কীভাবে জামিন পাওয়ার পরও কাউকে গ্রেফতার করা যায়? সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ক তথা সিপিআইএম নেতা নিরাপদ সর্দারের জামিন মঞ্জুর করে রাজ্য পুলিসকে তীব্র ভর্ৎসনা বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চের। গোটা ঘটনায় পুলিস সুপারের রিপোর্ট তলব করল হাইকোর্ট।
শতাধিক নারীর অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিস গ্রেফতার করেছিল সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদকে। ১৭ দিন ধরে জেলে ছিলেন তিনি। মঙ্গলবার নিরাপদ সর্দারের জামিন মঞ্জুর করে বিচারপতির পর্যবেক্ষণ যথেষ্ঠ বোকা বোকা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে নিরাপদকে। এভাবে কোনও নাগরিককে কি গ্রেফতার করা যায়? রাজ্যের আইনজীবী রুদ্রদীপ নন্দীর কাছে জানতে চান বিচারপতি।
নিরাপদের নামে থানায় এফআইআর দায়ের করা হয় ৯ ফেব্রুয়ারি। তবে তাঁর নামে জেনারেল ডায়েরী করা হয় ১০ ফেব্রুয়ারি। এফআইআর-এর পর একই অভিযোগের ভিত্তিতে কীভাবে জেনারেল ডায়েরীহল? পুলিস তা নিল কীভাবে? এই প্রশ্নও তোলেন বিচারপতি। এমনকি, যাঁরা নিরাপদকে অযাচিতভাবে গ্রেফতার করলেন, সেই পুলিস অফিসারদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? কেন গ্রেফতারি নয়? এতগুলো দিন তাঁর জেলে থাকার দরুন ক্ষতিপূরণই বা দেবে কে? বিচারপতির এমন প্রশ্নে যে চূড়ান্ত ভর্ৎসনার মুখে পড়ল রাজ্য এবং রাজ্য পুলিস, তা বলাই বাহুল্য।
প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগেই যখন সন্দেশখালির নারীরা রাস্তায় বেরিয়ে শিবু হাজরার গ্রেফতারির দাবি তুলেছিল, তখন অন্তরালে থেকেই শিবু হাজরা ১১১ জনের নামে এফআইআর দায়ের করেন থানায়। যে ১১১ জনের নামের মধ্যে প্রথম নাম ছিল এই নিরাপদ সর্দার। তখনই, পুলিস এক অভিযুক্তর অভিযোগের ভিত্তিতে অতিসক্রিয়তা দেখিয়ে গ্রেফতার করে নিরাপদকে। বিচারের বাণী শেষমেশ আলো দেখালো। রাজ্য পুলিসের একতরফা অতিসক্রিয়তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও বাড়ছে সন্দেশখালির, মত ওয়াকিবহাল মহলের।
রবিবার সকাল ১০টা নাগাদ বাঁশদ্রোণীর ছেলের বাড়ি থেকে আটক হয়েছিলেন সিপিএম নেতা নিরাপদ সর্দার। মোবাইল টাওয়ারের লোকেশন ধরে প্রাক্তন সিপিএম বিধায়কের সন্ধান পায় বাঁশদ্রোণী থানার পুলিস। তাঁকে প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক আটক করে রাখার পর বসিরহাট জেলা পুলিসের হাতে তুলে দেওয়া হয় নিরাপদ সর্দারকে। বেলা আড়াইটের কিছু পর তাঁকে গ্রেফতার করে বসিরহাট জেলা পুলিস। তিনটের পর সন্দেশখালির উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয় সিপিএম নেতাকে। সেই সময় সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় পুলিসের, ওঠে স্লোগানও। জানা গিয়েছে, সোমবার আদালতে তোলা হবে তাঁকে।
পুলিসের 'অতিসক্রিয়তা'কে কাঠগড়ায় তুলে ছুটির দিনের সকাল থেকেই উত্তেজনা বাঁশদ্রোনী থানা চত্বরে। থানার সামনে জমায়েত হয়ে স্লোগান-শাউটিং চালান সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা। রবিবার থেকেই একনাগাড়ে রাজ্যের প্রতি থানার ঘেরাও করবে সিপিএম, স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দেন দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। জঙ্গলরাজের অভিযোগের সরব তাঁরা। এদিকে কোনওরকম নথি না দেখিয়েই সিপিএম রাজ্য কমিটির সদস্যকে জোর করে থানায় তুলে আনে পুলিস। কার্যত এই অভিযোগে সরব ছিলেন ধৃত সিপিএম নেতার স্ত্রী দীপা সর্দার। আইনজীবী ফিরদৌস শামিম জানান, আইপিসির একাধিক ধারায় গ্রেফতার সিপিএম