সৌমেন সুর: অন্নপূর্ণাদেবী ছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র ছোট মেয়ে। তাঁর আসল নাম রোশনারা আলি। মহারাজা ব্রিজনাথ সিংয়ের রাজসভার প্রধান সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। মহারাজা উস্তাদের মেয়ের নাম রাখেন অন্নপূর্ণা। যখন এই কন্যার জন্ম হয়, তখন সারাদেশজুড়ে চলছে দুর্ভিক্ষ। সনাতন ধর্মমতে অন্নপূর্ণাদেবী হলেন অন্নদাত্রী। তাই মহারাজা নাম দেন অন্নপূর্ণা। আলাউদ্দিন রাজার দেওয়া নাম বাদ দেননি। তাই তার নাম রওশন আরা অন্নপূর্ণাদেবী। ছোটবেলা থেকেই অন্নপূর্ণাদেবীর সংগীতের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। এ নিয়ে সংসারে প্রচণ্ড অশান্তিও হয়। সেই সময় রাজদাসী, দেবদাসী, বারাঙ্গনা ছাড়া কোনও সাধারণ নারী সংগীত পরিবেশন করবেন, এ কথা ভাবাই যেত না। অগত্যা আলাউদ্দিন মেয়েকে তালিম দিলেন না।
কিন্তু অন্নপূর্ণা লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়ের তালিম দেওয়া দেখাতেন আর সেটি রেওয়াজ করতেন। পরে আলাউদ্দিন মেয়ের প্রতিভা দেখে, ওকে তালিম দেওয়া শুরু করলেন প্রথমে ধ্রুপদী কন্ঠসংগীতের তালিম, পরে সেতার শেখেন অন্নপূর্ণাদেবী। উস্তাদ আলাউদ্দিনের কাছে সংগীতের তালিম নিতে আসেন রবিশংকর। এখানে অন্নপূর্ণাদেবীর সঙ্গে রবিশংকরের আলাপ হয়, পরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। সেতার বাজনায় অন্নপূর্ণাদেবীর নাম সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ভালবেসে আনন্দে অন্নপূর্ণাদেবীকে মুর্তিমতী সরস্বতী বলে আখ্যা দেন।
এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কি হতে পারে। ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর তিনি মারা যান। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই অসম্ভব প্রতিভাময়ী শিল্পীর ঠিকমতো মূল্যায়ন আমরা করে উঠতে পারলাম না। অন্নপূর্ণাদেবী ছিলেন প্রচার বিমুখ। পণ্ডিত রবিশংকরের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয় ১৯৬২ সালে। এরপর থেকেই তিনি অন্তরালে নিভৃত জীবনযাপন করেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সংগীতানুষ্ঠান করার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তবে বদ্ধ জীবনযাপনে তাঁর সাধনা থেমে থাকেনি। দেশের বহু প্রথম সারির শিল্পী তাঁর শিষ্য ছিলেন। যেমন পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জী, ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ, ওস্তাদ আশিস খাঁন, পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া প্রমুখ।
প্রসূন গুপ্ত: দুর্গাপুজো কালীপুজোর পর এক মস্ত বিরাম। তারপর শীতের শেষে আসে সরস্বতী পুজো। যদিও বলা হয়ে থাকে যে এটা আদতে ছাত্রছাত্রীদের পুজো। কিন্তু বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে পুজো হয়ে থাকে। কারণ সরস্বতী বাগ্দেবী, গান-বাজনার আসরে যাবো আর সরস্বতী বন্দনা থাকবে না, তাই কি হয়? কিন্তু বিভিন্ন ক্লাবেও ঘটা করে সরস্বতী পুজো হয় নিয়মিত। তৃণমূল সরকার হওয়ার পর এই পুজো তো সমস্ত নেতাই নিজ নিজ এলাকায় করে থাকেন। ব্যতিক্রম নয় বিজেপির নেতা, বিধায়ক-সাংসদরাও। যে যেখানে যেভাবে পারেন পুজো করেন।
বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী ২৬ জানুয়ারী হওয়াতে প্রথমে রেড রোডে ছিলেন। কুচকাওয়াজে পরে চলে যান তাঁর কলেজ, যোগমায়া দেবীতে। এখান থেকেই স্নাতক হয়েছিলেন তিনি। ছাত্রছাত্রীদের পুজো-খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা খবর নিয়েছেন। মদন মিত্রকে দেখা গিয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজের বাইরে। কলেজের বাইরে পুজো হচ্ছে, কারণ কলেজে পুজো হয় না, ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে এটাই প্রেসিডেন্সির দস্তুর। যদিও তৃণমূল ছাত্ররা চেয়েছিল পুজো কলেজেই হোক কিন্তু দলের সায় ছিল না।
মদন উপস্থিত হওয়াতে ফের নতুন বিতর্ক। কারণ তিনি ওই কলেজের প্রাক্তনীও নয়।
বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বাড়িতে নিয়মিত বাগ্দেবীর আরাধনা করে থাকেন, তিনি অধ্যাপকও বটে। কিন্তু এবার ধুমধাম করে পুজো করলেন সুকান্ত। তাঁর ছোট মেয়ের হাতেখড়ি হল এদিন। রাজ্যপাল জানতে পেরে সুকান্তর কন্যাকে উপহার পাঠিয়েছিলেন। নেতারা পুজো করলেও 'খবরে' থাকার মতো বিশেষ কিছু নয় ব্যতিক্রম অরূপ বিশ্বাস। প্রতি বছর তাঁর নিজের টালিগঞ্জের অফিসে ধুমধাম করে পুজো করেন এবং নিমন্ত্রিত থাকে বিধাসভার প্রত্যেক মানুষ। দুপুরে কয়েক হাজার মানুষ একসঙ্গে খিচুড়ি, তরকারি, বেগুনি, মিষ্টি পায়েস ইত্যাদি ভোগ খেয়েছেন। উপস্থিত থাকেন টলিউডের শিল্পী-কলাকুশলীরা। ব্যতিক্রম নয় এবারও।
তবে সেরা খবর রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের 'হাতেখড়ি'। মুখ্যমন্ত্রী-বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে রাজ্যপাল বাংলা হরফে লিখলেন। আগামী ৫ বছরে বাংলা শিখে বই লেখার ইচ্ছা আছে তাঁর।
২৬শে জানুয়ারি ২০২৩ দেশের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসের পাশাপাশি সরস্বতী পুজো (Saraswati Puja 2023)। বাংলার বিদ্যালয়ে সকাল থেকেই বাগদেবীর আরাধনা তুঙ্গে। অনেকে আবার এদিনকে বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে-ও বলে। পড়ুয়া-কচিকাচাদের মধ্যে এই দিন অন্য উন্মাদনা। বৃহস্পতিবার হঠাৎই পুজোর সামগ্রি এবং মিষ্টি নিয়ে যোগমায়া দেবী (Jogmaya Devi College) কলেজে উপস্থিত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee)। এদিন অন্য মুডেই পড়ুয়াদের সঙ্গে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। দেবী সরস্বতী বন্দনায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। 'আকাশ ভরা সূর্য তারা গানে' গলা মেলান পড়ুয়াদের সঙ্গে।
ছাত্র-ছাত্রীদের আগামি, শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক, এদিন সেই প্রার্থনা করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি এদিন স্ত্রী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়ের নাচের স্কুলে খোশ মেজাজে ছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। দীক্ষা মঞ্জরীর সরস্বতী পুজো এবছর কুড়ি বছরে পদার্পণ করলো। সকাল থেকেই স্কুলে ছাত্রীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতোন। পুজোর শেষ দিকে সৌরভ অঞ্জলি দিলেন খোশ মেজাজে।
এদিকে, ওস্তাদ রশিদ খান নিজের বাড়িতে সরস্বতী পুজো আয়োজন করেছিলেন। উপস্থিত ছিলেন তাঁর পরিবার। এছাড়াও রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিম; বাণী বন্দনার আয়োজন করেছিলেন। বাংলার ছোট পর্দা এবং চলচ্চিত্রের পরিচিত মুখ চৈতী ঘোষাল এবং ইন্দ্রানী দত্তের বাড়িতেও ধুমধাম করে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল।
সৌমেন সুর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর মনের গভীরে বারেবারে অনুরনন তুলে চলেছে রামায়ণ মহাকাব্য। তাকে তিনি নবভাষ্যে উপস্থাপিত করতে চান, তা কী করে সম্ভব! কিন্তু মহাকাব্যকে যে ভাস্কর করে তুলতেই হবে। শুরু হল আধুনিক মহাকাব্যের কথন। 'মেঘনাদবধ কাব্য'। মাইকেল জানতেন, দেবী সরস্বতীর বরে বাল্মিকী কবিত্বশক্তি লাভ করেছিলেন। মহামূর্খ কালিদাসও হয়ে উঠেছিলেন মহাকবি। তাই কাব্যের সূচনায় দেবীর কাছে কৃপা প্রার্থনার মাধ্যমে শুরু করলেন তাঁর কাব্য। 'আমি ডাকি আবার তোমায়/শ্বেতভূজে ভারতী। যেমনি মাতঃ বসিলা আসিয়া/বাল্মিকীর রসনায়/তেমতি দাসেরে আসি দয়া কর সতী'। কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা দেবী সরস্বতীর বরপুত্র বা বরপুত্রী। তাই অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের যাত্রাপথে চলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমরা তাঁর আরাধনা করে আসছি।
