সৌমেন সুর: জেল থেকে মুক্তির পর কল্পনা দত্ত রবীন্দ্রনাথ ও দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। উত্তরের রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'তোমার চিঠি পেয়ে আমি খুশি হয়েছি। দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর তুমি মুক্ত হয়েছ। তুমি এখন দিনে দিনে শান্তি ও শক্তি লাভ করো। আমাদের দেশে অনেক কাজ করার আছে। তার জন্য দৃঢ়তা ও সুনিয়ন্ত্রিত মন থাকা চাই। দুঃখ ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতাই তোমার জীবন পূর্ণতা লাভ করুক। এই আমার আশীর্বাদ তোমার শুভার্থী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।' জেলে থাকাকালীন তিনি সংকল্প করেন দেশের জন্য মাস্টারদা তারকেশ্বর দস্তিদার এবং বহু কর্মী প্রাণ দিয়েছেন, তাদের অসমাপ্ত কাজ সম্পাদন করবেন তিনি।
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তার ওপর পুলিশের নির্দেশ জারি হল, ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে কলকাতা ছাড়তে হবে। তিনি চট্টগ্রাম ফিরে যেতে বাধ্য হন। চট্টগ্রামে তখন জাপানি বোমা পড়ছে। বার্মা থেকে দলে দলে কেউ হেঁটে, কেউ নৌকায় চেপে ভারতের চলে আসছে। অন্য জেলার লোকও চলে আসছে। এদিকে জীবনযাত্রার মানও গেছে পাল্টে। চট্টগ্রামে যুদ্ধের জন্য ব্রিটিশ-আমেরিকান, আফ্রিকান ও ভারতীয় সৈন্য ছেয়ে গেছে। দিনকে দিন জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। মিলিটারি রাস্তা বাধার জন্য জমি অধিগ্রহণ করছে। এদিকে খাদ্যের সন্ধানে দলে দলে মানুষ শহরের পথে ঘাটে আশ্রয় নিয়েছে। কত মানুষ না খেতে পেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে আছে। দুটো ভাত দাও ফ্যান দাও-এর কান্না ভেজা গলা। বিচলিত মানুষ। এই সবকিছু সাক্ষী কল্পনা দত্ত। পুরোপুরি সেবায় নিয়োজিত করলেন নিজেকে। খাওয়া, চিকিৎসা এমনকি নৈশ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা সমস্ত কাজ করতে লাগলেন।
এরপর দেশভাগের পর ভারতে চলে আসতে বাধ্য হলেও এবং চাকরি গ্রহণ ছাড়া বাঁচার পথ না থাকলেও, তিনি শিক্ষামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রুশ ভাষা শিক্ষায়তনের দায়িত্বে কাজ করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী কল্পনা দত্ত পড়াশোনা করতেন বিস্তর। দেশ বিদেশের প্রচুর নামিদামি লেখক এর বই পড়তেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে 'বীরকন্যা' রূপেই চিহ্নিত হয়ে আছেন কল্পনা দত্ত। তথ্যঋণ- কল্পতরু সেনগুপ্ত
সৌমেন সুর: ১৯৩২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবের কাছে পুরুষের বেশে কয়েকজন সঙ্গীসহ আটক করা হয়। পুলিশ তাদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহ না করে প্রেমঘটিত ব্যাপার মনে করে। যখন সনাক্ত হন যে তিনি রায়বাহাদুরের নাতনি, তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রী পুলিশ দ্বিধায় পড়ে যায়। কিন্তু ছেড়ে দেয় না, অপরাধীর মতন ১০৯ ধারায় অভিযুক্ত করে জামিন দেয়। এর সাত দিন পর ২৪শে সেপ্টেম্বর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ হয় প্রীতিলতা ওয়েদেদারের নেতৃত্বে। এই প্রথম একজন মহিলার নেতৃত্বে বৈপ্লবিক আক্রমণ হলো। এই ঘটনায় সারাদেশের ছাত্রীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ বিরোধী অকুতোভয় যোদ্ধা এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম সদস্যা কল্পনা দত্ত ছিলেন বীর কন্যা। মাস্টারদা সূর্যসেনের প্রিয়পাত্রী ও রবীন্দ্রনাথের কন্যাসম ছিলেন তিনি। ১০৯ ধারায় মামলা চলাকালীন ডিসেম্বর মাসে মাস্টারদা নির্দেশ পাঠালেন কল্পনা দত্তকে আত্মগোপন করতে হবে। যদি না করে তাহলে