানতে পারেন জনৈক হিন্দু ব্রাহ্মণ কেশরলালের সঙ্গে তাঁর অব্যক্ত গোপন প্রণয়ের কথা।
সেই সময় সিপাহি বিদ্রোহ আরম্ভ হলে উগ্র জাতীয়তাবাদী কেশরলাল, বদ্রাত্তনের ক্ষুদ্র কেল্লার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়। নবাব দুহিতার ভাষায়-এমন সময় কোম্পানি বাহাদুরের সহিত সিপাহিদের লড়াই বাঁধিল। আমাদের বদ্রাত্তনের ক্ষুদ্র কেল্লার মধ্যেও বিপ্লবের তরঙ্গ জাগিয়া উঠল। কেশরলাল বলিলেন, 'এবার গোখাদক গোরালোককে আর্যাবর্ত হইতে দূর করিয়া দিয়া আর একবার হিন্দুস্থানে হিন্দু মুসলমান রাজপদ লইয়া দ্যূত ক্রীড়া বসাইতে হইবে।'
এবার গোলামকাদের খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় জেলার কমিশনার সাহেব কেল্লার আত্মগোপনকারী কেশরলালকে যুদ্ধে পরাজিত করে। যমুনার তীরে মৃতপ্রায় কেশরলালকে জলদান করে বাঁচায় নবাবপুত্রী। কিন্তু সে তাঁকে প্রত্যাখান করে যমুনায় নৌকা করে পালিয়ে যায়। গৃহত্যাগী নবাবপুত্রী এরপর কাশীর শিবানন্দ স্বামীর কাছে সংস্কৃত শিক্ষা এবং হিন্দুধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। এরপর যোগীনির বেশে ৩৮ বছরের দীর্ঘ অন্বেষনে কেশরলালকে খুঁজে পায় দার্জিলিংয়ে।
একথা সত্য যে, উনবিংশ শতাব্দীর সিপাহিদের এই মহাবিদ্রোহ পরিণত হয়েছিল এক সাংঘাতিক গণবিদ্রোহ ও বিপ্লবে। এই গণবিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন তত্কালীন লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। বঙ্কিমচন্দ্র,দীনবন্ধু মিত্র,মধুসূদন, ভূদেব মুখ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত-র মতো আলোচ্য লেখকগন অত বিখ্যাত না হলেও সিপাহি বিদ্রোহে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
তথ্যঋণ: রবীন্দ্র রচনাবলী ৮ম খন্ড/সুরজিত্ ধর
সৌমেন সুরঃ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ প্রথম সশস্ত্র গণ অভ্যুত্থান-পরাধীন ভারতে। এই সালে মহাবিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ প্রথম অভিভক্ত বাংলাদেশে প্রজ্জ্বলিত হলেও বাঙালিরা সক্রিয়ভাবে এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেনি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার ফলে দেশের নব উদ্ভূদ জমিদার শ্রেণি বিদ্রোহীদের বিপক্ষে যোগদান করে এবং ইংরেজ প্রভুদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করে তাদের শ্রেণিস্বার্থ ও চরিত্র নগ্নভাবে প্রকাশ করে।
কিন্তু জমিদার শ্রেণির প্রধান সংগঠন 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন' বিদ্রোহী সিপাহীদের আচরণের নিন্দাসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করে। তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা 'সংবাদ প্রভাকর'-এ সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নির্মমভাবে বিদ্রোহের সমালোচনা করেন। সৃজনশীল রচনায় যেমন উপন্যাস ও ছোট গল্পে, সে সময়ের দুই দিকপাল সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রমেশ চন্দ্র দত্ত সিপাহী বিদ্রোহকে অবলম্বন করে কিছু সৃষ্টি করা থেকে আশ্চর্যরকম বিরত ছিলেন। কিছু স্বল্পখ্যাত লেখক সিপাহী বিদ্রোহের বীরগাথা উপজীব্য করে উপন্যাস রচনা করেছেন। মহাবিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা প্রথম উপন্যাস 'চিত্তবিনোদিনী' লেখক গোবিন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, প্রকাশকাল ১৮৭৪। এই উপন্যাসে লেখক প্রথম সচেতনভাবে সিপাহীযুদ্ধের পটভূমিকা অবলম্বনে কাহিনি রচনা করেন।
