আবার নাটকে ব্যারিকেড! এবার নবদ্বীপ পুরসভা বন্ধ করল উৎপল দত্ত রচিত দেবেশ চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত চাকদহ নাট্যজন প্রযোজিত ‘ব্যারিকেড’-এর অভিনয়। আগামী বছরের ২৩ জানুয়ারি নবদ্বীপ রবীন্দ্র সাংস্কৃতিক মঞ্চে এই নাটক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। অভিযোগ, মৌখিকভাবে ওই নাট্য সংস্থাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই নাটক করা যাবে না। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সংস্কৃতির মঞ্চে তবে কি রাজনীতি? ফের কি তবে শাসকের রোষের মুখে সংস্কৃতি?
চাকদহ নাট্যজনের সম্পাদক সুমন পালের অভিযোগ, মঙ্গলবার দুপুরে তাঁদের মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, নবদ্বীপ রবীন্দ্র সাংস্কৃতিক মঞ্চে 'ব্যারিকেড' নাটকটি করা যাবে না। এও জানানো হয়, অন্য নাটক হতে পারে কিন্তু ব্যারিকেড করা যাবে না। তাই তাঁদের প্রশ্ন, 'উৎপল দত্তের আরও বেশ কয়েকটি নাটক এই বঙ্গে নিয়মিত অভিনয় হচ্ছে। তাহলে ব্যারিকেড বন্ধ করার কারণ কি রাজনৈতিক না অন্য কিছু?'
তাঁরা বলেছেন,'আমাদের মতন একটি দলের কাছে এই আঘাত আমাদের চলার পথে এক ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে নিয়ে আসছে। কিন্তু আমরা কোনভাবেই "ব্যারিকেড"এর মতন নাটক বন্ধ করতে রাজি নই। আমাদের অন্যান্য প্রযোজনার পাশাপাশি ব্যারিকেড নাটকটির অভিনয় করে যেতে চাই। চাকদহ নাট্যজনের পক্ষ থেকে আপামর মানুষের কাছে আমাদের এই প্রশ্ন। আশা করি আপনারা আমাদের সঠিক পথ দেখিয়ে দেবেন।'
বাংলার বিনোদন (Entertainment) জগতে আরও একবার শোকের ছায়া। প্রয়াত হলেন নাট্য জগতের স্বনামধন্য শিল্পী মায়া ঘোষ (Maya Ghosh)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর. বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে তাঁর বলে খবর। সময়টা ষাটের দশকের। প্রখ্যাত অভিনেতা প্রয়াত উৎপল দত্তের (Utpal Dutta) পিপলস্ লিটল থিয়েটারের সক্রিয় সদস্য হিসেবে নাট্যজীবন শুরু হয় ময় দেবীর। বাংলার মঞ্চ জগতের স্বর্ণালী অধ্যায়ে একের পর এক হাইউজফুল নাটক উপহার দিয়েছেন তিনি। বাংলার আরও এক জনপ্রিয় অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থাপিত সাঁওতাল বিদ্রোহ নাটকে অভিনয় করে দর্শক মহলে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন মায়া ঘোষ।
এছাড়াও নান্দীকার নাট্যগোষ্ঠী স্থাপন হওয়ার পর থেকেই সেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যপদ সামলান মায়া দেবী। পিরানদেল্লোর নাটক অবলম্বনে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত পরিচালিত ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র, বিখ্যাত অভিনেতা তথা নাট্য ব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র পরিচালিত চাক ভাঙা মধু, মোহিত চট্টোপাধ্যায় নির্মিত রাজরক্ত নাটকে অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন তিনি।
এদিন বেলায় অ্যাকাডেমিতে নিয়ে আসা হয় তাঁর মরদেহ। সেখানেই শেষ শ্রদ্ধা জানালেন বাংলা নাট্য ও বিনোদন জগতের বিশিষ্টরা। এরপর কেওড়াতলা শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হল দাপুটে এই মঞ্চাভিনেতার। তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা মঞ্চ জগৎ।