তাকে বিনা বিচারে জেলে আটক করবে। এই কথা শোনা মাত্র তার নতুন জীবন শুরু হয়। আজ এ গ্রাম, কাল অন্য গ্রাম করতে থাকে। সুখে থাকা মেয়ে কৃষকের বাড়িতে মোট চালের ভাত খাচ্ছে। ছেঁড়া কাঁথায় ঘুমোচ্ছে। তাঁর জীবনে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ১৯৩৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি। গৈরলা গ্রামে ক্ষিরোধ প্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন মাস্টারদার সঙ্গে। রাত ৯টা নাগাদ বুঝতে পারলেন মিলিটারি চারদিকে ঘিরে ফেলেছে। সবাই বেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। গুলি বিনিময় শুরু হয়। অবশেষে মাস্টারদা ধরা পড়েন। আর কল্পনা দত্ত পাশের গ্রামে এক কৃষকের ধানের গোলায় আশ্রয় নেন। এদিকে কল্পনা দত্তের বিরক্ত কাহিনী গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩৩ সালে জুন মাসে শুরু হয় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের দ্বিতীয় সাপ্লিমেন্টারি ট্রাইবুনলি। ১৪ই অগাস্ট রায় হয় সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি। কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দ্বীপান্তর। মৃত্যুদণ্ড না দেবার কারণ তিনি নারী এবং বয়স কম। তথ্যঋণ- কল্পতরু সেনগুপ্ত
সৌমেন সুর: মেদিনীপুরের মেয়ে সৌদামিনী। আইন অমান্য আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৩২ সালের ১১ ডিসেম্বরে বাগবাজারে সভা করতে যাওয়ার সময় পুলিশ লাঠি চালায় তাঁদের উপর। সৌদামিনীকে রাস্তা দিয়ে টেনে-হিচঁড়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময়, পুলিশের সামনেই চিৎকার করতে করতে দেশবাসীর উদ্দেশে দৃপ্তকন্ঠে বলেছিলেন, প্রতিটা জিনিস কেনার সময় চিন্তা করে দেখবেন সেটা ভারতে তৈরি কিনা।
শুধু তাই নয়, বিচারের সময় তিনি বিচারককে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, আইন ভাঙলে আপনারা যাকে খুশি গ্রেফতার করতে পারেন। কিন্তু মহিলাদের প্রতি পুলিশ খারাপ কথা বলতে পারে কোন আইনে? জনতার উপর লাঠি চালানো হয় কোন আইনে? তাঁর প্রশ্নের কোনো উত্তর বিচারকের কাছে ছিল না। তবুও বিচারক তাঁকে ছ'মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
চামেলী গুপ্ত কলকাতার নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি বড়বাজারে শোভাযাত্রা, পিকেটিং করতেন পুরুষদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে। বড়বাজার বিলাতি বস্ত্রের ব্যবসায়ীরা রীতিমত ভয় পেতো এই উত্তরপ্রদেশের কন্যাকে দেখে। তিনি গর্ভবতী অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। সরকার থেকে বন্ড লিখতে বললেও তিনি রাজি হননি। তাই ছাড়া পাননি।
জেলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন চামেলী। জেলের মধ্যে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর শরীর আরও খারাপ হলে,সরকার বিনা শর্তে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যায়। কয়েকদিন পরে চামেলী ও শিশু পুত্র মারা গিয়েছে। দেশের জন্য তাঁর এই আত্মত্যাগের কথা না খাতাতে, না স্মৃতিতে কোথাও নেই। তথ্যঋণ: সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪১-১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ এই দু-তিনটি বছরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং পরে ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা যখন নিষ্ফলা, তখন জাতীয় কংগ্রেস ১৯৪২ সালে ৮-ই আগস্ট বোম্বাই অধিবেশনে 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন'-র প্রস্তাব গৃহীত হয়। তখন হিটলারের আক্রমনে ফ্রান্স-ব্রিটেন বিধ্বস্ত। অন্য়দিকে হিটলারের মিত্র শক্তি জাপান পার্ল হার্বার আক্রমণ করেছে। ফলে যুদ্ধের পরিধি দঃপূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত। ভারতের ব্রিটিশ সরকার তখন বিপর্যস্ত।
