
সৌমেন সুর: বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ঘটনা। সাহিত্যে সবকিছু নতুন করে পাওয়ার আশায় যেন রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ ঘটলো। উনি চিনিয়ে দিলেন গল্পে সংলাপের সন্নিবেশে শব্দের জাদুকাঠি। বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা গদ্য ও বিহারীলাল চক্রবর্তীর বাংলা পদ্য যেন রবীন্দ্রনাথের কলমে পরিণত বয়সে পদার্পণ করলো।
শৈশবে বিশাল বারান্দা বিশিষ্ট বাড়ির অন্তঃপুরে বন্দী জীবন আর চার দেয়ালে বদ্ধ ক্লাসরুমের হাত থেকে মুক্তি পাবার পর, একের পর এক রবীন্দ্র প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে শুরু করলো। কখনো তিনি কবি, কখনো নাট্যকার, কখনো প্রাবন্ধিক, কখনো গল্পকার আবার কখনো তিনি সংগীত স্রষ্টা। তবে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক উপলব্ধির মহোত্তম প্রকাশ তাঁর সঙ্গীতে। ভারতীয় মার্গ সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের মিলন ঘটিয়ে তিনি সংগীতে এক নতুন পথ সৃষ্টি করেন, যা পরবর্তীতে 'ভাঙা গান' নামে পরিচিতি পায়।
জমিদারি কাজে যখন শিলাইদহে কবি অবস্থান করেন, তখন বেশ কিছু বাউলের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় এবং বাউল সম্প্রদায়ের গানের আধ্যাত্মিক চেতনা ও তার সাহিত্য কবির মনকে উত্তাল করে দেয়। লালন ফকিরের একটি গান 'আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে' গানটি কবিকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এরপর কবি লালনের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ছটফট করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে লালনের সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ হয়নি।
অন্যদিকে কবি চিঠি লিখতেন সযত্নে, চিঠিতে থাকতো গভীর অনুভূতি। তাঁর লেখা চিঠি অবশেষে পত্রসাহিত্য হয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। উপন্যাস লেখার বুননের থেকে কবি গল্পে অত্যন্ত বেশি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পরিশীলিত ভাষা, পরিমার্জিত কাহিনীর বুনোট। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ অজেয়। এক নতুন দিক নির্দেশ করে দিয়েছিলেন কবি। আধুনিকতাতেও তিনি পিছিয়ে নেই। চ্যালেঞ্জবশত লিখলেন ' শেষের কবিতা'। যে উপন্যাস মানুষের মনে এক বিশিষ্ট স্থান আদায় করে নেয়। সাহিত্যের দরজায় মহাকবি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম একজন সৃষ্টিশীল প্রতিভাধর মানুষ হয়ে, মানুষের মনে চিরকাল বিরাজ করে থাকতেন।
সৌমেন সুর: আজ বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরুর প্রয়াণ দিবস। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মধ্যে ছিলেন, আছেন, থাকবেনও। কারণ রবীন্দ্রনাথ আজও প্রাসঙ্গিক। কবি স্রষ্টার দৃষ্টি নিয়ে যা তিনি অনেক আগেই দেখে গিয়েছিলেন, আজ এতদিন পরে তা অবিশ্বাস্য ভাবে সত্য হয়ে উঠেছে। কবি বলেছেন, নিজেকে প্রাসঙ্গিক করো অন্য মানুষে, মানুষ থেকে প্রাণীতে, প্রাণী থেকে বৃক্ষলতায়, নদী-পর্বত সমুদ্রে, গ্রহে-নক্ষত্রে, মহাবিশ্বে। মনে রেখো, ক্ষুদ্র অস্তিত্ব মানুষের জন্য নয়। তাই মহৎ হয়ে বাঁচো। আমরা যদি ভয়ের প্রতিক্রিয়ায় দুবেলা মরার আগে ভয়েই মরতে থাকি, তাহলে কবি বলেছেন, 'দুঃখ যদি না পাবে তো/ দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?'
