আগামি ২০ অগাস্ট অর্থাৎ ১০ দিনের সিবিআই হেফাজতে পাঠানো হল অনুব্রত মণ্ডলকে। গোরু পাচার-কাণ্ডে বৃহস্পতিবার ধৃত বীরভূম তৃণমূলের জেলা সভাপতিকে ১৪ দিনের জন্য হেফাজতে চেয়ে আবেদন করেছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা। এদিন অনুব্রতর আইনজীবী জামিনের আবেদন না করলেও, সিবিআই হেফাজত কমানোর পক্ষে সওয়াল করেন। তিনি আদালতকে বলেন, 'যতটা সম্ভব কমানো হোক তাঁর মক্কেলের সিবিআই হেফাজত। আমরা সহযোগিতা করতে রাজি।' এরপরেই ১০ দিনের পুলিস হেফাজতের নির্দেশ দেন আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক।
এই মামলায় বৃহত্তর ষড়যন্ত্র খুঁজতে অনুব্রত মণ্ডলকে হেফাজতে নিয়ে জেরার প্রয়োজন আছে। এদিন এই সওয়াল সিবিআইয়ের তরফে করা হয়েছে। পাশাপাশি ধৃত অনুব্রত মণ্ডল এদিন এজলাসে বলেন, 'তাঁর ফিস্টুলার সমস্যা আছে। বুকে ব্যথা-সহ নানা শারীরিক ব্যাধি রয়েছে। তাই মহামান্য আদালত যাতে তাঁর দিকটা বিচার করেন।'
তবে এদিন বিকেলে যখন অনুব্রত মণ্ডলকে আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে তোলা হয়, তখন এজলাসে সাংবাদিকদের ঢুকতে বাধা দেন পুলিসকর্মীরা। কোর্টের বাইরে সাংবাদিকদের বের করে ভিতর থেকে কোর্ট গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে কোর্ট চত্বরে উপস্থিত পুলিস আধিকারিক এবং সাংবাদিকদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার পরিবেশও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি এই শুনানি চলাকালীন।
কোনও অনৈতিক কাজ এবং দুর্নীতিকে তৃণমূল (TMC) প্রশ্রয় দেয় না। দুর্নীতির (Corruption) বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দলের। অনুব্রতর (Anubrata Mondal) গ্রেফতারির পর জানাল তৃণমূল কংগ্রেস। বৃহস্পতিবার শাসক শিবিরের তরফে সাংবাদিক বৈঠক করেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য (Minister Chandrima Bhattacharya) এবং প্রাক্তন বিধায়ক সমীর চক্রবর্তী। চন্দ্রিমাদেবী জানান, দলনেত্রী-সহ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করেছেন, মানুষের পক্ষে যা ক্ষতিকর বা মানুষকে যদি কেউ ঠকায়, সেই কাজকে দল সমর্থন করে না। আগে এবং আজও তৃণমূলের এই বিষয়ে অবস্থান একই। মানুষের সমর্থনে তিন বার তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাই মানুষের আশীর্বাদ ছাড়া কোনও সম্পদে তৃণমূলের আর কোনও আগ্রহ নেই।
তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো নিরপেক্ষ চেহারা হারিয়ে ফেলছে। সবার সঙ্গে নিরপেক্ষ ব্যবহার করুক তদন্তকারী সংস্থাগুলো। এটুকু আশা আমরা করতেই পারি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রের শাসক দলের কারও বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দলের পক্ষে কেউ অভিযুক্ত হলে, সেই তৎপরতা দেখা যায় না।' এই অভিযোগ তোলার সময় তিনি সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের তিন বিধায়কের গাড়ি থেকে অর্থ উদ্ধারের প্রসঙ্গ তোলেন। এবং একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়েও ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। এভাবেও ঘুরিয়ে বিজেপিকে কাঠগড়ায় তোলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী।