আজ বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পুজো। সেই পলাশপ্রিয়ার আরাধনায় মেতে উঠেছে সকলে। 'জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে....'। এই মন্ত্রে প্রদান করা হচ্ছে অঞ্জলি। মা সরস্বতীর উৎস সন্ধানে গেলে অনেক সৃষ্ট তত্ত্ব মেলে। কখনও তিনি ব্রহ্মার কন্যা কখনও শিবের কন্যা, কখনও তিনি দক্ষরাজ কন্যা। আবার তার স্বামী হিসেবেও অনেককে পাওয়া যায়। কখনও তিনি ব্রহ্মার ঘরনী, কখনও তিনি নারায়ণের জায়া আবার কখনও তিনি কাশ্যপ মুনির পত্নী। তাঁর উৎস সম্পর্কিত একটি কাহিনী থেকে জানা যায়, ব্রহ্মা পৃথিবীতে সৌন্দর্য ও জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে সৃষ্টি করেছিলেন সরস্বতীকে।
একদিন বললেন 'যাও তুমি জগৎকে আলো দেখাও। কাব্য শাস্ত্র সৃষ্টি করো জগৎকে জ্ঞানে পূর্ন করো'। তারপর তো ইতিহাস। বাংলা এখন ভগবতী ভারতীর পুজো প্রস্তুতিতে মগ্ন। আমাদের অফিস CTVN ও CN-এর প্রত্যেক কর্মী বীনাদেবীর আরাধনায় ব্যাপ্ত। সবাই যেন বলবে- 'বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে। ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তে।' মা তোমার চরণে শতকোটি প্রণাম।
কাল বসন্ত পঞ্চমী। চারিদিকে ছড়িয়েছে বীণাপাণির আগমনী সুর। পুজোর কেনাকাটা প্রায় শেষের মুখে। পুজো উপলক্ষে ভিড় উপচে পড়ছে বাজারগুলিতে। প্রতিমা কেনার পাশাপাশি ভিড় জমেছে ফল-ফুলের বাজারে। যেহেতু কমবেশি সব স্কুলে সরস্বতী পুজো হয়, তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাজারে বেড়িয়েছেন। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ছে বাজারে। অপরদিকে কেউ কেউ বলছেন বাজার যথেষ্টই অগ্নিমুল্য। ক্রেতারা জানান, 'ফুলের মালার দাম তুলনায় বেড়েছে। ফলের দামও প্রতি কেজিতে ২০-৩০ টাকা করে বেড়েছে।'
একনজরে ফলের দাম:
কুল:৮০/কেজি
শশা: ৫০/কেজি
শাকালু:৫০/কেজি
আপেল:১০০/কেজি
পেয়ারা:৮০/কেজি
কমলালেবু:১৫/পিস
কলা:৪/পিস
খেজুর:১০০/কেজি
আঙুর:৯০/কেজি
সবেদা:৭/পিস
পেঁপে:৬০/কিলো
দাম বাড়লেও পুজোর বাজারে কোনও ত্রুটি রাখতে চাইছেন না ক্রেতারা। আবার অনেকে দামের জন্য ফল-ফুল পরিমাণ তুলনায় কম নিচ্ছেন। তবে বিক্রেতাদের মুখে খুশির হাসি, তাঁরা জানান,'সকাল থেকে বিক্রি ভালোই চলছে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে ভিড়ও বাড়ছে। দাম ঠিকই আছে।'
বিক্রেতারা কিন্তু এ-ও জানান, সরস্বতী পুজোয় প্রত্যেকবারই ভালো বিক্রি হয়। এবারও তার অন্যথা হয়নি। এমনকি করোনাকালেও তাঁদের বিক্রি মোটের উপর ভালোই ছিল।
সবে মাত্র মাঘের শুরু তাতেই বাংলার আকাশে-বাতাসে উধাও শীতের (Winter) কনকনে ভাব। উত্তুরে হাওয়ার যা মতিগতি সরস্বতী পুজোয় (Saraswati Puja) খানিকটা উষ্ণতাকে সঙ্গী করেই বিদ্যা দেবীর আরাধনা করতে হবে। পূর্বাভাস মেনে কলকাতার পারদও ঊর্ধ্বমুখী বুধবার সকালে। এদিন শহরের (Kolkata Winter) সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের থেকে ৪ ডিগ্রি বেশি। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা স্বাভাবিকের থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি বলে আলিপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে খবর। তবে সকাল থেকে শহর, শহরতলি এবং জেলার বিভিন্ন অংশ কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গেই রোদের মুখ দেখেছে বঙ্গবাসী। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর বা দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই বলেই খবর।
এদিকে, শীত উধাওয়ের দুঃসংবাদ শুধু শহর কলকাতার জন্য নয়, পশ্চিমের জেলাগুলিতেও ঠান্ডার আমেজ কমেছে। তবে উত্তরবঙ্গের মানুষ কিছু দিন ঠান্ডার আমেজ পাবেন বলে সূত্রের খবর।
আবহবিদদের পূর্বাভাস, উত্তর-পশ্চিম অংশে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা এবং বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট বিপরীত ঘূর্ণাবর্তের জেরে বাংলায় জলীয় বাষ্প ঢুকেছে। ফলে উত্তুরে হাওয়ার দাপট কমতে শুরু করেছে। সেই কারণেই কলকাতা-সহ রাজ্যের একাধিক জেলায় তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে হাওয়া অফিস জানিয়েছে।