সৌমেন সুর: ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ম্যাডানের উদ্যোগে এলফিন স্টোন পিকচার প্যালেসে হলিউডের ইউনিভার্সাল কোম্পানির 'মেলোডি অফ লাভ' দেখানো হয়। এটাই ভারতে প্রদর্শিত প্রথম সবাক ছবি। এই সবাক ছবিটি সিনেমার বদল ঘটায়। কারণ সাউন্ড এসে যাওয়ায় পুরোনো যন্ত্রপাতি সব অকেজো হয়ে যায়। নতুন যন্ত্র, নতুন sound proof ষ্টুডিও এবং দক্ষ কলাকুশলীর প্রয়োজন হয়। তখন থেকেই চলচ্চিত্র, শিল্প হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপের চেহারা নেয়।
১৯৩১ সালের ১১ই এপ্রিল ম্যাডানের প্রযোজনায় প্রথম বাংলা সবাক ছবি 'জামাইষষ্ঠী' মুক্তি পায় এবং একই বছরে প্রথম হিন্দি সবাক ছবি 'আলম আরা' বোম্বেতে প্রদর্শিত হয়। সিনেমাকে আরও স্বাভাবিক, প্রাণবন্ত ও জীবনের কাছাকাছি আনার কাজটা শুরু করেছিলেন বিদেশ থেকে লেখাপড়া শিখে আসা ইঞ্জিনিয়র বি. এন সরকার ও তাঁর নিউ থিয়েটার্স। তিনি বিদেশ থেকে শিখে আসা জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগালেন, আবার আমেরিকা থেকে দক্ষ কারিগর এনে প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করেন। এদিকে ম্যাডান কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলা ছবিতে আর তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। বরং বাংলা ছবি পরবর্তী কয়েক দশকে, নিউ থিয়েটারর্সর প্রভাবে সুদূরপ্রসারী হয়। এছাড়া আরও কয়েকটা ছোটোখাটো কোম্পানি গড়ে ওঠে তখন - রাধা ফিল্মস, ভারতলক্ষী পিকচার্স, কালী ফিল্ম ইত্যাদি। এদিকে বি. এন সরকার নিউ থিয়েটার্সে ধীরে ধীরে কিছু দক্ষ ও গুণী মানুষজনকে হাজির করলেন।
যেমন পরিচালনার জন্য আনলেন দেবকী কুমার বসু, প্রমথেশ বড়ুয়া, আরও কয়েকজন জ্ঞানী মানুষকে। ক্যামেরায় নীতিন বসু, শব্দ যন্ত্রে মুকুল বসু- এঁরা দুজনেই সত্যজিৎ রায়ের কাকা, অভিনয়ে কানন দেবী, প্রমথেশ বড়ুয়া, ডি. জি, পাহাড়ি সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, কে. এল. সায়গল, প্রমুখ। সংগীতে পঙ্কজ মল্লিক, এস. ডি. বর্মন, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কমল দাশগুপ্ত এবং প্রথিতযশা বাংলা সাহিত্যের কবি লেখকদেরও সিনেমা নির্মাণের কাজে নিযুক্ত করেন। ১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁরই লেখা 'নটীর পূজা' চলচ্চিত্রায়িত করেন।
(চলবে)
সৌমেন সুর: দুই ভাই- অগাস্তে ও লুই লুমিয়ের, যাঁরা পরে লুমিয়ের ব্রাদার্স নামে পরিচিত। ওরা বিখ্যাত হন এই কারণে যে, তাঁরাই প্রথম সিনেমা বা চলচ্চিত্র তৈরির কাজটি করেন। সিনেমা বলতে তখন Film Strip বা ছোট টুকরো ঘটনা বোঝাত। যেমন ট্রেন এসে স্টেশনে থামছে বা ঘোড়া দৌড়চ্ছে কিংবা দৈনন্দিন জীবনের কোনও ঘটনাবলীর টুকরো দৃশ্য। এসব দৃশ্য এতটাই আটপৌরে ছিল যে লুই ভেবেছিলেন 'The Cinema is an invention without a future.' তবে তাঁর সমস্ত ভাবনা নস্যাৎ করে একশো বছরের মধ্যে সিনেমা, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প হয়ে উঠেছে। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে প্রথম নির্মিত চলচ্চিত্র 'The Arrival of a Train.' নির্মাতা এই লুমিয়ের ব্রাদার্স।
ফ্রান্সের সর্বপ্রথম সিনেমা প্রদর্শনীর মাস ছয়েক পর ১৮৯৬ সালের ৭ই জুলাই লুমিয়েরদের প্রতিনিধি 'মরিস সেসটিয়ার' বোম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে ছবির প্রদর্শনী করেন। সেই থেকে ভারতে নির্বাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হল। ওই বছরের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় সিনেমা প্রদর্শিত হয়। তারপর ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে এখানকার থিয়েটার মালিকদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হয়, থিয়েটার দেখানোর আগে বা পরে, এরকম স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি দেখানোর জন্য। প্রথমদিকে বিদেশী কোম্পানির হাত ধরেই এভাবে বাংলায় বায়স্কোপের প্রবেশ।