রবীন্দ্রনাথ যদি মহাপর্বত হন, তাহলে তাকে কতটুকু মাপতে পেরেছি? কজনই বা তার চূড়ায় উঠতে পেরেছি? রবীন্দ্রনাথ কখনও পুরোনো হবেন না। কারণ তিনি নিজেকে কখনও পুরনো হতে দেননি। 'শেষের কবিতা' উপন্যাসে নিজেই বলেছেন কবিদের পাঁচ বছরের বেশি বাঁচা উচিত নয়। কেন নয় বুঝিয়ে দিয়েছেন, আবার নিজেকে নিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- কবি কিভাবে বেঁচে থাকতে পারেন সারা জীবন ধরে, এবং জীবনের অনেক পরেও। এমন একদিন আসতে পারে যেদিন কবিতার রবীন্দ্রনাথ, নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসংগীতের রবীন্দ্রনাথকে মানুষ আলাদা আলাদা স্রষ্টা বলে ভাববে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ থাকবেন বহু ভাবে ছড়িয়ে। আমাদের কবি জীবনের প্রতিটা স্তরে কতভাবে কত কিছু চিন্তা করেছেন, যেমন শিক্ষার কত সমস্যার কথা, সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন তার ঋষিকল্প অভিজ্ঞতার প্রজ্ঞায়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা গল্পের অনেক বিবর্তন ঘটেছে। গল্পের রূপান্তর ঘটে গেছে অনেক, তবু আজও বাংলা ভাষায় এমন গল্প লেখা হয়। যা রবীন্দ্রযুগে অতিক্রম করে যেতে পারেনি।
রবীন্দ্রনাথ প্রাচুর্যের কথা ভাবেননি। শিক্ষিত বাঙালি জীবনের রবীন্দ্রনাথ আজ এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছাই হোক, প্রতিদিন তাঁকে আমাদের স্মরণ করতে হয়। আসলে প্রতিদিন তার জন্ম। কোনদিনও তার মৃত্যু নেই। একটা ঠাকুরের বেদী চিরকাল মাটির সঙ্গে থাকবে গাঁথা, সে আমাদের রবীন্দ্রনাথ। সবার প্রিয় রবি ঠাকুর। তাই পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ, দুটো তারিখই সমান। অমর, অনন্ত।
কিছুদিন আগেই বলিউড বর্ষীয়ান নেতা অনুপম খের (Anupam Kher) ইনস্টাগ্রামে তাঁর এক ছবি পোস্ট করেছিলেন, যেখানে তাঁকে দেখা গিয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) সাজে। মাথায় পাকা চুল, একগাল দাঁড়ি ও কালো পোশাক, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফ্রেমে সেই ছবি তাক লাগিয়ে দেয় দর্শকদের। তাঁকে দেখে এই রব উঠেছিল যে, এ যেন অবিকল কবিগুরু। সমাজমাধ্যমে তাঁর এই রূপ দেখে প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই সাজে আপত্তি জানালেন টলিউড অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জি (Swastika Mukherjee)। নাম না করেই সমাজমাধ্যমে লিখলেন, 'রবি ঠাকুরকে একা ছেড়ে দিন।'
রবীন্দ্রনাথের সাজে সেজে ৮ জুলাই ইনস্টাগ্রামে অনুপম খের ছবি দিতেই হইহই পড়ে যায়। তিনি জানান, তিনি তাঁর কেরিয়ারের ৫৩৮ তম ছবিতে তিনি অভিনয় করতে চলেছেন বিশ্বকবির ভূমিকায়। বিস্তারিত তিনি পরে জানাবেন। কিন্তু এরপরেই ১০ জুলাই মধ্যরাতে স্বস্তিকা টুইটারে লেখেন, 'কাউকেই রবি ঠাকুরের চরিত্রে অভিনয় করা উচিত নয়। তাঁকে একা ছেড়ে দিন।'
আর এই পোস্টের পরেই অনেক বাঙালি তাঁর কথাতে সহমত হয়েছেন। নেটিজেনদের মতে, 'একজন বাঙালি হিসাবে কবিগুরুকে আমরা যতটা চিনি, ততটা কেউ চেনেন না। ফলে এনাকে নিয়ে সিনেমা না করাই উচিত।' তবে স্বস্তিকার এই পোস্টে অনুপম খেরের নাম না থাকলেও কাকে উদ্দেশ্য করে এই কথা, তা প্রায় প্রত্যেকেরই জানা।
চোখের সামনে এ যেন কবিগুরুকেই দেখতে পাচ্ছি! মাথায় সাদা চুল, গাল ভর্তি পাকা দাড়ি, গায়ে কালো পোশাক, সাদা-কালো ফ্রেমে উজ্জ্বল কবিগুরু। শুক্রবার থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) সাজে একজনের ছবি দেখা গিয়েছে, যা নিয়ে হইহই পড়ে যায়। সবারই প্রশ্ন, 'কে ইনি?' তবে অবশেষে সমস্ত ব্যাপার খোলসা হল। দেখা গিয়েছে, এই ছবি শেয়ার করেছেন বলিউড অভিনেতা অনুপম খের (Anupam Kher)। আর এই ছবিতে অনুপম খেরই রবীন্দ্রনাথের বেশ-ভূষায় সেজেছেন। জানা গিয়েছে, তিনি তাঁর আসন্ন ছবিতে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রেই অভিনয় করবেন।
শুক্রবার অনুপম খের তাঁর ইনস্টাগ্রামে এই ছবি শেয়ার করেছেন। যেখানে তাঁকে দেখা গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাজে। চরিত্রের প্রয়োজনে তারকাদের বিভিন্ন সাজে সাজতে হয়। কখনও কখনও এমনও হয় যে, তারকাদের এমনই সাজ দেওয়া হয় যে, তাঁদের চেনাই দায় হয়ে পড়ে। তেমনটাই হয়েছে অনুপম খেরের এই ছবির সঙ্গেও। এই ছবির ক্যাপশনে অনুপম ঘোষণা করেন তিনি আগামী ছবিতে ‘গুরুদেব’-এর ভূমিকায় অভিনয় করতে চলেছেন।
প্রসঙ্গত, এখনও পর্যন্ত ৫০০র বেশি ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। কেরিয়ারের ৫৩৮ তম ছবিতে তিনি অভিনয় করতে চলেছেন বিশ্বকবির ভূমিকায়। এই খবরে বিশেষ ভাবে খুশি অনুপমের বাঙালি অনুরাগীরা। তবে তাঁর এই সিনেমার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি ক্যাপশনে জানিয়েছেন, 'আমার ৫৩৮তম প্রজেক্টে গুরুদেবের ভূমিকায় অভিনয় করতে পেরে আমি গর্বিত। সঠিক সময়ে সবটা জানাব।' ফলে তাঁকে রবীন্দ্রনাথে চরিত্রে দেখতে মুখিয়ে রয়েছেন তাঁর অনুরাগীরা।
সৌমেন সুরঃ যে নাস্তি শব্দ থেকে নাস্তিক শব্দের ব্যুত্পত্তি তার তিনটে অর্থ হতে পারে-- যে ঈশ্বর মানে না, যে পরলোক মানে না এবং যে বেদের প্রামান্য মানে না।
