'সন্দেশখালির বাঘ'-এর চোখে জল। একসময় যাঁর দাপটে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত, আজ সে নিজের অশ্রু আর ধরে রাখতে পারলেন না। মেয়ের 'আব্বা' ডাক আর স্ত্রীয়ের কান্না শুনে একেবারে মুষড়ে পড়লেন বেতাজ বাদশাহ শেখ শাহজাহান। মুখ ঘুরিয়ে চোখের জল মোছার আগে স্ত্রীকে 'আল্লাহর কাছে দোঁহা' করার কথা বলেন। সোমবার বসিরহাট মহকুমা আদালতের বাইরে এক অন্য রূপ দেখা গেল শাহজাহানের।
সোমবার শাহজাহান, আলমগীর, শিবু হাজরা, মাফুজার মোল্লা, জিয়াউদ্দিন, দিদার-সহ মোট ১২ জনকে বসিরহাট মহকুমা আদালতে হাজির করানো হয়। তাঁদের ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ। সাসপেন্ডেড তৃণমূল নেতাকে যখন প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাঁর স্ত্রী তসলিমা বিবি, মেয়ে ও পরিবারের কয়েকজন। তখনই ক্যামেরায় ধরা পড়ে এমন বিরল মুহূর্ত।
জমি লুঠের পর এবার ইট ভাটাও গিলে খাওয়ার অভিযোগ শাহজাহান ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। সন্দেশখালির সরবেড়িয়ার ইটভাটা এসএনএফবি। বসিরহাটের ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় লিজ নিয়ে চালাচ্ছিলেন ভাটাটি। অভিযোগ, ভাটায় শ্রমিক সরবরাহ করতেন সরবেরিয়া আগারহাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রাক্তন সদস্য মীজানুর রহমান মোল্লা। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সন্দেশখালিতে প্রভাব বাড়তে শুরু করে শাহজাহানের। সেই থেকেই ইটভাটায় নজর পড়ে মীজানুরের। তারপর শুরু হয় ইটভাটা হাতানোর ফন্দি।
ইটাভাটার লিজ নেওয়া ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ভাটা হাতিয়ে নিতে তাকে খুনের পরিকল্পনা করেছিলেন মীজানুর। প্রাণভয়ে বসিরহাটের বাড়িতে ফিরে যান তিনি। এর মধ্যে দখল হয় ইটভাটা। ভাটা হারিয়ে দেনার দায় জর্জরিত হয়ে পড়েন ভবতোষ। মীজানুরের অত্যাচারে সর্বস্বান্ত হয়ে এখন প্রৌঢ়ের ঠাঁই বোনের বাড়িতে।
এখানেই শেষ নয়, ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় এক ব্যবসায়িক অংশীদার জানালেন, জ্বালানির কয়লা নিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা এখনও দেয়নি মীজানুর। গিয়েছিল শাহজাহানের কাছে বিচার চাইতেও। কিন্তু মেলেনি সুরাহা। তবে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে শাহাজাহান ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা মীজানুর রহমান মোল্লা।
ভয়,সন্ত্রাসে একদিন চাপা পড়ে ছিল সমস্ত অভিযোগ। শাহজাহানের গ্রেফতারির পর বেরিয়ে আসছে ক্ষোভ। জমি লুঠের পর এবার শাসকের থাবায় ইটভাটা? সন্দেশখালিকে কি ব্যক্তিগত সম্পত্তি বেছে নিয়েছিল শাহজাহান অ্যান্ড কোম্পানি?
সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহান ও তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জমি দখলের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে এই বিষয়টির তদন্ত করছে সিবিআই। শনিবার বিষয়টি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে সন্দেশখালির বিভিন্ন এলাকায় যান সিবিআই-এর আধিকারিকরা। শনিবার তাঁরা মাঝের সরবেড়িয়া এলাকার শ্যামল ঘোষের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছন। সেখানে তাঁরা শ্যামল ঘোষের জমি সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখেন। পাশাপাশি, দখল হয়ে যাওয়া জমিটিও তাঁরা ঘুরে দেখেন। সেই সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেও কথা বলেন তাঁরা।
অন্যদিকে, শনিবারই কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের নিয়ে সন্দেশখালির খুলনার ১০ নং পাড়ার সমীর মণ্ডলের বাড়িতে যান সিবিআই-এর ছয় সদস্যের একটি টিম। অভিযোগ, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর ও লুঠপাট চালিয়েছিল শাহজাহান বাহিনী। সেই অভিযোগের তদন্ত করতেই শনিবার তাঁর বাড়িতে যান সিবিআই আধিকারিকরা। সেখানে তাঁরা সমীর মণ্ডলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন।
এর পাশাপাশি, মহন্ত সর্দারের বাড়িতেও যান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা। মহন্ত সর্দারের অভিযোগ ছিল, মূলত শাহজাহানের ভাই শেখ আলমগীরের বিরুদ্ধে। মহন্ত সর্দারের জমি আলমগীর দখল করেছিল বলে অভিযোগ। এ নিয়ে সিবিআই-এর কাছে অভিযোগ করেছিলেন মহন্ত সর্দার। সেই অভিযোগের তদন্ত করতেই শনিবার মহন্ত সর্দারের বাড়িতে যান সিবিআই-এর আধিকারিকরা। সিবিআই-এর এই তৎপরতায় জমি দখল সংক্রান্ত আর কোন কোন তথ্য আগামী দিনে উঠে আসে, সেটাই এখন দেখার।
শাহজাহান এবং তাঁর সাগরেদ মিলে সন্দেশখালি জুড়ে ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে, তা এতদিনে রাজ্যবাসী শুনেছে। তবে বিচারপ্রক্রিয়া এখনও চলছে। তাই সেসব পদক্ষেপ মেনেই কড়া হাতে সিবিআই সন্দেশখালির সব মামলার তদন্ত করছে। সম্প্রতি সিবিআইকে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল সন্দেশখালির সমস্ত বাসিন্দাদের অভিযোগ নিতে এক ওয়েবসাইট বা ইমেইল খোলার। জানা যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই সিবিআইয়ের তৈরি সেই ইমেলে জমা পড়েছে প্রায় ৬৫০-রও বেশি অভিযোগ। এবার সেই সমস্ত অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযোগকারীদের বয়ান রেকর্ড করতে ১০ জনের এক টিম গঠন করেছে সিবিআই। সন্দেশখালিতে অভিযোগকারীদের কাছে পৌঁছে তাঁরা রেকর্ড করবে সবটা।
কলকাতা হাইকোর্টে এই সংক্রান্ত মামলার পরবর্তী শুনানি রয়েছে আগামী ২ মে। এখন দেখার নতুন করে উঠে আসা অভিযোগে যাচাই করে, সন্দেশখালির অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন কঠিন পদক্ষেপ নেয় আদালত।
সন্দেশখালির ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের। বিচারপতি জয় সেনগুপ্তের বেঞ্চের নির্দেশ, এব্যাপারে রাজ্যকে সব রকম সাহায্য করতে হবে। সেখানকার মানুষ তাদের অভিযোগ সরাসরি সিবিআইকে জানাতে পারবে। এজন্য সিবিআইকে আলাদা পোর্টাল তৈরি করতে হবে। জমি দখল, ধর্ষণ, চাষের জমিকে ভেড়িতে পরিবর্তন করা সহ সমস্ত অভিযোগের তদন্ত করবে সিবিআই। আদালতের নজরদারিতে হবে তদন্ত। স্পর্শকাতর এলাকায় ১৫ দিনের মধ্যে সিসিটিভি বসাতে হবে। বসাতে হবে এলইডি আলো। সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতেও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এছাড়া আদালত যে কোনও পদমর্যাদার যেকোন ব্যক্তিকে তদন্তের স্বার্থে ডেকে পাঠাতে পারবে সিবিআই। ২ মে পরবর্তী শুনানির দিন তদন্তে অগ্রগতির রিপোর্ট দেবে সিবিআই।
