সৌমেন সুর: মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর সময় হলো শৈশব। কোন পিছুটান নেই। শুধু খেলা, মজা আর আনন্দ। তবে সবার জীবন সমান নয়। কারো কারো জীবনে আনন্দের লেশমাত্র নেই। প্রখ্যাত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলা কেমন ছিল সেটাই আজ আলোচনা করবো।
বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স যখন ২৩ কি ২৪, তখন গোঘাটের রামকান্ত তর্কবাগীশের মেয়ে ভগবতী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ঠাকুরদাসের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। এই সুখবরটা ছেলে ঠাকুরদাসকে জানাবার জন্য রামজয় কোমরগঞ্জে রওনা দেন, যেখানে ঠাকুরদাস কাজের সুবাদে থাকেন। পথে রামজয়ের সঙ্গে ছেলের দেখা হয়ে যায়। রঙ্গ করে তিনি বলেন, 'বাড়ি এসো। একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে।' ঠাকুরদাস রঙ্গটা ধরতে পারেননি। তিনি বাড়ি ফিরতেই হাসতে হাসতে রামজয় ঠাকুর দাসকে নবজাতকের মুখ দেখিয়ে বললেন, 'একে আমি এড়েঁ বাছুর বলেছিলাম। কারণ এই ছেলে এঁড়ে বাছুরের মতো একগুঁয়ে হবে, যা ধরবে তাই করবে। কাউকে ভয় করবে না। ও হবে ক্ষণজন্মা, প্রথিতযশা। ওর জন্য আমার বংশ ধন্য হবে। ওর নাম রাখা হোক ঈশ্বরচন্দ্র।'
পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে ভর্তি করানো হলো গ্রামের কালীকান্ত চ্যাটার্জির পাঠশালায়। পড়াশোনায় তাঁর ছিল ভীষণ টান। পাশাপাশি দুষ্টুমিতে ছিলেন তুলনাহীন। (চলবে) তথ্যঋণ/ দেবশ্রী ভট্টাচার্য
সৌমেন সুর: বাংলার কৃষক ও গণ আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় আন্দোলন তেভাগা আন্দোলন। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে তেভাগা কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের দাবিতে। বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী নেতারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাধারণ কৃষক-জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হল তেভাগা আন্দোলন। তাদের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, স্বঅধিকারের জন্য এই লড়াই। প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের পর...
১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা মুছে ফেলে অবিভক্ত বাংলার গ্রামগঞ্জে কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তেভাগার দাবিতে লড়াই করে। সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সংহতি ছিল তেভাগা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বহু চেষ্টা করেও এই ঐক্য নষ্ট করতে পারেনি জমিদার, জোতদার শ্রেণি। বন্দুক গল্পের রচয়িতা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। এই গল্পের গুণ্ডা চরিত্র রঘুরামকে ঘিরে চরিত্রের রূপান্তর ঘটেছে। তবে এই গল্পে আরও একটা দিক দেখানো হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি।
কৃষক নেতা রহমানের নেতৃত্বে গ্রামবাসী একত্রিত হয়েছে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছে। তারা ঠিক করেছে উৎপন্ন ফসলের একভাগ দেবে মহাজনদের আর দু'ভাগ নিজেদের গোলায় উঠবে। তাঁদের মেলবন্ধন ও সংগঠিত আন্দোলনকে নষ্ট করার জন্য জোতদার ফজল আলি ধর্মের দোহাই দিয়ে রহমানকে দূরে থাকতে বলে।
কিন্তু গ্রামবাসী এ কথায় কান দেয় না। আসলে এখানে ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, শোষক এবং শোষিতের বিষয়ে দুই শ্রেণি। আর এখানে রহমান-সহ গ্রামবাসীরা শোষিতের মধ্যে এক শ্রেণি। অন্যদিকে ফজল আলি, লোকনাথ সাহা, বৃন্দাবন পালেরা সবাই শোষক সম্প্রদায়ভুক্ত। ছলে বলে কৌশলে কৃষকদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করলেও ভাঙতে পারেনি মহাজনের দল।
তখন শোষক শ্রেণি ভাড়া করা গুণ্ডা রঘুরামকে ডেকে বন্দুক তুলে দেয় হাতে। এখানেই ঘটে চরিত্রের রূপান্তর। রঘুরাম বুঝতে পারে কৃষক নেতা রহমানের মূল্য। তেভাগা আন্দোলনে সব শ্রেণির মানুষের ঐক্য আজ নৈতিক জয়ের পূর্বাভাস। রঘুরাম বন্দুক সমর্পণ করে দেন। (তথ্যঋণ: মাসরেকুল আলম)
সৌমেন সুর: বাংলার কৃষক ও গণ আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় আন্দোলন তেভাগা আন্দোলন। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে তেভাগা কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের দাবিতে। বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী নেতারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাধারণ কৃষক-জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হল তেভাগা আন্দোলন। তাদের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, স্বঅধিকারের জন্য এই লড়াই। প্রথম পর্বের পর...