রবীন্দ্ররচনাবলিতে নাস্তিকতা শব্দটি এসেছে বহুবার। তিনি হয়ত ঈশ্বরদ্রোহী হিসেবে শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন। দেখা গেছে নাস্তিকদের প্রতি রবীন্দ্রমনন যেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। নাস্তিকরা সমাজপতিদের শেখানো ধারণা অনুযায়ী নিন্দার পাত্র আর অকল্যাণের প্রতীক। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বলে ঘৃণাও করেন অনেকে। এই নাস্তিকদের চরিত্রে কবি এঁকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ কিছু মানবীয় গুণ। উন্নত করেছেন তাঁদের। পৌঁছে দিয়েছেন সামাজিক উচ্চতায়।
রবীন্দ্রনাথের 'চতুরঙ্গ' গল্পে জ্যাঠামশাই জগমোহন চরিত্রটি সেকালের নাস্তিকের আদলে সাজানো। যখন এই চরিত্রটি পূর্ণরূপ পেলো তখন দেখা যায় মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে বিশাল উঁচুতে তাঁর স্থান। গল্পের চলনে দেখি, জগমোহন ঈশ্বরে অবিশ্বাশী, পাশাপাশি তাঁর ভাই হরিমোহনের ঈশ্বরে অবাধ বিশ্বাস। এদিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মুখে যুক্তি বসিয়েছেন, "ঈশ্বর যদি থাকেন তবে আমার বুদ্ধি তারই দেওয়া, সেই বুদ্ধি বলছে ঈশ্বর নেই। অতএব ঈশ্বর বলছেন যে ঈশ্বর নেই।" এই জায়গা থেকে আস্তিক্য ধর্মকে ডুবিয়ে দেওয়াই জগমোহনের ধর্ম হয়ে ওঠে। আর সে নাস্তিক্য ধর্মের প্রধান অঙ্গ হয়ে ওঠে মানুষের ভালো করা। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে খাওয়াবে এটা জগমোহনের মনে একবার স্থান পায়, সেটা ভাই হরিমোহনের কাছে ব্যক্ত করলে হরিমোহন আপত্তি জানায়।
তখন জগমোহন বলে, 'তোমার ঠাকুরের ভোগ তুমি রোজ দিচ্ছ, আমি কিছু বলি না, আমার ঠাকুরের ভোগ আমি একদিন দেবো, এতে বাধা দিও না।' এই কথা শুনে হরিমোহনের ছেলে পুরন্দর হুমকি দিলে জগমোহন হাসি মুখে বলে, 'ওরে বাদর, আমার দেবতা যে কত বড় জাগ্রত তা তাঁর গায়ে হাত দিতে গেলেই বুঝবি, আমাকে কিছুই করতে হবে না।' এখানে দুই মনের দুই মানুষের 'আমার দেবতা' 'তোমার দেবতা' এবং কে কত বড় জাগ্রত, তা জানানোর ছলে আমরা একটা অর্থ খুঁজে পাই, বার্তা দেখতে পাই। (চলবে) তথ্যঋণ--অরুনাভ মিশ্র
সৌমেন সুর: প্রায় সারা পৃথিবী ঘুরেছেন রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore)। পৃথিবীর যেখানেই গেছেন সেখানেই কবিকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভরিয়ে দিয়েছে। অবশ্য ভ্রমণের কারণ ছিল, বিশ্বভারতী (Visva Bharati) গড়ে তোলবার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা, আর একটা কারণ- বিশ্বের নীতি, মতবাদ নিজের অন্তরে গ্রহন কোরে তাকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা। এবং স্বদেশের আদর্শ, দর্শন পৌছে দিতেন বর্হি বিশ্বের কাছে। কবি বিশ্বাস করতেন, 'আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।' এইভাবেই কবি বিশ্বের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন এবং নামজাদা ব্যক্তিত্বের সাথে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব। রম্যাঁ রলাঁ, বানার্ড শ, আইনস্টাইন অন্যদিকে স্বদেশের মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষ, ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর মানিক্য সব বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। কবি অসংখ্য কাজে দেশের মানুষের কাজে ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
কাজের ভিড়ে বাচ্চারা তার কলম থেকে বাদ যাইনি। অসংখ্য কবিতা, ছড়া এবং শিশুপাঠ্য বই 'সহজ পাঠ' লিখেছেন। ১৯৩০ সালে কবি তখন অসুস্থ, ঠিক হলো স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য দার্জিলিং যাবেন। ১৯৩১ সালে হিজলী কান্ডে দার্জিলিং যাওয়া বন্ধ করলেন। হিজলী ডিটেনশন ক্যাম্পে দুজন বন্দি মারা যায়। সেই প্রতিবাদে ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন রবীন্দ্রনাথ। পরাধীন দেশের অত্যাচারিত বঞ্চিত মানুষদের জন্য তার ভাষা গর্জে উঠেছে কবিতায়, প্রবন্ধে ও নানাবিধ রচনায়। রবীন্দ্রনাথ কবি, মহাকবি। রবীন্দ্রমালার মধ্যে আছে নানা রঙের নিখুঁত ফুল। সেগুলি হল নানা রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী রবীন্দ্রনাথ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ, গায়ক রবীন্দ্রনাথ, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি। অন্যদিকে তিনি সংগঠক, শিক্ষক, সমাজসেবী, বক্তা, মানুষের নেতা। রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক হলেও বিশ্বমানবতা জুড়ে আছে তার কর্মে, তার সৃষ্টিতে।
সৌমেন সুর: চারদেয়ালের গণ্ডী কখনো কবিকে আটকে রাখতে পারে! কখনই না। আসলে কবি হওয়ার জন্যই তাঁর জন্ম। তাই ক্লাসরুমের মাপা শাসন তাঁকে স্বস্তি দেয়নি। সে কি বন্দীশালায় দিন কাটাতে পারে! তাঁর মন প্রকৃতির সবুজ সমারোহে ঘুরতে থাকে। প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্রে তাঁর ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে। এহেন অবস্থায় তাঁকে কি বেঁধে রাখা যায়! সে যে সুদূরের পিয়াসী।