এদিকে 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন' যেটা গান্ধিজি স্বাধীনতার অন্তিম যুদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। তাঁর এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার দিন মধ্য়রাত্রে বোম্বাইতে উপস্থিত সব নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়েছিলেন। কলকাতায় দাদাভাই নৌরজির দৌহিত্রী খুরশেদ বেন, নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। বোম্বাই নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের পর সে শহরে ব্য়াপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় বহু স্বেচ্ছাসেবক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য় প্রস্তুত। এখানে একজনের নাম করতেই হবে-তিনি হলেন সরলা বেন। ইনি ১৯৪২-এ লরি ভর্তি স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকাদের নিয়ে আন্দোলন করে কারাবরণ করেন। (চলবে)
সৌমেন সুরঃ ছোটগল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে দৌলতউন্নিসার বিশেষ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'পরশপাথর'। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যুক্ত হন দৌলতউন্নিসা। ওঁর শ্বশুরবাড়ি গাইগান্ধা। গাইগান্ধা মহিলা সমিতির সম্পাদক তিনি। তাঁর জ্বালামুখী বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে ৭/৮ গ্রামের মেয়েরা, এমন কি মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েরা পর্দা সরিয়ে ছুটে আসত তাঁর সভায় যোগ দিতে। রাগে-ক্ষোভে ব্রিটিশ পুলিসরা যোগদানকারীদের বসত বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দিত। তবু দৌলতকে দিমিয়ে রাখতে পারেনি। সভার পর সভা করে গেছিলেন। অবশেষে পুলিস ফুলছড়ি গ্রামের সভা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকায়। তবু আন্দোলন থেমে থাকেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম মেয়েরাও যে ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে প্রতিবাদ করতেন তার প্রামাণ দৌলতউন্নিসা।
অথচ ওঁর ত্যাগ, সংগ্রামী চেতনা, নাম, আমরা কজনই বা জানি। ইতিহাসের অন্তরালে হারিয়ে গেছে এমন অনেক অজানা আত্মত্যাগী মানুষ। যখন পুলিস দৌলতউন্নিসাকে ধরে, তখন তাঁর শাস্তি ছিল এমন, রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি, বহরমপুর প্রভৃতি জেলে তাঁকে পাল্টে পাল্টে রাখা হতো। যাইহোক দৌলতউন্নিসা যে ব্রিটিশদের একসময় ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল, একথা প্রমাণিত সত্য। শুধু মুসলিম পুরুষরা নয়, মেয়েরা স্বাধীনতা সংগ্রামে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। (সমাপ্ত)
তথ্যঋণ: সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার মেয়েদের বাড়ির সদর দরজার বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তাঁরা পর্দাসীন ছিল। তবু শত শত নারী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিল স্বাধীনতার নিরিখে। নিজেদের নাম, যশ, মোহ ত্যাগ করে স্বাধীনতার সংগ্রামে জড়িয়েছিলেন বহু নারী। তৎকালীন সমাজে কোণঠাসা হয়ে থাকা মেয়েরা নিজের নিজের জায়গা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজ করেছেন গোপনে বা প্রকাশ্যে। কেউ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ প্রাণ দিয়েছেন, কেউ বা ব্রিটিশ পুলিসের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রাণকে আত্মহুতি দিয়েছে দেশমাতৃকার চরণে। প্রথম পর্বের পর...