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তার, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, পঞ্চাশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, মহামারি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি এসবের হাতছানি থেকেই প্রসার ঘটেছে তেভাগা কৃষক আন্দোলনের। এই আন্দোলনের ছায়া বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পে প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হারানের নাত জামাই'। তেভাগা আন্দোলনের নেতা ভুবন মণ্ডলকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে গল্পের প্লট। বিপ্লবী ভুবনকে পুলিস সালিগঞ্জ গ্রামে হারানের বাড়িতে গ্রেফতার করতে এলে, হারানের মেয়ের বুদ্ধিতে ময়নার জামাই সেজে পুলিসকে ফেরত পাঠায়। এমতাবস্থায় গ্রামের সাধারণ চাষীগণ শ্রেণি চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
লেখক সমরেশ বসুর গল্প প্রতিরোধ। তেভাগার দাবিতে মুখর গ্রামের কৃষকরা স্থির করেছে জমিদার পীতাম্বরকে অর্ধেক ফসল দেবেন। অন্যদিকে জমিদারের গুণ্ডাবাহিনী এবং পুলিস মিলে গ্রামে সন্ত্রাস চালাতে দ্বিধা করেনি। গ্রামের নারীদের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালায় তাঁরা। মনাইয়ের প্রসূতি বউ রাধার ভূমিকা চোখে পড়ার মতোন। সে ধান বাঁচাতে নিজের প্রাণ দেয়। কিন্তু বিদ্রোহ আরও তীব্র রূপ নেয় সুবল অংশ নেওয়াতে। (চলবে) তথ্যঋণ: মাসরেকুল আলম
সৌমেন সুর: বাংলার কৃষক ও গণ আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় আন্দোলন তেভাগা আন্দোলন। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে তেভাগা কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের দাবিতে। বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী নেতারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাধারণ কৃষক-জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হল তেভাগা আন্দোলন। তাদের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, স্বঅধিকারের জন্য এই লড়াই।
এই আন্দোলনকে দমাতে জোতদার, জমিদার, পুলিসের সম্মিলিত নিপীড়ন, নির্যাতন, দমন-পীড়ন, গুলি, হত্যা, নারীদের শ্লীলতাহানি নির্বিচারে চলেছে। তবে কৃষক সমাজ দমে যায়নি। একজোট হয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। হিন্দু মুসলমান ঐক্য এই আন্দোলনকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। সমাজ এবং সময়কে নিয়ে তৈরি হয় সাহিত্য এবং সেখানে মানুষ অংশগ্রহণ করে। সেদিক থেকে তেভাগা কেন্দ্রিক সাহিত্যের শাখা বাংলা ছোট গল্পে সমৃদ্ধ। যাঁদের লেখা গল্পে তেভাগার স্পষ্ট ছোঁয়া আছে, তাদের কিছু নাম ও কিছু কথা সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।
লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-- গল্প/ছোট বকুলপুরের যাত্রী। তেভাগার সময় পরিবেশ ছোট বকুলপুর পুলিস পাহারা দিচ্ছিল। এমতাবস্থায় দিবাকর স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে আন্নার ভাইদের খবর নিতে সেখানে উপস্থিত হয়। ঘটনাস্থলে পুলিস তাদের নানাভাবে তদন্ত করে। সন্দেহ করে তাঁরা বিপ্লবী হতে পারে। শেষ পর্যন্ত একটা গানের কাগজে লেখা শব্দ দেখে দিবাকরকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং গ্রেফতার করে। (চলবে) তথ্যঋণ: মাসরেকুল আলম
সৌমেন সুর: রবীন্দ্র সাহিত্যে মৃত্যু কোথাও ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশ পায়নি। মৃত্যু, খুন বা আত্মহনন যাই হোক না কেন, কোথাও তার বীভৎস্য বর্ণনা নেই বললেই চলে। 'পণরক্ষা' গল্পে বংশীবদনের মৃত্যু তার ভাই রসিককে ক্ষমাহীন, প্রায়শ্চিত্তের উপায়হীন একটা জগতে নির্বাসিত করে দিয়ে গেছে। বংশীর মৃত্যুর খবর রসিক জানতো না। লেখক তা জানিয়েছেন একটিমাত্র বাক্যে। দীর্ঘকাল বাদে বাড়ি ফিরে দাদাকে বারবার ডাকলেও- 'যে দাদা তাহার পায়ের শব্দটি পাইলে আপনি ছুটিয়ে আসিতো, কোথাও তাহার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। '