রবীন্দ্রনাথ তখন নেহাতই যুবক। ইউরোপ ভ্রমণ থেকে ফিরেছেন দেশে। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন প্রচলিত আইরিশ ও স্কটিশ লোকগানের 'মেঠো' সুর। এই সুর কবির মনপ্রাণ ভরিয়ে দিয়েছে। বয়স তখন কবির, মাত্র ১৯। ইউরোপ থেকে ফিরে এসে, মুক্তঝরা মনের অন্দরে একমুঠো সতেজতা নিয়ে লিখে ফেললেন, দুটি গীতিনাট্য-- 'বাল্মীকি প্রতিভা', 'কালমৃগয়া'। বাল্মীকি প্রতিভায় ও কালমৃগয়ায় রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেন। তাঁকে দেখতে বড় ভালো লাগছিল। রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকি ও অন্ধমুনির চরিত্রে অভিনয় করেন। অত্যন্ত সাবলীল অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করে নেন। দর্শকদের মধ্যে সেদিন বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শিল্পীদের মনে কোনো নতুন কিছু করার বাসনায় একটা অস্থিরতা থাকে। সেই অস্থিরতা রবীন্দ্রনাথের মনে। কারণ নিয়ম শৃংখলার বেড়া দিয়ে তাঁকে বাঁধতে গেলেই, তিনি সেই বেড়া অতিক্রম করে বেরিয়ে গিয়েছেন। অতিক্রম করে এবার রবীন্দ্রনাথ কিছুদিনের জন্য মুসৌরিতে বাবার কাছে চলে গেলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে ভারতী পত্রিকায় লিখলেন উপন্যাস 'বউ ঠাকুরানীর হাট'। তরুণ কবির নাম ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল থেকে দেশের বর্হিমহলে ছড়িয়ে পড়লো কবির নাম। ১৮৮২ সালে প্রাকশিত হয় 'সন্ধ্যাসংগীত'। এটা পড়ে বঙ্কিমচন্দ্র অত্যন্ত অভিভূত হয়ে গেছিলেন। পুরস্কার স্বরূপ বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর গলার মালা খুলে রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দেন। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র একুশ বছর। এ যেন অগ্রজের হাত থেকে রথের রশি নবীন সারথির হাতে। যেন মিলনমেলায় দুই মনিষীর অন্তরঙ্গ প্রকাশ।
সৌমেন সুরঃ এগারো বছর ন' মাস বয়সে ১৮৭৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) উপনয়ন হয়। তাঁর পরিবার ব্রাক্ষ্ম হলেও আদি ব্রাক্ষ্মসমাজে উপনয়নের রীতি আছে। যথাসময়ে রবীন্দ্রনাথের পৈতে হওয়ায় তাঁকে নেড়া হতে হয়। এই অবস্থায় স্কুলে গেলে, বিশেষ করে ফিরিঙ্গি স্কুলে-তারা ক্ষেপাতে ছাড়বে না। স্কুল সে যাবে না-মনে মনে এই পণ করলো। ঠিক এইসময় পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (Debendranath Tagore) রবির অবস্থা বুঝে তাঁকে হিমালয় ভ্রমণে নিয়ে যাবেন ভাবছেন।
এই প্রস্তাবে রবি কি রাজী? রবি এই প্রস্তাব শুনে খুশীতে ফেটে পড়ে। চোখ বুজে রাজী হয়ে যায়। পিতার সঙ্গে এই প্রথম ভ্রমন। চারদেওয়ালকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতির মুক্ত পরিবেশে নিজেকে যুক্ত করতে চলেছে। স্কুল আর বাড়ির চৌহদ্দির মধ্য়ে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন রবি। যাই হোক বীরভূম জেলায় বোলপুর গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েক বিঘে জমি কিনেছিলেন। সেই জমির ওপর একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। বাড়িটার নাম দিয়েছিলেন 'শান্তিনিকেতন'। হিমালয় যাবার আগে এখানে কয়েক দিনের জন্য় অবস্থান হলো। চারদিকে ধূ ধূ প্রান্তরে সবুজ শ্য়ামলীমার নৈসর্গিক দৃশ্য় রবিকে বিমোহিত করে দেয়। দূরে তালবনের সারি। আঁকাবাকা লাল মাটির মেঠো পথ। রবির খুব ভাল লাগতে থাকে জায়গাটা। এক একাই ঘুরতে থাকেন।
মুক্তির আনন্দে সে বিহ্বল। কলকাতার লোকজনের কোলাহল থেকে নিঃসীম শান্তিতে এই শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের ভীষন ভাল লেগে গেল। এতদিন পিতা ছিলেন দূরের মানুষ। এখন বরফে ঢাকা পাহাড় তাঁকে অন্য় জগতে নিয়ে যায়। পিতার সাহচর্যে আজ রবীন্দ্রনাথ যেন প্রকৃতি প্রেমিক। ডালহৌসির দিগন্ত বিস্মৃত মোহময় দৃশ্য়ের মধ্য়ে পিতা তাকে একটি একটি করে নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে ডুবে যায়। পিতার কাছে রোজ সকালে জ্য়োর্তিবিদ্য়া অঙ্ক, ইতিহাস, সংস্কৃত শিখতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে এক নতুন দিগন্তের পথ খুলে যায়। পিতার কাছে অনেক কিছু শিখে জ্য়োতিষ বিদ্য়ার ইংরেজী বই থেকে বাংলা অনুবাদ কোরে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। লেখাটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ছাপা হয়। সম্ভবত এটিই তার প্রথম রচনা। মুক্তির আলোয় রবীন্দ্রনাথ মুক্ত হয়ে বিভিন্ন রচনার জন্য় তৈরী হন। পরবর্তীকালে আমরা সমৃদ্ধ হই তাঁর রচনাবলীতে।
প্রসূন গুপ্তঃ প্রতি বছরই দুই বাংলায় আন্তরিক ভাবে পালিত হয় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। আজকাল আর কেউ ঠিক এ বছরে কত বয়স হলো তার হিসাব রাখে না। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় উৎসব। পাড়ায় কিংবা হল ভাড়া করে। স্কুল-কলেজ ছুটি থাকলেও সকালে কবি প্রণাম সেরে ফেলা হয়। যদিও আজকের পশ্চিমবঙ্গের তরুণ সমাজ কতটা উৎসবে সামিল হয় বা নেহাত রবি ঠাকুরকে নিয়ে সামান্যতম ভাবনা থাকে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ভাবাবে কে?