১৮৭৯ সালে প্রকাশিত উপেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের নানাসাহেব উপন্যাসে নানাসাহেবকে কেন্দ্র করে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস বিধৃত। নানাসাহেব তাঁর ছোট ভাই বল্লারাও-এর প্রেমিকা অহল্যার রুপে মুগ্ধ হয়ে, তাঁকে পাবার লোভে এত উন্মত্ত হয়েছেন যে, কর্তব্যকর্ম, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে অবহেলা করছেন। (চলবে) (তথ্যঋণ- সুমিত তালুকদার)
সৌমেন সুর: বাঙালির আমিষ-নিরামিষ দুটি রান্নার খ্যাতি একসময় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। চৈতন্য দেবের আচার্য অদৈত্বদেবের স্ত্রী সীতাদেবীর নিরামিষ রান্নার যে নিখুঁত বিবরণ আছে, তা বাঙালীর রান্নার ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। 'ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজ' গ্রন্থটির বিখ্যাত লেখক জেএ সান্ডারল্যান্ড, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর স্ত্রীয়ের হাতের রান্না খেয়ে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁকে আমেরিকায় রান্নার স্কুল খোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রাজা নবকৃষ্ণদেব তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধে সেইসময় কুড়ি লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। নিমন্ত্রিতদের আহার্য সব দোকান থেকে সংগ্রহ করার জন্য, সেদিন কলকাতার সব মুদি দোকানের চাল-ডালই ফুরিয়ে গিয়েছিল।
কুমারটুলিতে একটিও মাটির হাড়ি ছিল না। ছিল না আশেপাশের কোনও কলাগাছের আস্ত পাতা। নবকৃষ্ণের এই নিমন্ত্রণ আজও ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। বিদ্যাসাগরের মা ভগবতীদেবীর রান্নার খুব যশ ছিল। তাঁর হাতের আমিষ রান্না খেয়ে, তত্কালীন শিক্ষাকর্তা হ্যারিসন সাহেব দারুন খুশি হয়েছিলেন। এই রান্নার গুণটি বিদ্যাসাগর মহাশয় ভীষণভাবে রপ্ত করেছিলেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে খাওয়া আর খাওয়ানোর ব্যাপারে বাঙালিদের মতো এমন ভোজনরসিক জাত সত্যিই বিরল। তবে এখন আর সেই নিমন্ত্রণের বহর নেই।পেটুকদেরও আর সেই ইজ্জত নেই। আছে শুধু হারিয়ে যাওয়া কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি।
তথ্যঋণ সুরজিত্ ধর।
সৌমেন সুর: রাস্তা দিয়ে বিয়ের শোভাযাত্রা দেখে রাজকুমারী চোখের পলক পড়ে না। সোজা মায়ের কাছে আবদার করে, 'মা আমার বর কই।' মা পড়লেন মহাফ্যাসাদে। কী করে মেয়েকে শান্ত করাবেন। অবশেষে মেয়েকে ধরে সোজা ঠাকুরঘরে এসে গিরিধারীলালকে দেখিয়ে বলেন,'এই যে তোমার বর মেঘে তারিখে দেখে আপ্লুত হয়ে যায়।' প্রথম পর্বের পর...