'জীবিত ও মৃত' গল্পের শেষ বাক্যটি প্রবাদ বাক্যের মতো হয়ে উঠেছে। কাদম্বিনী জীবনের সব লাঞ্ছনা, অপমানের সমাপ্তি ঘটেছে আত্মহত্যায়- পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে। শারদ-শংকর উপরের ঘর হইতে শুনিতে পাইলেন ঝপাস করিয়া একটা শব্দ হইলো। কাদম্বিনী অনাড়ম্বর মৃত্যু বর্ণনার শেষে লেখকের সংযোজন- 'কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।'
শুধু রবীন্দ্র সাহিত্যে নয়, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি ছোট গল্প-'ছুটি'। তরতাজা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একটা বালকের মৃত্যু কতটা মর্মান্তিক, ফটিকের প্রলাপ মৃত্যুশয্যায় এবং ডাক্তারের চেষ্টা ব্যর্থ করে তার চলে যাওয়ার মধ্যে কোথাও শোকের বাড়াবাড়ি, দুঃখের চড়া রং নেই। শেষ মুহূর্তে শোকাচ্ছন্ন মায়ের ব্যাকুল আহ্বান শেষবারের মতো সাড়া দিয়ে শেষ কথা বলে ফটিক- 'মা এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।'
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে অসংখ্যবার মৃত্যুর দশা এসেছে। কোথাও তার শোক উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়িতে বিহ্বল নয়। বরং শান্ত সৌম্য সংযত। বিশ্বপথিক এক জীবনে তার চলার শেষ করতে পারে না। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বারেবারে নতুন করে তাকে চলার পথ চিনে নিতে হয়। (সমাপ্ত)
সৌমেন সুর: মৃত্যু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আত্মোপলব্ধি আত্মপ্রকাশ করেছে তাঁর সৃষ্টিতে বহুভাবে। তাঁর দীর্ঘ জীবনে অজস্র মৃত্যুর আঘাত তাঁর চিন্তায় চেতনায় ছড়িয়ে দিয়েছে গভীর নিমগ্ন ভাবকনাগুলো। যা তাঁকে দিয়ে বারবার উচ্চারণ করিয়েছে 'মৃত্যুকে লব অমৃত করিয়া তোমার চরণে ছোঁয়ায়ে।' রবীন্দ্র সাহিত্যে মৃত্যু কোথাও ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশ পায়নি। খুব সংক্ষিপ্ত কথায় মৃত্যুর ছবি আমরা পেয়েছি- এত স্বাভাবিক, গুরুত্বহীন বর্ণনা, অথচ তার অনুষঙ্গ কী গভীর এবং বেদনাময়। আবার কোথাও বা ছোট্ট একটা কথায়, একটা উপমায় বুনে দিয়েছেন গভীর আস্তরণ, যা আমাদের আবিষ্ট করে তোলে। রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের কিছু মৃত্যু দৃশ্য তুলে ধরলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
'ঘাটের কথা' ছোট গল্পে কুসুমের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ কী স্নেহকোমল করে তুলেছেন তাঁর বর্ণনায়- 'এতটুকু বেলা হইতে সে এই জলের ধারে কাটাইয়াছে, শ্রান্তির সময় এই জল যদি হাত বাড়াইয়া তাহাকে কোলে করিয়া না লইবে, তবে আর কে লইবে।' 'কঙ্কাল' গল্পে একজন নাসিসিষ্ট মেয়ে কীভাবে কঙ্কালে পরিণত হলো তার বর্ণনা। প্রেমে ব্যর্থতা এবং তার জন্য বিষ খেয়ে আত্মহত্যার কাহিনীতেও মৃত্যুকে রোমান্টিক করে তোলা হয়েছে নায়িকার অন্তিম ভাবনায়- 'ইচ্ছা ছিল যখন লোকে আসিয়া আমাকে দেখিবে তখন এই হাসিটুকু যেন রঙিন নেশার মতো আমার ঠোঁটের কাছে লাগিয়া থাকে।' (চলবে)
সৌমেন সুর: একটি নারী অনন্ত শক্তির অধিকারিণী। নারী এক অসীম, অনন্ত শক্তির আধার। প্রত্যেক নারীর মধ্যে স্নেহ, মায়া, মমতা, ত্যাগ, নিষ্ঠা, স্বার্থপরতার সঙ্গে একটা অনন্য গুণাবলী সহাবস্থান করে। সব অগোছালো জঞ্জাল, পাঁক সরিয়ে এক সুন্দর সমাজ, সংসার গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী নারীর মধ্যে বিদ্যমান। নারীর মধ্যে যে শক্তির অন্তঃসলিলা গঙ্গা প্রবাহিত হয়ে চলেছে সৃষ্টির আদিকাল থেকে, সেকথা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, জেনেছি পড়েছি পুরাণে ইতিহাসে। মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গরাজ্যে যখন ত্রাহি ত্রাহি রব, দেবতারা যখন দিশেহারা, ঠিক সেই সময় আবির্ভূত হলেন এক মহাশক্তি। সেই মহাশক্তি অসীম পরাক্রমশালী দেবী দুর্গা। এই দুর্গাই পরাজিত করেন মহিষাসুরকে।