এর আগে গত পাঁচ জানুয়ারি শেখ শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে ইডির আধিকারিকদের ওপরে হামলার ঘটনার তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী সিবিআই তদন্ত শুরু করেছে। পাশাপাশি অভিযুক্ত সাসপেন্ডেড তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সিবিআই আধিকারিকরা তদন্ত করতে সন্দেশখালির আকুঞ্জিপাড়ায় শেখ শাহজাহানের বাড়ি যাওয়ার পাশাপাশি তাঁর স্ত্রীকে ডেকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
এদিন আদেশ দিতে গিয়ে আদালত বলেছে, সন্দেশখালির ঘটনার কথা বিবেচনা করে আদালত মনে করে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। তাই আদালত মনে করে যে এজেন্সিকে দায়িত্ব দেওয়া হোক, সরকারকে তাঁকে যথাযথ সহায়তা করতে হবে। আদালতের তরফে আদেশে বলা হয়েছে, অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি পোর্টাল ও ইমেল আইডি চাবলু করতে হবে। জেলাশাসককে এব্যাপারে তারিখ উল্লেখ করে পর্যাপ্ত প্রচার চালাতে হবে। আদালত বলেছে, সিবিআই জমি দখলের অভিযোগের তদন্ত করে রিপোর্ট দাখিল করবে। সাধারণ মানুষ ছাড়াও সরকারি, বেসরকারি যে কোনও ব্যক্তি কিংবা সংস্থার (এনজিও) কর্তাব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। অন্যদিকে আদালত পুরো বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
ইডির উপর হামলার ঘটনায় সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতার আরও ৩। গ্রেফতার শেখ শাহজাহানের ভাই শেখ আলমগীর ছাড়াও মাফুজার মোল্লা ও সিরাজুল মোল্লা। ইডির উপরে হামলার ঘটনায় এই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায় সিবিআই। সেইমত নিজাম প্যালেসে উপস্থিত হয় শেখ আলমগীর। গত বৃহস্পতিবার তাকে তলব করা হলেও হাজিরা এড়িয়ে যায় আলমগীর।
তারপর ফের শনিবার তাকে তলব করে সিবিআই। আর তার সঙ্গেই তলব করা হয় সন্দেশখালি এক নম্বর ব্লকের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি মাফুজার মোল্লা ও অপর তৃণমূল নেতা সিরাজুল মোল্লা সহ আরও বেশ কয়েকজনকে। টানা ৯ ঘন্টা ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ। আর তারপরই গ্রেফতার শেখ শাহজাহানের ভাই শেখ আলমগীর। ইডির ওপর হামলার ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন শেখ আলমগীর। ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখে ও একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে শেখ আলমগীরকে গ্রেফতার করে সিবিআই।পাশাপাশি গ্রেফতার অপর ২ তৃণমূল নেতা মাফুজার মোল্লা ও সিরাজুল মোল্লা।
আদালতের নির্দেশে সন্দেশখালিতে ইডির উপর হামলার ঘটনার তদন্ত করছে সিবিআই। অন্যতম মূল অভিযুক্ত শাহজাহান এখন সিবিআই হেফাজতে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা বেশ কয়েকবার সন্দেশখালি গিয়েছেন। সন্দেহভাজনদের বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি করে তলবের নোটিস দিয়ে এসেছেন। শাহজাহানের ভাই আলমগীরের বাড়িতেও গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় আধিকারিকেরা।
গত ৫ জানুয়ারি রেশন ‘দুর্নীতি’ মামলার তদন্তের জন্য শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল ইডি। কিন্তু শাহজাহানের অনুগামীদের আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয় ইডি আধিকারিকদের। মারধর করার অভিযোগ ওঠে। তারপর থেকে শাহজাহান নিখোঁজ ছিলেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুলিস গ্রেফতার করে। কলকাতা হাইকোর্ট তাঁকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। গত ১৪ মার্চ শাহজাহানকে আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। তাঁকে আরও আট দিন সিবিআই হেফাজতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এবার সিবিআইয়ের জালে তার ভাই আলমগীরও।