যাঁর নামে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত, আজ কিনা তাঁর চোখে জল!ভোট আসলেই বীরভূমের (Birbhum) বেতাজ বাদশা অনুব্রত মণ্ডলকে (Anubrata Mandal) সামলাতে কাল ঘাম ছুটত পুলিস থেকে শুরু করে কমিশনের কর্তাদের। কখনও প্রকাশ্যে পুলিসকে বোমা মারার হুমকি দিয়েছেন তো, আবার কখনও গাঁজা কেসে জেলে ঢোকানোর। আজ সেই দাপুটে নেতা একেবারে নির্বাক। কার্যত ভেঙে পড়লেন বীরভূম জেলা তৃণমূল (TMC) সভাপতি। বৃহস্পতিবার রাতে নিজাম (Nizam) প্যালেসে নিয়ে আসার পথে দৌর্দণ্ড্যপ্রতাপ নেতার এহেন অবস্থা লেন্সবন্দি হল। যা দেখে কিছুটা হলেও অবাক হয়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অনেকেই।
গরু পাচার মামলায় বৃহস্পতিবার বীরভূমের বাড়ি থেকে অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার করে সিবিআই। আগামী ১০ দিন তাঁকে সিবিআই হেফাজতে থাকার নির্দেশ দিয়েছে আসানসোলের বিশেষ আদালত। ২০ অগাস্ট পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতে পেয়েছে তাঁকে। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অনুব্রতকে সিবিআইয়ের গাড়িতে করে কলকাতার নিজাম প্যালেসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তবে ধনেখালিতে যানজটে আটকে যায় গাড়ি। একদা বীরভূমের বেতাজ বাদশা অনুব্রত মণ্ডল বাড়ি থেকে বেরোলেই অনায়াসে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। কোনও বাধা বিপত্তি ছাড়াই তিনি পৌঁছে যেতেন গন্তব্যে। একাধিকবার কলকাতায় এসেছেন বাধা-বিপত্তি ছাড়াই। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার পরে কলকাতায় ফিরতে গিয়ে বেগ পেতে হল অনুব্রত মণ্ডলকে। গোটা জাতীয় সড়কে কার্যত গাড়ি বন্দী হয়ে থাকতে হল দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল সভাপতিকে। জাতীয় সড়কে প্রায় এক ঘন্টা আটকে ছিলেন তিনি। এরপর স্থানীয় পুলিসের সহযোগিতায় কনভয় ফের কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
আর ফেরার পথে কিছুক্ষণের জন্যে পালসিটের কাছে একটি পেট্রোল পাম্পে দাঁড়ায় সিবিআইয়ের গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে অনুব্রত মন্ডলের দিকে ছুটে যান সাংবাদিকরা। একাধিক প্রশ্ন করা হলেও একেবারে মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন তিনি। কেবল ক্যামেরায় ধরা পড়ল অনুব্রতের চোখের জল। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। সাড়ে সাত ঘণ্টা পর অনুব্রত মণ্ডলকে নিয়ে মধ্যরাত ২ টো ৪৫ মিনিট নাগাদ নিজাম প্যালেসে প্রবেশ করেন সিবিআই আধিকারিকরা।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার সকালে অনুব্রতর বাড়ি ঘিরে ফেলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। তারপর প্রায় এক ঘণ্টা ধরে টানটান উত্তেজনার শেষে গ্রেফতার হন বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল। সিবিআই আধিকারিকেরা একেবারে বাড়ির ভিতরে দোতলায় অনুব্রতর ঘরে গিয়ে তাঁকে গ্রেফতারি পরোয়ানাতে স্বাক্ষর করিয়ে গ্রেফতার করেন।
সূত্রের খবর, সিবিআই হেফাজতে থাকাকালীন অনুব্রতর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে আলিপুরের কম্যান্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। এছাড়া তাঁর জন্য একটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত কয়েকদিনে একাধিক তথ্য হাতে পেয়েছেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। এমনকি অনুব্রত মন্ডলের দেহরক্ষী সায়গলের বিপুল সম্পত্তির হদিশ পেয়েছে সিবিআই। তাঁর ফোন রেকর্ড থেকেও উদ্ধার করা হয়েছে একাধিক তথ্য। যা এখন সিবিআইয়ের হাতে। জানা গিয়েছে, গরু পাচার মামলার একাধিক তথ্য এখন সিবিআইয়ের কাছে। সেই সব বিষয়কে সামনে রেখেই আজ থেকে আগামী কয়েকদিন লাগাতার জেরা করবেন সিবিআই আধিকারিকরা বলে মনে করা হচ্ছে।
গরু পাচার মামলায় গ্রেফতার করে সিবিআই (CBI) অনুব্রত মণ্ডলকে বৃহস্পতিবার আসানসোলে নিয়ে যায়। কিন্তু এদিন সকালে যখন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতিকে (Anubrata Mondal) যখন গ্রেফতার করে তখন লোকে-লোকারণ্য তাঁর বোলপুরের বাড়ি। কিন্তু বেলা গড়াতেই শুনশান হয়ে যায় সেই এলাকা। পাশাপাশি তালা পড়ে অনুব্রতর বাড়ি এবং অফিসে। কিন্তু সেই ফাঁকা বাড়ির সময় ঘুরতে দেখা যায় এক গরুকে। কিছুক্ষণ সেই গরু, অনুব্রতর বাড়ির মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়েও থাকে। আবার রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করে।