অরুন্ধতি ভট্টাচার্য। চড়াই-উতরাই নিয়ে তাঁর জীবন কাহিনী। শিক্ষা সমাপ্ত করে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফিনান্স ম্যানেজারের আসনে যোগদান আশির দশকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর উত্থান। ধাপে ধাপে এমডি থেকে হলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রথম মহিলা চেয়ারপার্সন। ২০১৬ আলে ফোর্বস তাঁকে সবচেয়ে শক্তিশালী ২৫ মহিলার তালিকাভুক্ত করে সম্মানিত করে। এশিয়া প্যাসিফিক অরুন্ধতী ভট্টাচার্যকে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী মহিলারূপে মনোনীত করে অনন্য সম্মান দেন। ২০১৭ সালে ইন্ডিয়া টু ডে ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ৫০ জন শক্তিশালী মহিলার একজন বলে শিরোপা দেন। ভারতবর্ষ তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসে অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের মতো ব্যক্তিত্ব বিরল।
যা নারী শক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রথমে বাঙালি তারপর ভারতীয় হিসেবে অরুন্ধতী ভট্টাচার্য আমাদের গর্ব।
সৌমেন সুরঃ ছোটগল্প, উপন্যাস ও শিশুসাহিত্যে দৌলতউন্নিসার বিশেষ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'পরশপাথর'। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যুক্ত হন দৌলতউন্নিসা। ওঁর শ্বশুরবাড়ি গাইগান্ধা। গাইগান্ধা মহিলা সমিতির সম্পাদক তিনি। তাঁর জ্বালামুখী বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে ৭/৮ গ্রামের মেয়েরা, এমন কি মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েরা পর্দা সরিয়ে ছুটে আসত তাঁর সভায় যোগ দিতে। রাগে-ক্ষোভে ব্রিটিশ পুলিসরা যোগদানকারীদের বসত বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দিত। তবু দৌলতকে দিমিয়ে রাখতে পারেনি। সভার পর সভা করে গেছিলেন। অবশেষে পুলিস ফুলছড়ি গ্রামের সভা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকায়। তবু আন্দোলন থেমে থাকেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম মেয়েরাও যে ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে প্রতিবাদ করতেন তার প্রামাণ দৌলতউন্নিসা।
অথচ ওঁর ত্যাগ, সংগ্রামী চেতনা, নাম, আমরা কজনই বা জানি। ইতিহাসের অন্তরালে হারিয়ে গেছে এমন অনেক অজানা আত্মত্যাগী মানুষ। যখন পুলিস দৌলতউন্নিসাকে ধরে, তখন তাঁর শাস্তি ছিল এমন, রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি, বহরমপুর প্রভৃতি জেলে তাঁকে পাল্টে পাল্টে রাখা হতো। যাইহোক দৌলতউন্নিসা যে ব্রিটিশদের একসময় ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল, একথা প্রমাণিত সত্য। শুধু মুসলিম পুরুষরা নয়, মেয়েরা স্বাধীনতা সংগ্রামে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। (সমাপ্ত)
তথ্যঋণ: সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার মেয়েদের বাড়ির সদর দরজার বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তাঁরা পর্দাসীন ছিল। তবু শত শত নারী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিল স্বাধীনতার নিরিখে। নিজেদের নাম, যশ, মোহ ত্যাগ করে স্বাধীনতার সংগ্রামে জড়িয়েছিলেন বহু নারী। তৎকালীন সমাজে কোণঠাসা হয়ে থাকা মেয়েরা নিজের নিজের জায়গা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজ করেছেন গোপনে বা প্রকাশ্যে। কেউ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ প্রাণ দিয়েছেন, কেউ বা ব্রিটিশ পুলিসের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রাণকে আত্মহুতি দিয়েছে দেশমাতৃকার চরণে। প্রথম পর্বের পর...