সত্যবতীকে পুলিস জেলে চালান করে। তিন মাস জেল খেটে মুক্তি পেয়ে আবার দেশের হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনে নেমে পড়েন। ১৯ ফেব্রুয়ারি নন্দীগ্রামে এক রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে গিয়ে আবার গ্রেফতার হন সত্যবতী। এদিকে সূত্র মারফৎ পুলিস জানতে পারে সত্যবতী গোপনে খবর চালান করে বিপ্লবীদের। যার ফলে পুলিস ঘটনাস্থলে পৌছনোর আগেই বিপ্লবীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হত। এই খবর জানতে পেরে পুলিস সত্যবতীর উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। অত্যাচারের ফলে সত্যবতীর কিডনি ও অন্ত্র খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালে এই ক্ষতের চিকিৎসা সম্ভব হয়নি। ফলে সত্যবতী শহিদ হন।
দেশের কাজে তাঁর আত্মত্যাগ ভোলা সম্ভব নয়। তবু দেশের স্বাধীনতার কাজে তাঁর ভূমিকা আজও মানুষের কাছে অধরা হয়ে আছে। কজনই বা তাঁকে আমরা স্মরণ করি। এবার আপনাদের সামনে হাজির করছি বিপ্লবি দৌলতউন্নিসাকে। ইনিও হারিয়ে গিয়েছে অবহেলার স্রোতে। ছোট বয়স থেকে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই তিনি লিখতে শুরু করে যশোরের এই প্রতিভাবান ছাত্রী। ঢাকার ইডেন স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন। এছাড়া দেশ, বঙ্গশ্রী ও বিচিত্রা পত্রিকায় তিনি লেখালেখি করতেন। তখনকার দিনে মেয়েদের পড়াশোনা এমনকি কোনও সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকা সমাজ পছন্দ করতো না। তাছাড়া মুসলমান সমাজের কোনও মেয়ে পড়াশোনা করে উন্নতি করুক এটা তখনকার সময়ে সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল। কিন্তু দৌলতউন্নিসার বাবা, মা এবং স্বামীর সমর্থনে পড়াশোনার দরজা খুলে যায়। (চলবে)
তথ্যঋণ: সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার মেয়েদের বাড়ির সদর দরজার বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তাঁরা পর্দাসীন ছিল। তবু শত শত নারী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিল স্বাধীনতার নিরিখে। নিজেদের নাম, যশ, মোহ ত্যাগ করে স্বাধীনতার সংগ্রামে জড়িয়েছিলেন বহু নারী। তৎকালীন সমাজে কোণঠাসা হয়ে থাকা মেয়েরা নিজের নিজের জায়গা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজ করেছেন গোপনে বা প্রকাশ্যে। কেউ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ প্রাণ দিয়েছেন, কেউ বা ব্রিটিশ পুলিসের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রাণকে আত্মহুতি দিয়েছে দেশমাতৃকার চরণে।
আজ এমনই একজন দেশপ্রেমী নারীর কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করব, যার নাম আমরা অনেকেই জানি না। মেদিনীপুর জেলার বাসিন্দা হলেন সত্যবতী। বিধবা এই অসহায় মহিলাকে কিছু স্বার্থপর মানুষ কার্যসিদ্ধির জন্য তাঁকে দেহপসারিণী করে তুলেছিল। এই বিভীষিকাময় জীবন মেনে নিলেও সত্যবতীর মন পড়েছিল পরাধিন দেশকে কীভাবে শৃঙ্খলমুক্ত করা যায়। তাঁর ঘরে নিত্য আসা এক গ্রাহক পুলিস অফিসারের থেকে তথ্য নিয়ে পাচার করেন বিপ্লবীদের ম্যাসেঞ্জারকে। প্রত্যেকবার পুলিস পৌছনোর আগেই ডেরা থেকে পালিয়ে যায় বিপ্লবীরা।
এদিকে শুধু গোপন খবর দিয়ে সত্যবতী ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩২-র ১১ ফেব্রুয়ারি তেরপেখিয়া বাজারে মদের দোকানের সামনে পিকেটিং করার সময় পুলিসের লাঠির ঘায়ে গুরুতর আহত হয়ে জ্ঞান হারান। (চলবে)