তাঁর দাবি, 'বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তাঁর বিরুদ্ধে সারদা কর্তার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তারপরেও বিরোধী দলনেতাকে ডাকাডাকি নেই, তাঁর বিরুদ্ধে কোণও কেন্দ্রীয় সংস্থার তৎপরতা নেই। শুধু বিরোধী দলনেতা নয়, তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। কিন্তু ইডি, সিবিআই কেউই তাঁদের তদন্তের আওতায় আনছে না।'
চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য আরও জানান, বিচারব্যবস্থা, মাননীয় বিচারপতি সবার প্রতি আমাদের আস্থা এবং বিশ্বাস আছে। সবদিক খতিয়ে দেখেই বিচারব্যবস্থা পদক্ষেপ নেবে। তৃণমূলের তরফে আগামি দুই দিন সিবিআই-ইডির নিরপেক্ষতা চেয়ে এবং কেন্দ্রের সরকার দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার দাবিতে জেলায় জেলায় মিছিল করবে দল। এদিন জানান চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং সমীর ভট্টাচার্য। পাশাপাশি তাঁরা জানান, অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা? যথা সময়ে সংবাদ মাধ্যম জানতে পারবে। দলনেত্রী এবং শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির আলোচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত হবে। এমনটাই বৃহস্পতিবার জানান চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং সমীর চক্রবর্তী। দুর্নীতিতে কেউ অভিযুক্ত হলে তৃণমূল তাঁকে সমর্থন করবে না। এদিন স্পষ্ট জানিয়ে দেন ওই দুই নেতা।
বার দশেক তলব করার পরেও বীরভূমের 'মুকুটহীন শাহেনশা' অনুব্রত মণ্ডল সিবিআই দপ্তরে যাননি। কেন যাননি, সে প্রশ্ন নিয়ে দ্বিমত আছে। কেউ বলছে চিরকাল রাজ্য পুলিসের উপর দাপট দেখানো অনুব্রত হয়তো ভেবেছিলেন সিবিআইও বোধহয় একই গোত্রের। ভাবেননি যে তাঁকে বাড়ির থেকে তুলে আনা হতে পারে। কিন্তু তাঁর বোঝা উচিত ছিল গত বিধানসভা ভোটের পর ববি হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সহ নেতাদের এই সিবিআই কিন্তু ভোরবেলায় বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছিল। অতএব তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে এমন ধারণাটাই ভুল ছিল। অন্য মত বলছে অনুব্রত হয়তো হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হওয়ার আশংকায় সিবিআই দফতরে যাননি। কিন্তু সকলেরই প্রশ্ন অনুব্রতর মতো প্রভাবশালী ক্ষমতাবান নেতার গ্রেফতারে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হল তৃণমূল?
এই বিষয়ে নিয়েও দ্বিমত আছে। একদল বলছেন, যথেষ্ট ক্ষতি হল, কারণ হিসাবে তারা বলছে, এই অনুব্রতর দাপটে সিপিএম বিজেপি বীরভূমে একঘাটে জল খেত। ২০১১ থেকে ২০২১ এর মধ্যে যত নির্বাচন হয়েছে অনুব্রত প্রমাণ করেছেন তিনি অপরাজেয়। সেন্ট্রাল ফোর্স দিয়েও তাঁকে আটকানো যায়নি। ঘরে বসে ভোটযুদ্ধের অপারেশন চালিয়েছিলেন। দুঃসময়ে অর্থাৎ ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পর্যন্ত বিজেপি এখানে দাঁত ফোটাতে পারেনি। দুটি আসনেই বড় জয় এসেছিল তৃণমূলের। এছাড়া বিধানসভা বা পঞ্চায়েত তো ছিলই। কাজেই তাঁর গ্রেফতারে বীরভূমে শক্তি হারালো তৃণমূল। তারা বলছে পূর্ব মেদিনীপুরের লক্ষণ শেঠ বা উত্তর ২৪ পরগনার মজিদ মাস্টারের দানা ছাঁটার পর দুই জেলাতেই সংগঠনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সিপিএম-র। এঁরা কেউই ঈশ্বর প্রেরিত দূত ছিলেন না।
অন্য একটি তৃণমূল গোষ্ঠীর মতে কেউ আইনের জালে পড়তেই পারে কিন্তু দলটি চলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। অতএব চিন্তার কিছু নেই। সত্যিই কি তার উত্তর দিতে পারবে আসন্ন মানিকতলা উপনির্বাচন এবং তারপরে পঞ্চায়েত নির্বাচন?