মীরা যখন আপন মনে ধ্যান করতে করতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, সেই সময় বিজয়বর্গীয় নামে একজন এসে, ক্ষুধার্ত মীরাকে দুধ এনে দেয়। মীরা দুধের বাটি এনে নিবেদন করেন গিরিধারীলালকে। এরপর চরণামৃত জ্ঞানে সবটুকু খেয়ে ফেলেন। এদিকে বিজয়বর্গীয় ভয়ে কাঁপতে থাকেন। কারণ দুধে রানা মিশিয়ে দিয়েছেন বিষ। কিন্তু কৃষ্ণভক্তির জেরে বিষ অমৃত হয়ে যায়। মীরা কৌটো খুলে সাপটাকে মালা ভেবে গলায় ধারণ করে। মীরার প্রতি এরকম অনেক রকম অত্যাচার শুরু হয়। কিন্তু প্রতিবারই কৃষ্ণ মীরাকে বাঁচিয়ে দেয়।
মীরা সেই শৈশব থেকে শ্যামকে ভালবেসেছে। গিরিধারীলালের পুজোয় দেহমন সব সমর্পণ করেছে। ওই কালো রূপে মন মজেছে। কালো রূপে মগ্ন মীরা ব্যাকুল, চর্মচক্ষুতে কৃষ্ণের দর্শনে। সিংহাসনে শ্যমকে বসিয়ে কখনও হাসছেন, কখনও কাঁদছেন। দু'জনে শুধু মন দেওয়া-নেওয়া। ভক্ত আর ভগবানের মাঝে সেতুবন্ধন হলো মীরার ভজন। এরপর অনেক ধরনের অত্যাচার করেও রানা পরিশ্রান্ত, তখন মীরাকে চিতোর ত্যাগ করার আদেশ দিলেন।
কৃষ্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাতের অন্ধকারে কাউকে কিছু না বলে মীরা দ্বারকার পথে পা বাড়ালেন। আসলে ভক্তিতেই মুক্তির সন্ধান। মীরা আজ সিদ্ধা। মীরার শরীরে কৃষ্ণপ্রেমের পূর্ণ প্রকাশ। মীরা আজ গিরিধারীলালের প্রেমিকা। কলঙ্কের ভাগী হয়ে ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিলেন মীরা। শুধু নিজের প্রেমকে বিসর্জন দেবেন না বলে।
কৃষ্ণলীলার স্বরূপ সন্ধানে শুধু রাধা নয়, মীরার আত্মনিবেদনের নির্যাসকে আত্মস্থ করতে হয়। আর এখানেই অমরত্ব পেয়েছেন মানবী মীরাবাঈ।
সৌমেন সুর: বোলপুর শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য আশ্রমের অধ্যাপক জগদানন্দ রায় আকাশ পর্যবেক্ষক রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের কাছে একটি চিঠি লিখেন। সেই চিঠি থেকে হুগলির একটি দূরবীন তৈরীর প্রতিষ্ঠানের হদিশ মেলে। হুগলি প্রতিষ্ঠানের ধর এন্ড ব্রাদার্সের পুরো নাম ছিল এস কে ধর এন্ড ব্রাদার্স। বস্তুত এই প্রতিষ্ঠানটি ভারতের প্রথম দূরবীন প্রস্তুতকারক।
ধর অ্যান্ড ব্রাদার্স সম্পর্কে বলা যায়, এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হুগলির ঘুটিয়া বাজারের নগেন্দ্রনাথ ধর। তিনি পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স-সহ উদ্ভিদবিজ্ঞানে এমএ। এরপর আইন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে আইনজীবী হন এবং পরবর্তী সময়ে জজ সাহেব হিসেবে বিভিন্ন শহরে উচ্চপদে চাকরি করেন। সুযোগ্য রাজ কর্মচারী ছিলেন বলেই তখনকার ইংরেজ সরকার তাকে রায়বাহাদুর সম্মান প্রদান করেছিলেন। ১৯২৬ সালে হাভার্ড মানমন্দির রাধা গোবিন্দকে একটি দূরবীন উপহার দিলে, এর স্ট্যান্ড তৈরির জন্য রাধাগোবিন্দ দূরবীনটি হুগলির ধর অ্যান্ড ব্রাদার্সে পাঠালেন।