বাম জমানাতে কমিউনিস্টরা আলাদা করে রবীন্দ্র উৎসব পালন না করলেও তাদের সরকার পালন করেছে। রবীন্দ্র সদন বা রবীন্দ্র ভারতীতে। জ্যোতিবাবুর ভিন্ন উৎসাহ বা আগ্রহ না থাকলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মননে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মহাপুরুষ। সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন সবথেকে উৎসাহী। তিনি মাঝেমধ্যেই চলে যেতেন বোলপুরে।
অবিশ্যি মমতা সরকার আসার পর রবীন্দ্র বন্দনা হয়ে গেল বাধ্যতামূলক। সমস্ত নেতাদের কড়া নির্দেশ দেওয়া হলো রবীন্দ্র উৎসব পালন করতেই হবে। মমতার প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রবল ভাবে নিয়ে আসা হলো রবি ঠাকুরকে। রাস্তার ক্রসিং-এ বাজানো হয় রবীন্দ্র সঙ্গীত। এতে করে যুব মহল কতটা রবীন্দ্রনাথ কে গ্রহণ করলো তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরাই যদিও পাত্তা দেন নি মমতা। কিন্তু যুব মহলের হাতে এখন মুঠো ফোন, তারা কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে নিশ্চিত রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনে কি?
পাশাপাশি ওপার বাংলা। বাংলাদেশ। একটা দেশের জন্ম হলো বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে। তাদের কাছে মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে ব্যান করেছিল পাকিস্তানের সামরিক শাষক আয়ূব খান, তারপরেই জ্বলে উঠেছিল বাঙালি সমাজ। শুরু হয়েছিল আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা। কাজেই ওদেশের মানুষের রক্তে রন্ধ্রে অনুতে পরমাণুতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ। রাষ্ট্রীয় চাপের প্রয়োজন হয় না। কয়েক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে কবি প্রণাম। এই প্রবল গরমকে আমল না দিয়ে প্রকাশ্য পথে গান গাইতে চলেছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, যার কোনও ঠিকানা নেই থাকবেই বা কেন সমস্ত বাংলাদেশটাই তো রবীন্দ্রনাথের।
কবি প্রণাম।।
সৌমেন সুরঃ রবীন্দ্রনাথ এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি দেশ ও জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতীক। তিনি মনুষ্যত্বের চির উন্নত শির। ভারত আত্মার বিগ্রহ। অন্যায়ের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের অহংকার, আমাদের প্রেরণা, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের সমৃদ্ধি।
পঁচিশে বৈশাখ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। এই দিন আমাদের আত্মসমীক্ষার দিন। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, কখনো যদি কবিকে মনে করতে ইচ্ছে হয়, তাহলে চৈত্রের শালবনের নির্জনতায় নি:শব্দে এসে বসতে। তিনি বারণ করেছিলেন আড়ম্বর করতে। আমরা তা শুনিনি। কবি বিষ্ণু দে বলেছেন, 'সভায় কাগজে বাজে ঢাকঢোল/ কারো বা ঝুমঝুমি /এ বড় অদ্ভুদ রাজ্য ছাব্বিশে বৈশাখ মরুভূমি।' কবির জন্মদিনের পরেও জন্মদিন ফুরায় না। রোজই ২৫ শে বৈশাখ। প্রতিদিন কবির সঙ্গে চলাফেরা। প্রতিদিনই তাঁর গানের সঙ্গে আমরা স্মাত হই। বলতে ইচ্ছে হয়, 'আমর জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান।' নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের পথে পথেই যে কবির নিরন্তর পরিক্রমা, তা নয়। সমকালীন বহু ঘটনাই তাঁর মনে ঝড় তুলেছিল। রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন মত্ত বর্বরতার বিরুদ্ধে। রাজনীতিতে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তবু মূঢ়-ম্লান-মূক-নতশির মানুষদের মুখে ভাষা দিয়েছেন। জাতির কন্ঠে দিয়েছেন গনসঙ্গীত। অনুপ্রানিত করেছেন যথার্থ দেশপ্রেমে।
শুধু কবি নন, সাংগঠনিক কাজেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করলেন আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্র। প্রকৃতির পাঠশালাতে দিলেন ছাত্রদের ডাক। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল- যান্ত্রিক নিরানন্দ শিক্ষার হাত থেকে শিক্ষার্থী মুক্তি পাক এই আশায়। শান্তিনিকেতন হলো দেশের সব মানুষের ভাব বিনিময়ের এক মহাতীর্থ। বিশ্বভারতী থেকে অনতিদূরে গড়ে তুললেন 'শ্রীনিকেতন'। আমাদের সংষ্কৃতিকে মাটির কাছাকাছি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্পে রবীন্দ্রনাথ। আমাদের সভ্যতাকে দানবের হাত থেকে রক্ষা করার সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনেপ্রাণে জড়িয়ে আছে অর্নগল। বন্ধু মজলিশে, চায়ের দোকানে, কফি হাউসে, রেডিওতে, টিভিতে, সংবাদপত্রে, রবীন্দ্রনাথ নিত্য আমাদের সম্মুখে উপস্থিত। কবি আমাদের আধুনিক ভারতের নব তীর্থভূমি। এই তীর্থে এসেই জানা যায় ভারতকে।