কয়লা-কাণ্ডে (Coal CAse) এবার ইডির নজরে রাজ্যের পদস্থ পুলিশ কর্তারা (IPS in Bengal)। অন্তত ৮ জন আইপিএস-কে ১৫ অগাস্টের পর দিল্লিতে তলব করেছে এই কেন্দ্রীয় সংস্থা (ED)। সম্প্রতি কয়লা পাচার-কাণ্ড নিয়ে দিল্লিতে ইডির উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকের পরেই এই পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ওই তদন্তকারী সংস্থা। এমনটাই সূত্রের খবর।
জানা গিয়েছে, আইপিএস জ্ঞানবন্ত সিং থেকে কোটেশ্বর রাও-সহ সুকেশ জৈন, তথাগত বসু, রাজীব মিশ্র-সহ ৮ জনকে তলব করেছে ইডি। ইডি যখন তদন্তের গতি বাড়াতে কয়লা পাচার-কাণ্ডে কোমর বাঁধছে, তখন গোরু পাচার-কাণ্ডে বৃহস্পতিবার সিবিআই গ্রেফতার করেছে অনুব্রত মণ্ডলকে। এদিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ এই মামলায় অভিযুক্ত দেখিয়ে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় সংস্থা। কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্যে তাঁর বাড়ি এবং অফিসে চলেছে তল্লাশি।
বুধবার অনুব্রতকে দশমবার সিজিও কমপ্লেক্সে ডেকে পাঠিয়েছিল সিবিআই। কিন্তু অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সেই হাজিরা এড়িয়ে যান তিনি। এ নিয়ে মোট ৯ বার হাজিরা এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। তারপরেই এদিন সকালে বিশাল কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে বীরভূম তৃণমূলের সভাপতির বোলপুরের বাড়ি ঘিরে এই পদক্ষেপ নিয়েছে সিবিআই।
বারবার সিবিআই হাজিরা এড়াচ্ছেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল (Anubrata Mondal)। কেন্দ্রীয় সংস্থার (CBI) সমন বারবার এড়ানোয় এবার গ্রেফতার হতে পারেন তিনি। এই আশঙ্কায় আগেভাগেই রক্ষাকবচ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) যাচ্ছে অনুব্রত মণ্ডল। শারীরিক অসুস্থতা কারণ দেখিয়ে এই আবেদন করতে চলেছেন রাজ্য রাজনীতির কেষ্ট মণ্ডল। সূত্রের খবর, সিবিআই তাঁকে জেরা করতে পারে, কিন্তু কোনওভাবেই যাতে গ্রেফতার না করে। এই আবেদনই শীর্ষ আদালতের কাছে রাখছেন অনুব্রত মণ্ডল।
এদিকে, তৃণমূল নেতাকে জমি ছাড়তে নারাজ সিবিআই। আইনি পথে তাঁকে আরও কোণঠাসা করতে কোমর বাঁধছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। সুপ্রিম কোর্টে ক্যাভিয়েট দাখিল করছে সিবিআই। সেই ক্যাভিয়েটে সিবিআই অভিযোগ করবে, তদন্তে অসহযোগিতার করছেন তৃণমূল নেতা। তাই যাতে একপক্ষ শুনে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যাতে কোনও নির্দেশ না দেয়।
অপরদিকে, চিকিৎসার জন্য অনুব্রত মণ্ডলকে চেন্নাই যাওয়ার পরামর্শ দিলেন শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজের পরিচালন সভাপতি মলয় পিট। দেশের বিখ্যাত সার্জেন জে এস রাজকুমারের কাছে চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে অনুব্রত মণ্ডলকে। যদিও এই পরামর্শের পাল্টা কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
জানা গিয়েছে, বহুদিন ধরে পাইলসের সমস্যায় ভুগছেন অনুব্রত মণ্ডল। কোথায় সেটা অপারেশন করলে ভালো হয়, তার আলোচনার জন্য শান্তিনিকেতন মেডিকেল কলেজের সভাপতি মলয় পিটকে বাড়িতে ডেকে পাঠান অনুব্রত। তখনই এই পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এমনকি বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা চাইলে শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন মলয়বাবু।