প্রসূন গুপ্ত: সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদল থেকে নব সংগঠন অনেক কিছুই হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের ভাবনা এখন বেশ কিছুটা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরেই ন্যস্ত। অভিষেকের উপর ভরসা দলের বিভিন্ন শাখার এমনকি আস্থা দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অনেক নেতা বা বিধায়ক বা সাংসদ সময় বুঝে নিজেদের জায়গা ঠিক করে নিচ্ছেন। এটা তো বাস্তব মমতার পরে গ্রহণযোগ্যতায় অভিষেকই আসেন। সম্প্রতি নানান উপনির্বাচন বা পঞ্চায়েত ইত্যাদি নির্বাচনে অভিষেকের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। সেই অভিষেক সম্প্রতি মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করলেন যে মহুয়া মৈত্রর পাশে তিনি বা দল রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে মহুয়ার ভূমিকা নিয়ে মহাবিতর্ক যে শুরু হয়েছে এবং যে ভাবে বিরোধী প্রায় সমস্ত দল তাঁর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে তাতে তৃণমূলের মুখ বুজে থাকাটা বোধহয় খারাপ বার্তা যাচ্ছিলো দলের কর্মীদের কাছে ফলে মহুয়াকে শুধু সমর্থন নয় তাঁকে দায়িত্ব দিলো দল।
সংসদের গোপনীয়তা প্রকাশ ঘটনায় কেন্দ্রে বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার মোটামুটি কোমর বেঁধে নেমেছে মহুয়াকে লোকসভার থেকে বহিষ্কার করার কাজে। সংসদের গোপনীয়তা ঘটনা যে সঠিক এমন আইনি বাস্তবতা না থাকলেও ওই কাজটি যে আপাতত প্রয়োজনে প্রায় সব সাংসদরাই করে থাকেন এমন উদাহরণ মহুয়া সহ বিরোধী দলের অনেকেই জানিয়েছেন কিন্তু প্রাথমিক ভাবে দলের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে তৃণমূল ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনও শব্দই উল্লেখ করে নি। হয়তো অবস্থা কোন দিকে যায় সে দিকেই নজর রাখছিলো। কিন্তু গোল বাঁধলো যখন মহুয়াকে সংসদের বিশেষ কমিটি তাঁকে ডেকে এক প্রকার অপমান করলো ( বিরোধীদের বক্তব্য অনুযায়ী ) তখন আর চুপ থাকা সমীচীন মনে করে নি তৃণমূল। অন্যদিকে কংগ্রেস এবং সিপিএম সরাসরি মহুয়ার পাশে দাঁড়ানোই খানিক অস্বস্তিতেও পড়েছিল দল। মহুয়া যা করুন না কেন তাঁর জনপ্রিয়তা প্রবল ভারত জুড়ে কাজেই তাঁকে যদি দল বহিষ্কার করে বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় তবে দেশের কাছে ভালো বার্তা যাবে না এটি কিন্তু অভিষেক বুঝেছেন। দ্রুত ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে তাঁর পাশে দল শুধু দাঁড়ালো না, তাঁকে কৃষ্ণনগর জেলা অবস্থানের সভাপতির পদ দেওয়া হলো। অভিষেক রাজনীতিতে অনেকটাই পটু এটাই ফের উদাহরণ।
কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে অর্থাৎ ১০০ দিনের ও আবাস যোজনার বকেয়া টাকার দাবিতে দিল্লির বুকে আন্দোলন সূচনা করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূল মঙ্গলবার এই আন্দোলনের শেষ দিন ছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বিভিন্ন সাংসদরা কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর নিরঞ্জন জ্যোতির সঙ্গে দেখা করবেন বলে কর্মসূচিও ছিল। কথামতো মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ সাংসদরা কৃষি ভবনে পৌঁছলেও নিরঞ্জন জ্যোতি তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি বলে অভিযোগ। এরপরই সেখানে তাঁদের রীতিমতো জোরপূর্বক প্রিজন ভ্যানে তুলে তৃণমূল সাংসদদের আটক করা হয় এবং অবস্থান বিক্ষোভ থেকে তাদের হটিয়ে দেওয়া হয়।