সত্যবতীকে পুলিস জেলে চালান করে। তিন মাস জেল খেটে মুক্তি পেয়ে আবার দেশের হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনে নেমে পড়েন। ১৯ ফেব্রুয়ারি নন্দীগ্রামে এক রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে গিয়ে আবার গ্রেফতার হন সত্যবতী। এদিকে সূত্র মারফৎ পুলিস জানতে পারে সত্যবতী গোপনে খবর চালান করে বিপ্লবীদের। যার ফলে পুলিস ঘটনাস্থলে পৌছনোর আগেই বিপ্লবীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হত। এই খবর জানতে পেরে পুলিস সত্যবতীর উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। অত্যাচারের ফলে সত্যবতীর কিডনি ও অন্ত্র খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালে এই ক্ষতের চিকিৎসা সম্ভব হয়নি। ফলে সত্যবতী শহিদ হন।
দেশের কাজে তাঁর আত্মত্যাগ ভোলা সম্ভব নয়। তবু দেশের স্বাধীনতার কাজে তাঁর ভূমিকা আজও মানুষের কাছে অধরা হয়ে আছে। কজনই বা তাঁকে আমরা স্মরণ করি। এবার আপনাদের সামনে হাজির করছি বিপ্লবি দৌলতউন্নিসাকে। ইনিও হারিয়ে গিয়েছে অবহেলার স্রোতে। ছোট বয়স থেকে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই তিনি লিখতে শুরু করে যশোরের এই প্রতিভাবান ছাত্রী। ঢাকার ইডেন স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন। এছাড়া দেশ, বঙ্গশ্রী ও বিচিত্রা পত্রিকায় তিনি লেখালেখি করতেন। তখনকার দিনে মেয়েদের পড়াশোনা এমনকি কোনও সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকা সমাজ পছন্দ করতো না। তাছাড়া মুসলমান সমাজের কোনও মেয়ে পড়াশোনা করে উন্নতি করুক এটা তখনকার সময়ে সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল। কিন্তু দৌলতউন্নিসার বাবা, মা এবং স্বামীর সমর্থনে পড়াশোনার দরজা খুলে যায়। (চলবে)
তথ্যঋণ: সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌমেন সুর: ভারতীয় নৃত্যশাস্ত্রের এক অতি প্রাচীন নৃত্যকলা ভরতনাট্যম। অনেকে মনে করেন ভরত মুনি এর প্রবর্তন করেছিলেন বলে এই নৃত্যকলার নাম ভরতনাট্যম। ভাব,রাগ ও তালের সমন্বয়ে অপূর্ব মিশেলে সৃষ্টি এই নৃত্যকলা। ভরতনাট্যমের ভাবধারা মূলত ধর্মভিত্তিক এবং দেবতা কেন্দ্রীক। মহাদেব শিবকে এই নৃত্যশৈলীর ভগবান বলা হয়। এই অসাধারণ নৃত্যশৈলী বহুদিন যাবৎ মন্দিরের দেবদাসীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে দেবদাসী প্রথা অবলুপ্ত হলে এই অসাধারণ নৃত্যশৈলীর অবলুপ্তি ঘটে।
প্রথম পর্বের পর... রুক্মিণী অরুন্দলে ১৯৫৬ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৬৭ সালে সঙ্গীত নাটক একাডেমির ফেলোশিপ পান। যারা ভারতকে গড়েছেন এমন ১০০ জন ভারতীয়কে তালিকাভুক্ত করে 'ইন্ডিয়া টু ডে'। তার মধ্যে রুক্মিণী দেবী অন্যতম। দক্ষিণ ভারতীয় এই নৃত্যধারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রুক্মিণী কঠোর পরিশ্রম করেন। পুরাণ মতে, মুর দৈত্যকে বধ করে, দেবতাদের এবং স্বয়ং বিষ্ণুকে ভয়মুক্ত করতে দেবী চণ্ডী, দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতী একসঙ্গে মিলিত হয়ে বৈষ্ণো দেবী রূপ নেন।
কোনও অশুভ শক্তিকে নাশ করতে শুধু শক্তি নয়, অর্থ নয়, বিদ্যা ও জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে।। অনিয়ন্ত্রিত শক্তি এবং অর্থ কোনওটাই পৃথিবীকে মঙ্গল করতে পারে না। আর বিদ্যার একমাত্র সুন্দর মাধ্যম হল সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের স্বাদ থেকে নারী কীভাবে বঞ্চিত থাকতে পারে! পৃথিবীর প্রথম দিন থেকে কেন জানি না নারীর চলার পথ অপেক্ষাকৃত বেশি কঠিন, ধরিত্রির মতোই প্রতিদিন প্রতিনিয়ত একের পর এক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে বলেই হয়তো নারীকে সর্বসহা উপাধি দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা চলছে। তবে পথ যত কঠিন, নারীরা তার চেয়েও যে কঠিন এই পরীক্ষা নারী যুগে যুগে দিয়ে এসেছে।