মণি ভট্টাচার্যঃ এটা রবীন্দ্রনাথের মুলুক..... ভারতবর্ষ (India) কোনো পলিটিক্যাল পার্টির মুলুক নয়। ভারতবর্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) মুলুক। সিএন-ডিজিটালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন গায়ক কবীর সুমন (Kabir Suman)। অমর্ত্য সেন-বিশ্বভারতী বিতর্কে, অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়িয়ে মুক্তমঞ্চের মাধ্যমে শনিবার ও রবিবার প্রতিবাদ স্বরূপ গান গাইবেন বাংলার অন্যতম বিতর্কিত গায়ক চরিত্র কবীর সুমন। শুক্রবার সন্ধ্যাতেই শান্তিনিকেতন যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছেন তিনি। শুক্রবার সিএন-ডিজিটালের তরফে কবীর সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফুরফুরে মুডেই কবীর সুমন জবাব দিলেন, 'হ্যাঁ আমি রবীন্দ্রনাথের গান গাইবো।'
সূত্রের খবর, অমর্ত্য সেনের বাড়ি 'প্রতীচী'র বিতর্কিত ১৩ ডেসিমাল জমি নিয়ে বিশ্বভারতীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। বিশ্বভারতীর উচ্ছেদ-নোটিস নিয়েও জেলা কোর্টের দ্বারস্থ হলে সময়ের হেরফেরে হাইকোর্টে যেতে হয় অমর্ত্য সেনের পক্ষের আইনজীবীদের। বীরভূম জেলা আদালতে মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত অমর্ত্য সেনের জমির বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করতে পারবে না বিশ্বভারতী। বৃহস্পতিবার অমর্ত্যের জমি মামলায় এমনই নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। এরপরে শনিবার ও রবিবার শান্তিনিকেতনে মুক্ত মঞ্চের মাধ্যমে গান গেয়ে প্রতিবাদ জানাবেন গায়ক কবীর সুমন।
এ বিষয়ে সিএন-ডিজিটালের তরফে কবীর সুমনকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি তো বহুদিন পরে রবীন্দ্র সংগীত গাইবেন। এর উত্তরে তিনি বলেন, 'আমি রবীন্দ্রনাথের গান গাই, অনেকেই জানেন না।' আসলে বাংলার সংস্কৃতিতে বহুদিন পর গানে-কবিতায় প্রতিবাদ করতে দেখা যাবে। গানে-কবিতায় এই প্রতিবাদ নিয়ে কবীর সুমন বলেন, 'যারা ভারতের শাসন ক্ষমতায় থাকুন কিংবা ব্রিটেনের শাসন ক্ষমতায় থাকুন, এটা রবীন্দ্রনাথের মুলুক সেটা কেউ কেউ ভুলে যান। আমি ওইখানে থাকব। আমি তো গান গাই। আমি পরপর রবীন্দ্রনাথের গান গাইব।' কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, 'আমার এখন ৭৫ বছর বয়স, আমি এখনও গাইতে পারি। ফলে আমি রবীন্দ্রনাথের গান পরপর গাইব। প্রেমের গান, মরশুমের গান, বর্ষার গান। নানা রকম গান গাইব।'
এ উত্তর শুনে সিএন-ডিজিটালের তরফে কবীর সুমনকে বলা হয় ওটা যে প্রতিবাদের মঞ্চ। ঠিক তারপরেই কবীর সুমন প্রতিক্রিয়া দেন, 'অবশ্যই, আমি মনে করি, অসুন্দর সময়ে সুন্দর থাকাটা একটা প্রতিবাদ, বেসুরো সময়ে সুরে থাকাটা একটা প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ, বেসুরো পরিস্থিতিতে অশুভ শক্তিকে একটা জানান দেওয়া যে এটা রবি ঠাকুরের মুলুক।'
সৌমেন সুর: রবীন্দ্র সাহিত্যে মৃত্যু কোথাও ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশ পায়নি। মৃত্যু, খুন বা আত্মহনন যাই হোক না কেন, কোথাও তার বীভৎস্য বর্ণনা নেই বললেই চলে। 'পণরক্ষা' গল্পে বংশীবদনের মৃত্যু তার ভাই রসিককে ক্ষমাহীন, প্রায়শ্চিত্তের উপায়হীন একটা জগতে নির্বাসিত করে দিয়ে গেছে। বংশীর মৃত্যুর খবর রসিক জানতো না। লেখক তা জানিয়েছেন একটিমাত্র বাক্যে। দীর্ঘকাল বাদে বাড়ি ফিরে দাদাকে বারবার ডাকলেও- 'যে দাদা তাহার পায়ের শব্দটি পাইলে আপনি ছুটিয়ে আসিতো, কোথাও তাহার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। '
'জীবিত ও মৃত' গল্পের শেষ বাক্যটি প্রবাদ বাক্যের মতো হয়ে উঠেছে। কাদম্বিনী জীবনের সব লাঞ্ছনা, অপমানের সমাপ্তি ঘটেছে আত্মহত্যায়- পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে। শারদ-শংকর উপরের ঘর হইতে শুনিতে পাইলেন ঝপাস করিয়া একটা শব্দ হইলো। কাদম্বিনী অনাড়ম্বর মৃত্যু বর্ণনার শেষে লেখকের সংযোজন- 'কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।'