দূরবীনটি দেখে নগেন্দ্রনাথ যে কী পরিমান আনন্দ পেয়েছিলেন, তা জানা যায় তাঁর লেখা একটা চিঠি থেকে। চিঠিতে মহানন্দে প্রাপ্তি স্বীকার করেছিলেন। বলাবাহুল্য যত্নের সঙ্গে দূরবীনটির জন্য একটি ইক্যুইটোরিয়াল স্ট্যান্ড তৈরি করে নগেন্দ্রনাথ, রাধাগোবিন্দকে পাঠিয়েছিলেন। ধর অ্যান্ড ব্রাদার্সের তৈরি দূরবীন সেকালে সেন্ট জেভিয়ার্স, প্রেসিডেন্সি, হুগলি কলেজের মতো এদেশের বহু কলেজ ও দেশীয় রাজাদের লাইব্রেরীতে স্থান পেয়েছিল। এবং শত শত শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে মিটিয়ে ছিল। এছাড়া কুচবিহার মহারাজ, গায়কোয়াড় মহারাজ এবং রবীন্দ্রনাথের মতো গুণগ্রাহীরা হুগলির কারখানায় তৈরি দূরবীন সংগ্রহ করেছিলেন।
১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত কলকাতা প্রদর্শনীতে ধর অ্যান্ড ব্রাদার্স, দূরবীন তৈরিতে স্বর্ণপদক লাভ করেছিল। দুঃখের কথা বহু বাঙালি প্রতিষ্ঠানের মতই ধর অ্যান্ড ব্রাদার্স দূরবীন তৈরি সংস্থার কোন অস্তিত্ব আজকের দিনে নেই। ১৯২৯ সালে নগেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেই এ দেশে তৈরি প্রথম দূরবীন কারখানাও অস্তমিত হয়। তথ্যঋণ: রণতোষ চক্রবর্তী
রবীন্দ্রনাথ নিজে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যাত্রাপালা লেখা নিয়ে উৎসাহ দিয়ে ছিলেন। তখন অবন ঠাকুর মন পালা লেখার নেশায় মত্ত। তিনি একটা করে পালা লিখতেন আর নাতি-নাতনিদের পড়ে শোনাতেন। নাতি-নাতনিরা খুব খুশি হত। এভাবেই অবনীন্দ্রনাথের দিন কাটতো। ছবি আঁকায় তার মন বসছিল না। কেউ ছবি আঁকার কথা বললে তিনি খুব বিরক্ত হতেন।
যখন রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা নাটক মঞ্চস্থ করতেন, তখন মঞ্চসজ্জা থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাজসজ্জার ভার পড়তো অবনীন্দ্রনাথের উপর। নিজে অভিনয় করতে গিয়ে সব সময় কমিক চরিত্র করতে ভালোবাসতেন। কমিক চরিত্রে এতো ভালো অভিনয় করতেন, যার জন্য রবীন্দ্রনাথ ওর কথা ভেবে নাটকে একটি কমিক চরিত্র তৈরি করে রাখতেন। অবনীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালের দিকে রামকাহিনী থেকে নানান খন্ড চিত্র নিয়ে পালা লিখতে শুরু করেন। ১৯২৬-২৭ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেন।
একে অপরের বিপরীতে এলেন। আবার রবীন্দ্রনাথই, অবনীন্দ্রনাথকে লেখার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। ১৯৩৮ সাল থেকে অবন ঠাকুরকে ছবি আঁকায় আবার ফিরতে দেখা গেল। ১৯৩০ সালে প্যারিসে তাঁর প্রথম ছবি প্রদর্শন এবং পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছবির প্রদর্শনী হয়। শিল্পী হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ লেখা থেকে গেলেন ছবি আঁকাতে আর অবনীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা থেকে গেলেন যাত্রাপালা-নাটক লেখাতে।
কবিকঙ্কন চণ্ডী, কৃষ্ণ লীলা সিরিজে আমরা দেখতে পাই একেবারে ভিন্ন অবনীন্দ্রনাথকে। উচ্চমার্গীয় শিল্প ভুবন ছেড়ে তিনি নেমে এসেছেন একেবারে নিম্নবর্গীয় মানুষের লোকশিল্পের জগতে। তাঁর লেখার ভুবন এসে মিলেছে যেন ছবির ভুবনে। অবনীন্দ্রনাথ মানব হৃদয়কে একবার ছবি দিয়ে অনুভূতি জাগানোর যেমন চেষ্টা করেছেন, তেমনি অভিনয়ের মাধ্যমেও চেষ্টা করেছেন সাধ্যমতো।