সৌমেন সুর: চৌকিদার হবে একজন মহিলা! শুনতে খটকা লাগছে না? এতদিন শুনেছি চৌকিদার সাধারণত হয়ে থাকে একজন পুরুষ। কিন্তু ঘটনাটা সত্যি সত্যি ঘটেছে। কিন্তু মহিলা চৌকিদার, অসম্ভব! স্বাস্থ্যবতী বিধবা মহিলা কোলে একটা শিশু নিয়ে অসহায় অবস্থায় গ্রামের কিছু লোকের সঙ্গে শহরে এসে পুলিস দফতরে দরখাস্ত জমা দেয়। দরখাস্ত দেখে পুলিস দফতর হেসে কুটোকুটি। একজন মহিলা হবে চৌকিদার! সবাই তাচ্ছিল্য করতে থাকে।
একদা বর্ধমান জেলার কালনা বিভাগের মধ্যে আবাদী দুর্গাপুর নামে ছোট একটি গ্রাম। মুসলিম এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বাস এই গ্রামে। বৈকুণ্ঠ সর্দার হলেন এই গ্রামের চৌকিদার। দ্রবময়ী হলেন বৈকুণ্ঠের স্ত্রী। বৈকুণ্ঠ তাঁর স্ত্রীকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুব জোরদার লাঠিখেলা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। কখনও বৈকুণ্ঠের শরীর খারাপ হলে দ্রবময়ী গ্রাম পাহারা দিতেন। একথা গোটা গ্রাম জানত, কিন্তু কখনও পুলিসের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানায়নি। একদিন হঠাৎ বৈকুণ্ঠ এক অজানা অসুখে মারা যান। দ্রবময়ী অথৈ জলে পড়েন। কী করে সংসার চলবে? বাবা মা, একটা ছোট শিশু নিয়ে সংসার! মনকে প্রস্তুত করেন, চৌকিদারের কাজ তাঁর চাই-ই চাই।
পুলিসের বড় সাহেব দ্রবময়ীকে অন্যদের মতো হাসির পাত্র না করে, বর্ধমান পুলিসের বড় সাহেবের কাছে দরখাস্ত সমেত দ্রবময়ীকে পাঠিয়ে দেন। বড় সাহেব একটু চিন্তায় পড়লেন, চৌকিদারের কাজে মহিলা নিয়োগ কী করে করবেন। এই চাকরিতে লাঠি খেলায় চোস্ত হতে হবে। একটা পরীক্ষা করে দেখা যাক, লাঠিখেলায় এই মহিলা কতটা পারদর্শী। সেদিন পুরুষের সঙ্গে এই মহিলার লাঠিখেলা দেখতে প্রচুর ভিড় জমে মাঠে।
১৯১৮ সালে 'আর্যাবর্ত' পত্রিকায় এই লাঠিখেলা প্রসঙ্গে সুন্দর বর্ণনা করেছিল। দ্রবময়ী ভীষণ সাহসে লাঠি খেলতে মাঠে নেমে পড়েন। মহিলা দ্রবময়ী পুলিস সাহেবকে সেলাম ঠুকে লাঠি নিয়ে প্রস্তুত। কিন্তু পুরুষ লাঠিয়াল একটু হালকা চালে লাঠি খেলে। এই দৃশ্য দেখে দ্রবময়ী আবেদন করেন প্রকৃত লাঠিখেলা যেভাবে হয়, সেভাবে খেলতে। তিনি জানান, প্রয়োজনে দু'জনকে লড়তে বলুন আমার বিরুদ্ধে। অবশেষে সাহেব সংকেত দেয়, লাঠিখেলা শুরু হয়। দ্রবময়ী অনেক কসরতে ধরাশায়ী করেন দু'জন কনস্টেবলকে। উপস্থিত দর্শক আনন্দে-উল্লাসে দ্রবময়ীকে সেদিন আশীর্বাদ করেছিল। পুলিস সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আলোচনা করে দশ টাকা ইনাম ঘোষণা করেন এবং এক সের মিঠাই বাচ্চাটার জন্য।
তখনকার পুরুষশাসিত সমাজে দ্রবময়ী দাসী নামে একজন সাধারণ মহিলা অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে, মৃত স্বামীর চাকরিতে নিজে বহাল হয়েছিলেন। সেইসঙ্গে স্বীকৃতি পান দেশের প্রথম মহিলা চৌকিদার দ্রবময়ী দাসী।
বিশ্বকাপ টি-২০ জমে উঠেছে। আচমকাই রবিবারের মস্ত ধাক্কা টুর্নামেন্টের রং পাল্টিয়ে দিল। ছুটির দিনে অনেকেই দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। রবিবারের একমাত্র খেলায় ধরে নিয়েছিল ভারতীয় দর্শকরা যে ভারত কোনও ভাবে জিম্বাবোয়েকে হারাক, শান্তিতে ভারত এক নম্বর হয়ে সেমিফাইনালে যাক। লোকের ধারণা আর কি বা রয়েছে রবিবাসরীয়তে? কারণ আজকের একটি খেলা দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম নেদারল্যান্ড, যেখানে টুসকি দিয়ে জিতে যাবে আফ্রিকানরা। আর খেলে বলতে পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ যেখানে ফল নিয়ে কি লাভ, কারণ এরা তো কেউই তো আর সেমিফাইনালে যাবে না। কিন্তু ক্রিকেট এক বলের খেলা, কখন কি হয়ে যাবে কেউই কি বলতে পারে?