শুধু রবীন্দ্র সাহিত্যে নয়, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি ছোট গল্প-'ছুটি'। তরতাজা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একটা বালকের মৃত্যু কতটা মর্মান্তিক, ফটিকের প্রলাপ মৃত্যুশয্যায় এবং ডাক্তারের চেষ্টা ব্যর্থ করে তার চলে যাওয়ার মধ্যে কোথাও শোকের বাড়াবাড়ি, দুঃখের চড়া রং নেই। শেষ মুহূর্তে শোকাচ্ছন্ন মায়ের ব্যাকুল আহ্বান শেষবারের মতো সাড়া দিয়ে শেষ কথা বলে ফটিক- 'মা এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।'
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে অসংখ্যবার মৃত্যুর দশা এসেছে। কোথাও তার শোক উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়িতে বিহ্বল নয়। বরং শান্ত সৌম্য সংযত। বিশ্বপথিক এক জীবনে তার চলার শেষ করতে পারে না। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বারেবারে নতুন করে তাকে চলার পথ চিনে নিতে হয়। (সমাপ্ত)
সৌমেন সুর: মৃত্যু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আত্মোপলব্ধি আত্মপ্রকাশ করেছে তাঁর সৃষ্টিতে বহুভাবে। তাঁর দীর্ঘ জীবনে অজস্র মৃত্যুর আঘাত তাঁর চিন্তায় চেতনায় ছড়িয়ে দিয়েছে গভীর নিমগ্ন ভাবকনাগুলো। যা তাঁকে দিয়ে বারবার উচ্চারণ করিয়েছে 'মৃত্যুকে লব অমৃত করিয়া তোমার চরণে ছোঁয়ায়ে।' রবীন্দ্র সাহিত্যে মৃত্যু কোথাও ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশ পায়নি। খুব সংক্ষিপ্ত কথায় মৃত্যুর ছবি আমরা পেয়েছি- এত স্বাভাবিক, গুরুত্বহীন বর্ণনা, অথচ তার অনুষঙ্গ কী গভীর এবং বেদনাময়। আবার কোথাও বা ছোট্ট একটা কথায়, একটা উপমায় বুনে দিয়েছেন গভীর আস্তরণ, যা আমাদের আবিষ্ট করে তোলে। রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের কিছু মৃত্যু দৃশ্য তুলে ধরলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
'ঘাটের কথা' ছোট গল্পে কুসুমের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ কী স্নেহকোমল করে তুলেছেন তাঁর বর্ণনায়- 'এতটুকু বেলা হইতে সে এই জলের ধারে কাটাইয়াছে, শ্রান্তির সময় এই জল যদি হাত বাড়াইয়া তাহাকে কোলে করিয়া না লইবে, তবে আর কে লইবে।' 'কঙ্কাল' গল্পে একজন নাসিসিষ্ট মেয়ে কীভাবে কঙ্কালে পরিণত হলো তার বর্ণনা। প্রেমে ব্যর্থতা এবং তার জন্য বিষ খেয়ে আত্মহত্যার কাহিনীতেও মৃত্যুকে রোমান্টিক করে তোলা হয়েছে নায়িকার অন্তিম ভাবনায়- 'ইচ্ছা ছিল যখন লোকে আসিয়া আমাকে দেখিবে তখন এই হাসিটুকু যেন রঙিন নেশার মতো আমার ঠোঁটের কাছে লাগিয়া থাকে।' (চলবে)
আজ থেকে ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বারাণসীতে 'নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের' উদ্বোধন করেছিলেন। মূলত সারা বিশ্বের বাঙালিকে এক করতে চেয়েছিলেন কবিগুরু। রবিবার কলকাতার সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো শতবর্ষ সমাপ্তির সূচনা। চলবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে তিন দিন ধরে।
রবিবারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এ যুগের সেরা বাঙালিদের এক বিরাট অংশ। অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করলেন যাঁরা তারা যথাক্রমে রাজ্যপাল ড. সিভি আনন্দ বোস এবং তাঁর পত্নী, প্রাক্তন স্পিকার মীরা কুমার, সভার অন্যতম আয়োজক সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য, বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ, সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, প্রাক্তন বিচারক ও রাজ্যপাল শ্যামল সেন, চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন প্রমুখ। কিন্তু মূল আকর্ষণ ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর এবং সৌরভ গাঙ্গুলি।
আজ যেন সেজে উঠেছিল বড়দিনে সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্চ থেকে পারঙ্গম। এই অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন সংস্থার চেয়ারম্যান সত্যম রায়চৌধুরী। উদ্বোধন হলো জাতীয় সংগীত দিয়ে এবং তার পরেই শ্লোক গীতি পরিবেশন করলেন অজয় চক্রবর্তী। এরপর উদ্বোধনী ভাষণে নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সত্যম রায়চৌধুরী জানালেন, বাংলার সাহিত্য,সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী কাজেই যা রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন আগামীতেও তা ধরে রাখতে হবে। সত্যমবাবু করোনা আবহের সময় ছাড়া প্রতি বছর বিদেশে বঙ্গ সংস্কৃতির উদ্যোগ নেন।