সৌমেন সুর: সৃষ্টির পেছনে বিরাজ করছে স্রষ্টার ইচ্ছে। ভগবানই সৃষ্টির দ্যোতনা এনেছেন। একের পর এক সৃষ্টির পর্ব এসেছে। কোনওটি প্রথমে কোনওটি পরে। এই প্রসঙ্গে ডারউইন থেকে বহুজন ইভল্যুশনের তত্ত্ব দিয়েছিলেন। ডারউইন 'অরিজিন অফ স্পেসিস' একটি সামান্য পর্যবেক্ষণমূলক পরীক্ষার দ্বারা অনুমানের উপর দাঁড় করিয়েছেন সিদ্ধান্তগুলি। ছোট্ট দ্বীপের মাঝে ক্ষুদ্র প্রাণের বেড়ে ওঠা আর ধ্বংস হওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রজাতির পরম্পরা ও চরিত্র নির্মাণ করেছেন। বহু সহস্র বৎসর এই বিশ্বাস বয়ে নিয়ে আসছে যে, সমগ্র সৃষ্টিই ভগবানের দান। তিনি পঞ্চভূত রচনা করে প্রকৃতির মাঝে জীবন সৃষ্টি-ধারণ ও লালনের পটভুমি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির আদি রচনার বীজ মহাকাল স্বয়ং দান করেছেন প্রকৃতির পটভূমিতে।
অন্যদিকে জীবনধারনের জন্য ভোগের বাস্তবিক প্রয়োজন রযেছে। বৈদিক সভ্যতার ঋষিগণ এই সিদ্ধান্তে সকলে একমত হলেন যে, মানবের পক্ষে এক সাযুজ্যপূর্ণ জীবন গড়ে তোলার জন্য চারটি বিভিন্ন বিভাগ প্রয়োজন। এই চারটি বিভাগকে একসূত্রে বেঁধে দিয়েছেন ঋষিগণ। এরা হলো ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ। ধর্মই হতে হবে জীবনের ভিত্তি। ঋষিগণ যখন ছাত্র শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন, সেই শিক্ষার মধ্যে অনেকগুলি বিভাগ ছিল। শিক্ষার প্রথম অঙ্গ হলো চেতনার জাগরণ, মনের মালিন্য দূর করে বিশুদ্ধ মনের অধিকারী হওয়া, আর বিশুদ্ধ চরিত্র গঠন। জগতের প্রতি সহনশীল ও জগতের সমস্ত বস্তু প্রাণের জন্য মনের প্রস্তুতি গড়ে তোলা। (চলবে)
সৌমেন বসু: ১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর, ন্যাশনাল থিয়েটারের 'নীলদর্পন' নাটক মঞ্চস্থ হল মধুসূদন সান্যালের ঘড়িওয়ালা বাড়িতে। তখনকার সময় বাঙালি সমাজ জীবনবোধের এক নতুন সংস্থা পেলো থিয়েটার। এতদিন জমিদার বাড়িতে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য মঞ্চস্থ হতো। কিন্তু শৌখিন থিয়েটার সামাজিক দায়িত্ব পালনে অগ্রণীর ভূমিকায় প্রকাশ পেল। সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে থিয়েটারকে সংযুক্ত করে দেওয়ার প্রয়াস এবং নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে হয়নি তা নয়। তবু অতৃপ্তি ছিল- শখের থিয়েটারের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য তাদের আত্মীয়স্বজন, চেনা পরিচিতজনদের টিকিট ছাপিয়ে নিমন্ত্রণ করতেন।
ফলে অনেক দর্শক টিকিটের জন্য প্রার্থনা করে না পেয়ে বিফল মনোরথে ফিরতেন। এই অতৃপ্তি থেকেই বাংলা থিয়েটার সাধারণের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে। যে কারণেই হোক, ন্যাশনাল থিয়েটার বাংলা থিয়েটারকে স্বাবলম্বী করে তুলেছিল। পেশাদার ভাবে তাকাতে হয়নি থিয়েটারকে। অর্থনৈতিক সুবিধা শিল্পীদের যেমন নাট্যনির্ভর করে তুললো, তেমনি সাধারণ দর্শকের সমাগমে তারা সাধারণ মানুষের প্রাণের কথাকে রূপ দিতে থাকলো।
এবার থিয়েটারের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক বিশেষত স্বদেশ প্রেমের সম্পর্ক হয়ে ওঠে গাঢ়তর। এই সময়ে একের পর এক স্বদেশ প্রেমের নাটক রচিত হয়। (চলবে)