কার্যত রবিবারের রবির রং পাল্টিয়ে ফেললো সমস্ত জল্পনা। ভারতীয় সময় আলো না ফোটা সকালে শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম নেদারল্যান্ডের খেলা। চিরকালের চোকার্স দক্ষিণ আফ্রিকা সদ্য বিশ্ব ক্রিকেটে আসা ফুটবলের চোকার্স দেশ নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলো। জমে গেলো ক্রিকেট। সকলের কাছে মৃত্যু থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কাছে সুযোগ এসে গেল। যে জিতবে সেই যাবে সেমিফাইনালে। এবং এবার আর সুযোগ নষ্ট করলো না পাকিস্তান। বাংলাদেশকে অনায়াসেই হারিয়ে এবারে সেমিতে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি। অন্যদিকে ভারত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইংল্যান্ডের সঙে লড়াইতে।
ইতিহাস কি ফিরে আসে? ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেমিফানালে পৌঁছেছিল। তারপর জিতে ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ইমরান খান বিশ্বকাপের দখল নিয়েছিল। দেখার বিষয় ভারত কি হারাতে পারবে ইংল্যান্ডকে? যদি পারে তবে অন্য খেলা, কিন্তু যদি ইংল্যান্ড ফাইনালে ওঠে? সেবারেও কিন্তু টুর্নামেন্টটি অস্ট্রেলিয়াতেই হয়েছিল ঠিক ৩০ বছর আগে।
সৌমেন সুর: নেই সেই আইসক্রিম, নেই সেই হজমি কেনার ছুট, নেই সেই এক মুঠো সোনালী শৈশব। এখন সবকিছুই ফিকে। আছে শুধু সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পড়ার চাপ আর শাসনের ভ্রুকুটি। চোখের সামনে ফুটে ওঠে কবি ভবানীপ্রসাদের কয়েকটা লাইন। " কেউ বলে না তোমরা সবাই ফুলের মতো ফোটো/ কেউ বলে না সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠো/ একটা কথা রাখবে মনে মাস্ট/ সবকিছুতেই হতেই হবে ফার্স্ট।" ফার্স্ট হওয়া ছাড়া মা-বাবার মুখে যেন অন্য কথা নেই। যেমন করে হোক তোমাকে ফার্স্ট হতেই হবে।
অদ্ভুত লাগে এই সময়কে। আমরাও তো একসময় শিশু ছিলাম। কত রকম খেলা খেলেছি শৈশবে। আবার নিয়মের বেড়াজালে মানুষ হয়ে শাসনের মতো বার্তাও পালন করেছি। তবে শাসন সেই সময় ছিল একটু অন্য ধাঁচে। সেটা শৃঙ্খলায় ভরা এক নরম গরম স্বভাবের শাসন। মন চলে যায় শৈশবে। ধুলোবালি মেখে নিজেকে ফিরে দেখার সেই শৈশব। অজান্তে আকাশের পানে চলে যায় মায়াবী চোখ। নীলাকাশে খন্ড খন্ড মেঘগুলো দেখে মনে হয়— আমারই মতো সবাই শৈশবে ফিরে পেতে চায়। সবাই ব্যস্ত। শুধু ছুট-ছুট আর ছুট। অর্থই কি জীবনের লক্ষ্য? এই যন্ত্রের চাকায় প্রতিমুহূর্তে মরে যাচ্ছে আমাদের মন। লোকদেখানো আর যান্ত্রিকতাই হয়েছে মূল লক্ষ্য।
শিক্ষা উদারতা আনে। শান্তি জীবনকে তৃপ্তি দেয়। এ কোন সময়! যেখানে আদর্শ, সারল্য এই শব্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছে সোনালী শৈশবের মতো। যেন রাতের তারারা লুকিয়ে আছে দিনের আলোর গভীরে। শব্দ নেই, গুঞ্জন নেই। বেঁচে আছে মৃতের মতো।
মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষ শেষ হয় এবং সূচনা হয় দেবীপক্ষের। মহালয়ার দিনে পিতৃপুরুষদের তর্পণ করার প্রথা প্রচলিত আছে। পিতৃপক্ষের সময় বিদেহী আত্মারা জল গ্রহণের জন্য মর্ত্যে আসেন। তার পর থেকে দীপাবলি পর্যন্ত তাঁরা মর্ত্যেই বিচরণ করেন। দীপাবলির সময় পিতৃলোকে ফিরে যান তাঁরা। কিন্তু যেদিন তাঁরা ফিরে যান সেই দিনটি আসলে অমাবস্যা। এই অন্ধকারে পিতৃপুরুষদের যাতে ফিরে যেতে সমস্যা না-হয়, তাই তাঁদের উদ্দেশে অন্ধকার পথ আলোকিত করে রাখা হয়। তাই ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় প্রদীপ।