যদিও এর পরেই তৃণমূলের অভিযোগ অস্বীকার করে নিজের এক্স হ্যান্ডেলে কেন্দ্রীয় গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রী নিরঞ্জন জ্যোতি লেখেন, ' আজ আড়াই ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। তৃণমূল সাংসদদের জন্য অপেক্ষা করে সাড়ে ৮টায় দফতর ছেড়েছি। আমি জানতাম, তৃণমূলের সাংসদ এবং মন্ত্রীরা সন্ধ্যা ৬টায় দেখার করার জন্য সময় নিয়েছিলেন।'
ওদিকে পাল্টা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দাবি খারিজ করলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূল নেত্রী সুস্মিতা দেব এক্সে লেখেন, ‘‘আপনি এত বড় মিথ্যে বলছেন যে, আপনার ডুবে মরা উচিত। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাংসদেরা আপনার দফতরে রয়েছে। আপনি দেখা করেননি। কিছু লজ্জা করুন। বাংলার মানুষ দেখছে আপনার ছলনা। ২০২৪ সালে আপনারা নিশ্চিত ভাবে শূন্যে পৌঁছবেন। সাংসদ মহুয়া মৈত্রও অভিযোগ করেছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মিথ্যে বলছেন।'
কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর দফতরের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ তৃণমূল সাংসদদের তথা তৃণমূল উচ্চ নেতৃত্বের। এই বিক্ষোভ তুলতে গেলেই হুলুস্থুল কান্ড বেঁধে যায় দিল্লিতে। সেসময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ সমস্ত সাংসদকে টেনে-হিঁচড়ে চ্যাংদোলা করে অবস্থান বিক্ষোভ থেকে হটিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ মহিলা সংসদেরও মারধর করা হয়। এর পরই তাদেরকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়।
সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে অর্থাৎ ১০০ দিনের টাকা ও আবাস যোজনার বকেয়া টাকার দাবিতে অক্টোবর দুই ও তিন তারিখ দিল্লিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করে তৃণমূল। সেই মত আজ অর্থাৎ শেষ দিন দিল্লিতে যন্তর মন্তরে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল। এদিন সন্ধ্যেবেলায় কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী নিরঞ্জন জ্যোতির সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ হবার কথা ছিল। সেই মতোই যন্তর মন্তর থেকে পায়ে হেঁটে দিল্লির কৃষিভবনে পৌঁছায় তৃণমূল। সেখানে তৃণমূল নেতৃত্বরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে, এরপর তাদের জানানো হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।
এরই পাল্টা সংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তিনি দেখা না করে যাবেন না এরপরই বেধে যায় হুলুস্থুল কান্ড। জোরপূর্বক পুলিশ টেনে হিঁচড়ে চ্যাংদোলা করে তৃণমূল সাংসদ সহ সমস্ত উচ্চ নেতৃত্বদের আটক করে নিয়ে যায় মুখার্জি নগর থানায়। ভিডিও কিছুক্ষণ আটকে রাখার পর তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আগামীর কর্মসূচি গ্রহণ করেন। পাশাপাশি এর পূর্বে কখনোই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রিজন ভ্যানে ওঠেননি।
ফের মহুয়া মৈত্রের ট্যুইট খোঁচায় বিদ্ধ বঙ্গ বিজেপি (Bengal BJP)। গেরুয়া শিবিরের নবান্ন অভিযানে (Nabanna Abhijan) সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের অভিযোগ তুলছে তৃণমূল। মঙ্গলবার মেছুয়া বাজার এলাকায় পুলিসের একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এবার যারা সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করেছে সেই বিজেপি কর্মীদের বাড়িতে বুলডোজার পাঠালে কেমন হয়? ট্যুইট করে মহুয়া মৈত্র (Mahua Maitra) এই প্রশ্ন করেন।
What if Bengal used Bhogiji Ajay Bisht’s model & sent bulldozers to homes of BJP workers who destroyed public property yesterday?
— Mahua Moitra (@MahuaMoitra) September 14, 2022
Will BJP stand by own policy or get their chadds in a twist?
