সৌমেন সুর: রবীন্দ্রনাথের নাতনী নন্দিনীদেবী ওরফে পুপে। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর সন্তানহীনতার কান্না রবীন্দ্রনাথকে ভীষণ পীড়িতকরেছিল। এরপর রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা এবং সক্রিয়তায় প্রতিমা দেবী-রথীন্দ্রনাথ নন্দিনীকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। নন্দিনীর জন্ম হয়েছিল চতুর্ভুজ দামোদরের পরিবারে। এই গুজরাটি ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথের আকর্ষনে শান্তিনিকেতনে এসে বাসা বেঁধেছিলেন।
চতুর্ভুজ দামোদরের স্ত্রী ছিলেন চিররুগ্ন। জন্মের সময় নন্দিনীও ছিল রুগ্ন। এই কন্যাসন্তানকে বাঁচানো যাবে কিনা এই চিন্তা চতুর্ভুজ দামোদরকে চিন্তিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ পুত্র ও পুত্রবধূর জন্য এই কন্যাসন্তানকেই দত্তক নিতে উদ্যোগী হলেন। বাকি জীবনটুকু নন্দিনীর কেটেছিল রবীন্দ্রনাথের প্রশ্রয়ে ও প্রতিমাদেবীর স্নেহে। শান্তিনিকেতনে সকলের আচার্য গুরুদেব বিশ্বজয়ী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পৌত্রী-নন্দিনীর সম্পর্কটি ছিল স্নেহ, ভালবাসা এবং প্রশয়ের। শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথের জীবনকে যেন নতুন করে রাঙিয়ে তুলে ছিলেন। তাঁর আদরের পুপে দিদি গল্পে গানে আদরে আবদারে সে ছিল এক অন্য রবীন্দ্র জীবন। দুই অসমবয়সী বন্ধুর পারস্পরিক নির্ভরতার এক চিত্র ছিল সে সম্পর্ক।
শান্তিনিকেতনের পরিমণ্ডলে নিজের মনের মতো করে আদরের পুপে দিদিকে গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে মুম্বই নিবাসী অজিত সিং খাটাও-এর সঙ্গে নন্দিনীর বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু সে বিবাহ সুখের হয়নি। বিবাহবিচ্ছেদের পর নন্দিনী ফিরে এসেছিলেন। তাঁর দাদামশাইয়ের কাছে পরে অবশ্য বাল্যসঙ্গী-গিরিধারী লালনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এরপর নন্দিনী-গিরিধারী শান্তিনিকেতনেই থেকে গিয়েছিলেন। সাহিত্যচর্চা, গান ও নাচে কবির প্রাণ নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন।
সৌমেন সুর: ১৮৭৩ সাল, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১১ বছর ৯ মাস। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সে সময় তাঁর উপনয়নের আয়োজন হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ ও নাতি সত্যপ্রসাদের উপনয়নের ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথের উপনয়নের সময় পুরোহিত ছিলেন শ্রী আনন্দচন্দ্র বেদান্ত বাগীশ এবং আচার্য ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পৈতের নিয়ম অনুসারে বিভিন্ন রকম আচার অনুষ্ঠানের পরে গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ব্রহ্মচারী 'ভবতি ভিক্ষাং মে দেহি' এই মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমেই মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজনের কাছে ভিক্ষা করে সেই ভিক্ষান্ন আচার্য গুরুকে দান করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্রহ্মচারী বাক সংযত হয়ে পরে গায়ত্রী মন্ত্র জপের পর হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন।
উপনয়নের পর গায়ত্রী মন্ত্র জপের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ মনে মনে কোনও এক অসীম শক্তির উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। এই মন্ত্র জপ করার সময় তিনি গ্রহমণ্ডলী এবং ব্রহ্মাণ্ডের বিরাট রূপকে কল্পনায় অনুভব করতেন। উপনয়নের পর তিনদিন নির্জন বাসের নিয়ম। এই তিনদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়। কারও মুখ দর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, একমাত্র মা ছাড়া। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'তিনজন তেতলার ঘরে তিন দিনের জন্য আবদ্ধ হইলাম। সে আমাদের ভারী মজা লাগিল। পরস্পরের কানের কুণ্ডল ধরিয়া টানাটানি বাঁধাইয়া দিতাম। একটা বায়া ঘরের কোণে পড়িয়াছিল, বারান্দায় দাঁড়াইয়া যখন দেখিতাম নীচের তলা দিয়া কোনও চাকর চলিয়া যাইতেছে-ধপাধপ শব্দে আওয়াজ করিতে থাকিতাম, তাহারা উপরে মুখ তুলিয়াই আমাদিগকে দেখিতে পাইয়া তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করিয়া অপরাধের আশঙ্কায় ছুটিয়া পালাইয়া যাইত।'
উপনয়ন শেষ হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ গায়ত্রী মন্ত্র আবৃত্তি এবং তাঁর অন্তরের উপলব্ধির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, আবৃত্তির সময় তাঁর চোখ বেয়ে জল পড়ত। কেন পড়ত সেটা বুঝতে পারতেন না। আসল কথা, অন্তরের অন্তঃপুরে যে কাজ চলছে, বুদ্ধির ক্ষেত্রে সব সময় তাঁর খবর এসে পৌছয় না। পরবর্তী জীবনে রবীন্দ্রনাথের নিজের ক্ষেত্রেও এই মুল্যবান তথ্যটি ভীষণভাবে প্রযোজ্য। তিনি জীবন স্মৃতিতে লিখেছেন, 'শান্তিনিকেতনে এসেই আমার জীবনে প্রথম সম্পূর্ণ ছাড়া পেয়েছি বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে। উপনয়নের পরেই আমি এখানে এসেছি, এখানে বিশ্বদেবতার কাছ থেকে পেলাম সেই দীক্ষা।'