এ ভাবে কালীপুজোর সঙ্গে প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা জড়িয়ে পড়েছে। তবে দীপান্বিতা অমাবস্যার সময় কেন কালীপুজো করা হয়, তারও ইতিহাস রয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের স্মার্ত পণ্ডিত ও নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপুজোর বিধান দেন। তবে কালীপুজোর কোনও উল্লেখ করেননি তিনি। এর পর অষ্টাদশ শতকে প্রকাশিত কালী সপর্যাস বিধিতে প্রথম বার দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সপ্তদশ শতকে বাংলায় কালীপুজোর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকেই বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক বলে মনে করা হয়।
এর আগে কালীর উপাসকরা তামার টাটে কালীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে তাঁর পুজো করতেন। অষ্টাদশ শতকে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এর পর উনিশ শতকে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজো জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সৌমেন সুর: ইতিহাসের কত পট পরিবর্তন হয়েছে। সভ্যতা বিবর্তিত হয়েছে, সেই সঙ্গে মানুষের জীবনধারাও পাল্টেছে। তবু হিংসা, বিদ্বেষ থেকে মানুষের মুক্তি ঘটেনি। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ হিংসার ছোবলে প্রাণ হারায়। আজও কত রক্তপাত, দলাদলির নির্লজ্জ বীভৎস ছবি। কেন এত রক্তপাত! কেন আজও হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী! কেন মানুষের ভিতরের হিংস্রতার আদিম পশুটা ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে? জীবনের এটাই কি অপরিহার্য ললাট লিখন?
শুরু হলো বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। মানুষ হাতে পেল ভয়ংকর সব অস্ত্রশস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমা- নাগাসাকিতে খেলা হলো শক্তিশালী অ্যাটম বোম। নিমিষে ধ্বংস হয়ে গেল দুটো শহর। এই দৃশ্যের পরেও শেষ নেই হিংসা-বিলাসের। আজও চলছে উৎপীড়ন। রক্তের হোলি খেলায় সমাপ্তি ঘটলো না। দিন বদলায়। সমাজ পাল্টায়। রাজার রাজত্ব যায়। বিজ্ঞান তার গতিপথে এগিয়েই চলে। জনপ্রতিনিধিরা শাসকের আসনে বসেন। কোথায় গেল শহর সাজে নতুন নতুন উপকরণে। বারে শ্রমজীবীর দল। শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক তিক্ত হয়। অসন্তোষ বাড়ে। শোষিতের দল চায় এক শোষণমুক্ত সমাজ। তার জন্য আন্দোলন, মৃত্যুবরণ। সব রাজনৈতিক দল চায় দেশের মঙ্গল, মানুষের কল্যাণ। কে কাকে টপকে শাসকের ভূমিকা নেবে, তাই নিয়ে চলে রেষারেষি, হিংসা, মারামারি, খুনখারাপি। দলের লোক খারাপ হলেও ভালো। ভালো লোক অন্য দলের হলে খারাপ। এই ভাবেই সমাজ বিরোধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। বর্তমানে ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই ক্ষমতার লড়াইয়ে খুনোখুনি হিংসা বেড়েই চলেছে।
হিংসা মানুষের জীবনে সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়। জীবনে প্রেম, জ্ঞান ও মৈত্রীর পথ দেখিয়েছেন। যে সমস্ত অবতার ও ধর্মীয় মহাপুরুষ দেখিয়েছেন মানুষের মুক্তির পথ, একদিন এদের নির্দেশিত পথে বিকশিত হয়ে মানুষ চেতনার আলোই আলোকিত হবেই। অন্ধ সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ রোগমুক্তির ঠিকানা খুঁজে পাবেই। তখন মানুষ শান্তিতে বিরাজ করবে, নচেৎ নয়।