প্রসূন গুপ্ত: বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ রায় কখনও সিনেমার সঙ্গে আপস করতে নিজের ভাবনার বাইরে যাননি। একেক ছবিতে একেক রকম চরিত্র। কিন্তু এই সত্যজিতের, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উপর একটা দুর্বলতা ছিল। তাঁর ছবিতে সৌমিত্র সবথেকে বেশি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। বাংলা সিনেমার মানিকবাবুর মানসপুত্র ছিলেন বড় পর্দার 'অপু'। এমনটাই কানাঘুসো টলিপাড়ায়। অনেকে বলেন, এমন অনেক ছবি ছিল যেখানে হয়তো সৌমিত্রের বিকল্প ছিল। কিন্তু মানিকবাবু মনে করতেন সৌমিত্রের বিকল্প হয় না। সৌমিত্রকে আবিষ্কারও সত্যজিতেরই 'অপুর সংসার' দিয়ে। এরপর আরও ১৩টি, সব মিলিয়ে ১৪টি ছবিতে সৌমিত্র কাজ করেছেন সত্যজিত রায়ের সঙ্গে। এক ফেলুদা ছাড়া আর অন্য কোনও ছবিতে সৌমিত্রের চরিত্রের একটির সঙ্গে অপরটির কোনও মিল পাওয়া যায়নি।
সৌমিত্র জীবদ্দশায় তা বারবার স্বীকার করে বলেছেন যে, মানিকদা তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পিতা, যিনি হাতে ধরে সৌমিত্রকে তৈরি করেছেন। অপুর সংসারে এক অভাগা দরিদ্র যুবক, দেবীতে জমিদারি আমলের এক বিদ্রোহী নাস্তিক, সমাপ্তিতে এমন এক যুবক যে নিজের মর্জিতে চলতে চায়। অভিযানে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার অসামাজিক কাজে যুক্ত হতে গিয়েও ফিরে আসে নিজের আদর্শে। চারুলতার অমল যেন রবি ঠাকুরের ক্ষুদ্র সংস্করণ। কাপুরুষ-মহাপুরুষে এ এক কাপুরুষ যুবক, যে জীবন বোধে পরাজিত। অরণ্যের দিনরাত্রিতে এক উচ্চাভিলাসী বোহেমিয়ান যুবক।
এরপর সত্যজিৎ রঙিন ছবি তৈরি করেন এই সৌমিত্রকে নিয়েই। যদিও তাঁর একসময়ের রঙিন ছবি ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা (এতটাই পয়সা খরচ হয়েছিল যে ইচ্ছা থাকলেও রঙিন ছবি করতে পারেননি)। ছবি অশনি সংকেত, এই ছবিতে সৌমিত্রকে দিয়ে স্বাধীনতা পূর্বে এক পুরোহিতের চরিত্রে কাজ করিয়েছিলেন। এবার পরপর দুটি ফেলুদা, সোনার কেল্লা ও জয়বাবা ফেলুনাথ। যেখানে ফেলুদার চরিত্রে সৌমিত্র ছাড়া কাউকে ভাবতে চাননি সত্যজিৎ। এরপর এলো গুপীবাঘার দ্বিতীয় পর্ব হীরক রাজার দেশে। এখানে সৌমিত্র এক বিপ্লবী পণ্ডিত, যে একনায়ক রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করেন। ফের রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ।
ছবি করলেন ঘরে-বাইরে। এই ছবিতে সৌমিত্র এক ভণ্ড স্বাধীনতা সংগ্রামী। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়েন সত্যজিৎ। কিছুটা সুস্থ হয়ে করলেন একেবারে ইনডোর শুটিংয়ে গণশত্রু, যেখানে সৌমিত্র এক ডাক্তার, যিনি অসামাজিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এই জুটির শেষ ছবি শাখা-প্রশাখা। এক উচ্চ শিক্ষিত মানুষ যিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।
কাজেই সৌমিত্রর জীবনে এত ধরনের চরিত্র এক বিশ্ববন্দিত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে তিনি খাঁটি সোনা থেকেছেন বাংলা চলচ্চিত্রে। আজ বাঙালির অপুর ৮৮ বছর পূর্ণ হল।