এদিকে, বীরভূম থেকে অনুব্রতকে যখন আসানসোল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন রাস্তায় একাধিকবার তাঁকে গরু চোর কটাক্ষ শুনতে হয়েছে। এমনকি, আসানসোল আদালতেও বিক্ষোভ দেখায় বাম কর্মী-সমর্থকরা। তাঁর উদ্দেশে ছোড়া হয় জুতোও।
এদিন তাঁকে ১০ দিনের সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালত। অপরদিকে, বৃহস্পতিবার রাতেই অনুব্রতকে আনা হয়েছে কলকাতায়। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে কলকাতা আসার পথে একাধিকবার তাঁর কনভয় দাঁড়ায়। তাঁর কাছে গিয়ে সংবাদমাধ্যম কিছু জানতে চাইলে অনুব্রত মণ্ডল কিছুই জানাবেন না বলে হাত নেড়ে জানিয়ে দিন।
কোনও অনৈতিক কাজ এবং দুর্নীতিকে তৃণমূল (TMC) প্রশ্রয় দেয় না। দুর্নীতির (Corruption) বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দলের। অনুব্রতর (Anubrata Mondal) গ্রেফতারির পর জানাল তৃণমূল কংগ্রেস। বৃহস্পতিবার শাসক শিবিরের তরফে সাংবাদিক বৈঠক করেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য (Minister Chandrima Bhattacharya) এবং প্রাক্তন বিধায়ক সমীর চক্রবর্তী। চন্দ্রিমাদেবী জানান, দলনেত্রী-সহ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করেছেন, মানুষের পক্ষে যা ক্ষতিকর বা মানুষকে যদি কেউ ঠকায়, সেই কাজকে দল সমর্থন করে না। আগে এবং আজও তৃণমূলের এই বিষয়ে অবস্থান একই। মানুষের সমর্থনে তিন বার তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাই মানুষের আশীর্বাদ ছাড়া কোনও সম্পদে তৃণমূলের আর কোনও আগ্রহ নেই।
তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো নিরপেক্ষ চেহারা হারিয়ে ফেলছে। সবার সঙ্গে নিরপেক্ষ ব্যবহার করুক তদন্তকারী সংস্থাগুলো। এটুকু আশা আমরা করতেই পারি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রের শাসক দলের কারও বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দলের পক্ষে কেউ অভিযুক্ত হলে, সেই তৎপরতা দেখা যায় না।' এই অভিযোগ তোলার সময় তিনি সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের তিন বিধায়কের গাড়ি থেকে অর্থ উদ্ধারের প্রসঙ্গ তোলেন। এবং একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়েও ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। এভাবেও ঘুরিয়ে বিজেপিকে কাঠগড়ায় তোলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী।
তাঁর দাবি, 'বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তাঁর বিরুদ্ধে সারদা কর্তার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তারপরেও বিরোধী দলনেতাকে ডাকাডাকি নেই, তাঁর বিরুদ্ধে কোণও কেন্দ্রীয় সংস্থার তৎপরতা নেই। শুধু বিরোধী দলনেতা নয়, তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। কিন্তু ইডি, সিবিআই কেউই তাঁদের তদন্তের আওতায় আনছে না।'
চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য আরও জানান, বিচারব্যবস্থা, মাননীয় বিচারপতি সবার প্রতি আমাদের আস্থা এবং বিশ্বাস আছে। সবদিক খতিয়ে দেখেই বিচারব্যবস্থা পদক্ষেপ নেবে। তৃণমূলের তরফে আগামি দুই দিন সিবিআই-ইডির নিরপেক্ষতা চেয়ে এবং কেন্দ্রের সরকার দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার দাবিতে জেলায় জেলায় মিছিল করবে দল। এদিন জানান চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং সমীর ভট্টাচার্য। পাশাপাশি তাঁরা জানান, অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা? যথা সময়ে সংবাদ মাধ্যম জানতে পারবে। দলনেত্রী এবং শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির আলোচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত হবে। এমনটাই বৃহস্পতিবার জানান চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং সমীর চক্রবর্তী। দুর্নীতিতে কেউ অভিযুক্ত হলে তৃণমূল তাঁকে সমর্থন করবে না। এদিন স্পষ্ট জানিয়ে দেন ওই দুই নেতা।