বক্তব্য রাখতে এসে বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ বলেন, আনন্দ বোস তাঁর একসময়ের সুহৃদ, অত্যন্ত গুণী সংস্কৃতি রুচিবান মানুষ। তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে বৈরিতা নেই। মীরা কুমার বলেন, তিনি বাংলার কোলের সন্তান। তাঁর প্রয়াত পিতা প্রাক্তন জগজীবন রাম বাংলা পড়তে ও বলতে পারতেন অনর্গল। জন্মদিনে জগজীবনবাবু মেয়েকে এক আলমারি বাংলা সাহিত্যের বই উপহার দেন। মীরাজি অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎ সাহিত্য ইত্যাদি পড়েছেন।
একটিও ইংরেজি উচ্চারণ না করে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের শর্মিলা খাঁটি বাংলায় তাঁর সাহিত্য অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। সৌরভকে এর আগে কবে বাংলায় বক্তৃতা করতে কেউ দেখেছেন কিনা শুভাপ্রসন্ন মনে করতে পারলেন না। বাংলার দাদাও ছিলেন সপ্রতিভ।
একদম শেষ বক্তা ছিলেন রাজ্যপাল। তাঁর অনর্গল সাহিত্য নিয়ে ভাষণ এবং বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্ব সাহিত্যের উপর দখল অসাধারণ। নানান উদাহরণ দিয়ে তিনি জানালেন, এটা সোনার বাংলা। আজ বাংলা যা ভাবে কাল বিশ্ব তাই নেয়। পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু চমৎকার জ্ঞানী এক রাজ্যপাল পেয়েছে। বোস বললেন, তাঁর ইচ্ছা ৫ বছরের মধ্যে তিনি যেমন নিয়মিত বই লেখেন, এবারে বাংলায় লিখবেন। একেবারে শেষে তাঁর অনুরোধ, তিনি দিতে এসেছেন, তাঁকে গ্রহণ করা হোক। অনুষ্ঠানের বিষয় যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুশি করবে বলাই বাহুল্য।
সৌমেন সুর: কবির মনে ইচ্ছা জাগে প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদলে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করার। এই ইচ্ছা প্রকাশ করেন জগদীশ চন্দ্র বসুকে চিঠি লিখে। তিনি লেখেন, 'শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীনকালে গুরুগৃহ বাসের মতো থাকবে নিয়ম। বিলাসিতার নাম গন্ধ থাকিবে না। ধনী-দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হইতে হইবে। উপযুক্ত শিক্ষক কিছুতেই খুঁজিয়া পাইতেছি না। এতদিনকার ইংরেজি বিদ্যায় আমাদের কাহাকেও তেমন কর্মযোগী করিতে পারিল না কেন? আমাদের এখানে সেরকম ত্যাগী অথচ কর্মী নেই কেন? ছেলেবেলা হইতে ব্রহ্মচর্য না শিখিলে আমরা প্রকৃত হিন্দু হইতে পারিবো না। অসংযত প্রবৃত্তি ও বিলাসিতায় আমাদিগকে ভ্রষ্ট করিতেছে। দারিদ্রকে সহজে গ্রহণ করিতে পারিতেছি না বলিয়াই সকল প্রকার দৈন্যে আমাদিগকে পরাভূত করিতেছে।'
১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর স্থাপিত হয় শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মাচর্যাশ্রম বিদ্যালয়। শিলাইদহের পাট চুকিয়ে রবীন্দ্রনাথ পরিবার নিয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্র-জায়া মৃণালিনী দেবী হলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রম জননী। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেন তিনি। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় চালাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন ঋণগ্রস্ত। পৈতৃক ব্যবসার অংশীদার হয়ে সেই ব্যবসার ক্ষতির পুরো দায়ভার তাঁর উপর বর্তায়। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী স্বামীকে ঋণমুক্ত করার জন্য তাঁর সমস্ত গয়না কবির হাতে তুলে দেন। এদিকে রবীন্দ্রনাথের অর্থ নেই। ঋণ থেকে বাঁচার জন্য পুরীর বাড়ি বিক্রি করে দিয়েও রেহাই পেলেন না।
একে একে তিনি সব বিক্রি করতে লাগলেন। তবু ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়কে যেমন করে হোক বাঁচাতেই হবে। কবি নিজের লাইব্রেরি সব বই বিক্রি করে দিলেন। এমনকি, বিয়েতে যৌতুক পাওয়া সোনার ঘড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিলেন শরৎকুমারী চৌধুরানীকে ওরফে লাহোরীনিকে। বন্ধুপত্নীকে লাহোরীনি নামটা রবীন্দ্রনাথই দিয়েছিলেন। এভাবে কবি অনেক কিছুই বিক্রি করে দিলেন বটে। কিন্তু স্বপ্নের বিদ্যালয় অবশেষে বহু কষ্ট ও পরিশ্রমের মূল্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল। বিদ্যালয়ে প্রথমে ৫ জন ছাত্র, তারপর তো ইতিহাস।