সৌমেন সুর: আমি চিকিৎসা বিজ্ঞান পর্বে মোট চারজন খ্যাতিমান যশস্বী চিকিৎসককে বেছে আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। এক একটি পর্বে এক একজন চিকিৎসকের প্রসঙ্গ থাকবে। আজ ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের কাহিনী। বিধান রায় জন্মগ্রহণ করেন বিহারের পাটনায়। আদি বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার টাকির শ্রীপুরে। মাত্র ৫ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর বাবার তত্ত্বাবধানে মহত্তর মানবসেবার আদর্শেই জীবনের আদর্শ প্রস্তুত হয়। ১৯০৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে বিধান রায় সসম্মানে এল.এম.এস ও এম.বি পাশ করেন। ১৯০৮ সালে তিনি এমডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯০৯ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত গিয়ে দু'বছরের মধ্যে MRCP (London) এবং FRCS পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর ১৯১১ সালে জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রেরণায় রাধাগোবিন্দ কর প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। তখন এই প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুল রাখা হয়েছিল।
১৯১৮ সালে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিনের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নির্দেশে স্বরাজ পার্টির পক্ষে প্রার্থী হয়ে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন। এবং বিধান রায় বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন থেকেই শিক্ষাকে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত করার জন্য তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে কারারুদ্ধ হওয়ার পর, তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পর জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতি হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাশ করিয়ে এক বিপ্লব আনেন তিনি। কলকাতা পুরসভার মেয়র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের গুরুত্বপূর্ণ পদের অভিজ্ঞতায় তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। জীবনে বহু কল্যাণমূলক কাজে দুর্নিবার ছিলেন তিনি। ডিভিসির সদর দফতর বাংলায় স্থাপনে তাঁর কৃতিত্ব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং দুর্গাপুরকে শিল্পনগরী আর কল্যানীকে কলকাতার উপনগরী করার কৃতিত্ব বিধান রায়ের।
কিংবদন্তী চিকিৎসক, শিক্ষক এবং দেশসেবক হিসেবে তিনি ভারতরত্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের পয়লা জুলাই তাঁর প্রয়ান দিবস। একই দিনে জন্ম এবং মৃত্যুদিন বিধানচন্দ্র রায়ের। যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পয়লা জুলাই 'চিকিৎসক দিবস' পালন করা হয়। মানুষ বিধান রায় এবং মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় পাশাপাশি প্রশাসক বিধান রায়, সবেতেই তিনি ছিলেন সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। (শেষ)
সৌমেন সুর: রবীন্দ্রনাথ ক্ষণজন্মা পুরুষ। এমন প্রতিভাবান পৃথিবীতে খুব কম দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করে না, এমন মানুষ বিরল। তাই এই মানুষ যদি রোগে ভোগে, তাহলে কার না কষ্ট হয় বলুন। তিনি নিজেই একজন প্যারালাল ডাক্তারের মতো ছিলেন। হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ওষুধকে তিনি বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করতেন। ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি তাঁর মূত্রাশয়ে সমস্যা শুরু হয়। প্রস্রাবে জ্বালা, প্রস্রাব কমে আসার মতো উপসর্গ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ দু'জন চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়।
একজন ডাক্তার নীলরতন সরকার, অপরজন বিধানচন্দ্র রায়। সেই সময় সিটি স্ক্যান, ইউএসজি-র মতো আধুনিক রোগ নির্ণয় পরীক্ষা আবিষ্কার হয়নি। কিছুটা অনুমানের উপর ভিত্তি করে কবিগুরু চিকিৎসা শুরু করেন এই দুই নামজাদা চিকিৎসক। ডাক্তার নীলরতন সরকার গুরুদেবকে দেখে বলেন, এই রোগীর অপারেশন করা ঠিক হবে না। অপারেশন না করলে গুরুদেব অনেকদিন বাঁচতে পারেন। কিন্তু বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন নাছোড়বান্দা তিনি আবার অপারেশনের পক্ষে। ডাক্তার সরকার রাগে, ক্ষভে এক বুক অভিমান নিয়ে চলে যান ঠাকুরবাড়ি থেকে।
গুরুদেবের প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়ায় কবিগুরুর মূত্রাশয়ে মূত্র থেকে যাচ্ছে। যার ফলে ইউরোমিয়া দেখা দিচ্ছে। অতএব অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিন জন ডাক্তার। রবীন্দ্রনাথের কোনও মানা শুনলেন না। বাড়ির সদস্যরাও অপারেশনে রাজি। অতঃপর শুরু হল ক্রিয়াকলাপ। অপারেশন টেবিল থেকে অপারেশনের পর ওকে খাটে শোয়ানো হল। এরপর তিন দিন যাওয়ার পর এল অভিশপ্ত ৭ অগাস্ট। কবি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করলেন। দেহ অদৃশ্য হল বটে কিন্তু আত্মা পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেল। বাংলার মানুষ আজও কবিকে বুকে আঁকড়ে রয়েছেন। সঙ্গে নিয়ে আছে বিশ্ব কবির অজস্র সৃষ্টিধর্মী কাজকে।