তিনি বলেন, 'যদি বাংলা ভোগীজি অজয় বিষ্ঠের নীতি নিয়ে সরকারি সম্পত্তি ভাঙার অভিযোগে বিজেপি কর্মীদের বাড়িতে বুলডোজার পাঠায় তাহলে কী? বিজেপি কি নিজেদের নীতিতে স্থির থাকবে?' মহুয়া মিত্রের এই ট্যুইট ভাইরাল হতেই পাল্টা কটাক্ষ করেছে বিজেপি।
দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা বলেন, 'সরকারি সম্পত্তি ভাঙার জন্য প্রথম জরিমানা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেবেন। আর নবান্ন অভিযানে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস বিজেপি করেছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। বিরোধী দলের থাকাকালীন যতগুলো সরকারি সম্পত্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধংস করেছেন, তার এক শতাংশ ধ্বংস বিজেপি করেনি। আগে ওরা জরিমানা দিক, তারপর বিজেপির জরিমানা নিয়ে ভাববে।'
প্রসূন গুপ্ত: এই মুহূর্তে সংসদে সেরা বাগ্মী সাংসদের মধ্যে অন্যতম তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র। তাঁর এবং শশী থারুরের বক্তব্য শুনতে সরকারি দলের সাংসদের ভিড় থাকে লোকসভায়। ইংরাজিতে চোস্ত এই দুই সাংসদে যুক্তি-তক্কের জুড়ি মেলা ভার। কৃষ্ণনগরের সাংসদ উচ্চ শিক্ষিতা, বিদেশ থেকে বিশেষ পড়াশুনো এবং সর্বোপরি দিল্লির রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন অনেকদিন। এক সময়ে কংগ্রেসের বা রাহুল গান্ধীর সহযোগী ছিলেন। পরে তৃণমূলে যোগ দেন এবং ২০১৬-তে করিমপুর থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয়পাত্রী হিসাবে তাঁর একটা বিশেষ স্থান ছিল দলে। ২০১৯-এ মাস্টারস্ট্রোক দেওয়ার মতো মমতা তাঁকে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেন এবং মহুয়া জিতেও আসেন। মনে রাখতে হবে এই জয় মোটেই সহজ কাজ ছিল না, কারণ সেবার ১৮টি আসন জয় করেছিল বিজেপি এবং কৃষ্ণনগরেও ভালো জায়গায় ছিল গেরুয়া দল। কিন্তু মহুয়া তাঁর নিজস্ব পরিচিতি এবং সামাজিক অবস্থানকে ব্যবহার করে ভোটারদের কাছে বিশেষ বার্তা দিয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছেন।
এ হেন মহুয়া অনেক সময়ে প্রেসের সামনে বা নিজের পেজে নানা মন্তব্য করে জনমানসে জনপ্রিয় হয়েছেন। কখনও আবার বিতর্কে জড়িয়েছেন। কয়েক ডজন ফ্যান ক্লাব আছে তাঁর নামে। কয়েক মাস আগে তিনি কালীপুজো নিয়ে কিছু মন্তব্য করে বিজেপির রোষানলে পড়েন। ওই সময়ে দল তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি কারণ ধর্মের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। মহুয়া কিন্তু তাঁর মন্তব্য থেকে এক চুলও সরে যাননি।
বৃহস্পতিবার তৃণমূলের কর্মিসভা থেকে তিনি দলনেত্রীর হালকা ধমক খেয়েছেন। মমতা পরিষ্কার জানিয়েছেন, মহুয়ার প্রাক্তন বিধানসভা কেন্দ্র করিমপুর, যা কিনা নদিয়াতে হলেও লোকসভা হিসাবে আবু তাহেরের মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে পড়ছে। অতএব মহুয়া তাঁর নিজের কেন্দ্র কৃষ্ণনগর নিয়েই যেন থাকেন। করিমপুরের দায়িত্ব আবু তাহেরের। স্বাভাবিক ভাবেই ভরা জনসভায় থতমত খেয়ে যান মহুয়া।
পরে তিনি তাঁর পেজে লেখেন, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদেই তিনি আজ একটা জায়গা করে নিয়েছেন। অতএব তাঁর নির্দেশ মেনে চলবেন কিন্তু করিমপুরের ভোটার যেহেতু তিনি, অতএব সেখানেও তিনি থাকবেন। প্রশ্ন উঠেছে মহুয়া কি বিদ্রোহী, নাকি অভিমানী বার্তা দিলেন। মহুয়া ঘনিষ্ঠরা অবশ্য বলেছে, এটা খারাপ কি বার্তা, তিনি তো দলনেত্রীর আদেশ মেনেই তাঁর পেজে মন্তব্য করেছেন। বাকি বিষয়টি কোথায় যায় সেটাই দেখার।