১৮৯৮ সালে হীরালাল সেন ও তাঁর ভাই মতিলাল সেন 'রয়্যাল বায়োস্কোপ' কোম্পানি তৈরি করেন। তাঁরা বিদেশ থেকে ছবি প্রদর্শনের জন্য নানা যন্ত্রপাতি কেনেন। ১৯০২ সালে কলকাতায় প্রথম মুভি ক্যামেরা আসে। হীরালাল সেন কলকাতার নাট্যমঞ্চ থেকে নাটকের নির্দিষ্ট কিছু দৃশ্যাবলী বেছে ক্যামেরাবন্দী করলেন। সেই সময়ের মঞ্চ নাটকের সফল নাটক 'আলিবাবা', 'সীতারাম', 'ভ্রমর' থেকে বিভিন্ন টুকরো দৃশ্য নিয়ে একটি ছায়াছবি তৈরি করলেন। যা ক্লাসিক থিয়েটারে দেখানো হয়েছিল। এছাড়া তিনি দুটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। একটি 'দিল্লি দরবার', অন্যটি 'বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন'। পরবর্তীকালে তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বায়োস্কোপ দেখাতে শুরু করেন।
১৯১৩ সালে তাঁর সঙ্গে ভাই মতিলালের ঝগড়া হওয়ায় 'রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি' বন্ধ হয়ে যায়। যাই হোক, বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হীরালাল সেন প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে থাকবেন।
(চলবে)
সুজিত সাহা: নাটক করা বা দেখার সঙ্গে যুক্ত কম বেশি প্রায় সকলেই। শুধুমাত্র দেখা বা উপস্থাপনের ধরন খানকিটা অন্যরকম। আমাদের চোখের সামনে বা আড়ালে কিছু কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনা, নানা সম্পর্ক, অভিজ্ঞতার উপস্থিতি হয়তো শৈল্পিক রূপ পায় না। কিন্তু কিছু মানুষ তার অনুভূতি ও বাস্তবতার নিবিড় সম্পর্ক তৈরিতে জন্ম নেয় নতুন ধারার নাটক। ইদানিংকালে নাটক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার শেষ নেই। এগিয়ে চলার ধারা অব্যাহত এটা যে কোনও মাধ্যমের ক্ষেত্রেই শুভ লক্ষণ। ব্যক্তি জীবনে সম্পর্কের রূপ, ধরন, অভিজ্ঞতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন বদলায়, তেমনই চলার পথে কত নতুন সম্পর্কের জন্ম হয়। প্রতিনিয়ত প্রেক্ষিত অনুযায়ী দর্শনগত পার্থক্য উপলব্ধি করে থাকেন মননশীল মানুষ। আজ যে জিনিস নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন কেউ, দুদিন বাদে সেই জিনিস নিয়েই হয়তো ঠিক অন্যরকম ভাবে ভাববেন। নির্দিষ্ট বলে কিছুই হয় না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর হয়তো পরিবর্তন হয়।
'অন্তরঙ্গ' থিয়েটারও ঠিক তাই। তোমার আজকের সম্পর্ক, অভিজ্ঞতার সঙ্গে কালকের চলনের মিল নাও হতে পারে। আজকের সংলাপ, উপস্থাপন আগামী দিনে তার ভাষা একই থাকবে তার কোনও মানে নেই। এই নাটক এক অন্তরের সঙ্গে অন্য অন্তরের সংযোগের সেতু, সম্পর্কের নতুন খোঁজ। 'অন্তরঙ্গ' থিয়েটারের আঙ্গিকে এমন এক সাবলীলতা আছে যার উপস্থাপন ক্ষেত্র- প্রসেনিয়াম, বা কোনও ঘর অথবা যেকোনও মুক্ত মঞ্চেই হোক না কেন তা নাটকের নিজস্ব আঙ্গিকের ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব পড়ে না। এই নাটক চলাকালে অভিনেতা ও দর্শকের সঙ্গে এমন এক আধ্যাত্মিক বা অন্য কোনও অনুভূতি ও সম্পর্কের মেলবন্ধন ঘটে, সেটা একেবারে তার নিজস্ব অনুভূতি। এই অনুভূতি বিশ্লেষণ করা শক্ত। 'অন্তরঙ্গ' থিয়েটার ভাল মন্দ এ প্রশ্ন আপেক্ষিক। তবে এটা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, কিছু মানুষকে এটি অন্য এক অনুভূতির সামনে দাঁড় করায়। একান্তে নাটকের মুহূর্তগুলো অন্তরে অনুরণন তোলে।
(ক্রমশঃ)