তথ্যঋণ: সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: আমরা কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করলাম অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের থেকে, সে ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মকে জানতে হবে। তারা সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হোক- যে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হবে তাঁদের প্রাণ, তাঁদের মন। এসব জানতে হলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তাঁদের পড়তে হবে, ভাবতে হবে, লিখতে হবে। এমন অনেক বিপ্লবী আছেন, যাঁদের নাম বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে গিয়েছে। আবার অনেক নাম আছে যাঁদের স্মরণ করলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়। প্রথম পর্বের পর...
১৭৭৫ সালে ৫-ই অগাস্ট কলকাতার রেসকোর্সে কাছে কুলিবাজার মোড়ে বর্তমান বিদ্যাসাগর সেতুর প্রান্তে প্রায় ৩০০ বছর আগে মহারাজা নন্দকুমারকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লার পতন হয়। সেই সময় দিল্লির বাদশাহ ছিলেন শাহ আলম। সিরাজদৌল্লার পতনের পর নতুন নবাব হন মীরজাফর দিল্লির বাদশাহের কাছে সুপারিশ করে 'মহারাজ' বিশেষণে ভূষিত করেন।
মহারাজা নন্দকুমার প্রকৃত অর্থে একজন দানশীল মহৎপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। বাংলার মানুষের কাছে তিনি ভীষণ জনপ্রিয় মানুষ। তারপরেও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ফাঁসি দিয়েছিল। সাড়া বাংলা জানে তিনি নির্দোষ। তবু এই নির্মম পরিহাস তাঁকে বরণ করতে হয়েছিল। যাইহোক এই সংগ্রামী মানুষদের কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। এঁরা সকলেই আমাদের কাছে প্রণম্য, বরেণ্য ও চিরস্মরণীয়।
তথ্যঋণ: ড. ত্রিগুণা চট্টোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: আমরা কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করলাম অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের থেকে, সে ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মকে জানতে হবে। তারা সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হোক- যে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হবে তাঁদের প্রাণ, তাঁদের মন। এসব জানতে হলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তাঁদের পড়তে হবে, ভাবতে হবে, লিখতে হবে। এমন অনেক বিপ্লবী আছেন, যাঁদের নাম বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে গিয়েছে। আবার অনেক নাম আছে যাঁদের স্মরণ করলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।
মা এবং মাতৃভূমির ঋণ কখনও শোধ করা যায় না। যারা পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশমাতৃকার চরণে। তাঁরা আমাদের কাছে মহান, চিরঋণী। আসলে আমাদের সঠিক স্বাধীনতার ইতিহাস না জানার ফলে আমরা আত্মমুখী ও ভোগবাদী হয়ে উঠছি। দেশের জন্য আমাদের একটু স্বার্থত্যাগ আর অপার ভালবাসা না থাকলে সোনার ভারত গড়ে উঠবে কীভাবে!
আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত বাঙালি একজনকে। যার নাম মহারাজ নন্দকুমার। ব্রিটিশদের কাছে তিনি ছিলেন নান কুমার। সত্তর বছর বয়সেই দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় ফাঁসিতে তাঁর প্রাণ দিতে হয়েছিল। (চলবে)