নেতা। গ্রেফতারি দেখানো হয়েছে দুপুর ২টো বেজে ৫০ মিনিটে। কিন্তু প্রায় ৫ ঘণ্টা তাঁকে আটক করে রাখা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, সন্দেশখালির প্রভাবশালী শাসক নেতা শেখ শাহজাহান ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা শিবু হাজরার এফআইআর-এর সূত্রে গ্রেফতার নিরাপদ সর্দার। সন্দেশখালিতে জনরোষ আছড়ে পড়ার ঘটনায় এবং তৃণমূলে নেতার বাড়ি-পোলট্রি ফার্মে হামলা-কাণ্ডে শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে। আর এই এফআইআর-এর একদম এক নম্বরে নাম ধৃত সিপিএম নেতার নাম। ঘটনাচক্রে এই শিবু হাজরা এই মুহূর্তে অন্তরালে। তবে সন্দেশখালির জনতা শিবুর বিরোধিতায় সোচ্চার। শাসক নেতার অত্যাচারের প্রতিবাদে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে সন্দেশখালি। শিবুর বাড়ি, পোলট্রি ফার্মে হামলাও হয়েছে। উত্তম সর্দার এবং শিবু হাজরার বিরুদ্ধে গুরুতর নারী নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছে। জনতার কাঠগড়ায় থাকা সেই শাসক নেতার অভিযোগের বিরুদ্ধে কীভাবে অতিসক্রিয় পুলিস, প্রশ্ন তুলছেন সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা।
সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার নিরাপদ সর্দার। ঘটনার দিন রাজ্য কমিটির বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন সিপিএম নেতা, দাবি সেলিমের। সাধারণ মানুষের জল-জমি দখল করেছেন শাসক নেতারা, মন্তব্য সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের। দলের নেতার গ্রেফতারির প্রতিবাদে আইনি পথে লড়াইয়ে ডাক দেন সিপিএম সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। পুলিসের আইন মেনে কাজ করা উচিত, মন্তব্য সিপিএম সাংসদের। বিশৃঙ্খলা তৈরি করা, জমায়েত করা, অশান্তি তৈরি করা, লুটপাঠের ধারায় গ্রেফতার নিরাপদ, জানান বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
যিনি অভিযুক্ত, উল্টে তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার সিপিএম-এর প্রাক্তন সাংসদ, কটাক্ষ সিপিএম-র। মূলত সন্দেশখালিতে শাসক-বিরোধী প্রতিবাদ দমনেই পুলিসমন্ত্রীর নির্দেশে এহেন কাজ করা হয়েছে, এভাবেই তৃণমূল সরকার এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষৌভ উগড়ে দেন সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা।
সন্দেশখালিতে আছড়ে পড়েছে জনরোষ, প্রশাসনিক তরফে জারি ১৪৪ ধারা। আর আছড়ে পড়া জনরোষের পিছনে ইন্ধন সিপিএম নেতা তথা সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সর্দারের। তিনি নাকি গ্রামবাসীদের উত্তেজিত হতে ইন্ধন জুগিয়েছেন। তৃণমূল নেতা শিবপ্রসাদ হাজরা ওরফে শিবু হাজরার এহেন অভিযোগের ভিত্তিতে রবিবার সকালে ছেলের বাড়ি থেকে নিরাপদ সর্দারকে গ্রেফতার করে বাঁশদ্রোণী থানার পুলিস।
ঘটনাচক্রে সন্দেশখালির মানুষের কাঠগড়ায় দুই প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা উত্তম সর্দার এবং শিবু হাজরা। বকলমে এঁরা অন্তরালে থাকা অপর এক তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের ঘনিষ্ঠ বলে এলাকায় পরিচিত। জনরোষে শিবুর পোলট্রি ফার্ম আগুনে জ্বলেছে, বাড়িতে চলেছে ভাঙচুর। এবার জনতার কাঠগড়ায় থাকা সেই শিবু হাজরার দায়ের করা এফআইআর-এর ভিত্তিতে কলকাতা পুলিসের হাতে গ্রেফতার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক। আর এতেই তেড়েফুঁড়ে বাঁশদ্রোণী থানার সামনে জমায়েত থেকে স্লোগান-শাউটিং সিপিএম নেতৃত্ব থেকে কর্মী-সমর্থকদের। সুদুত্তর না পেলে চলবে থানার সামনে জমায়েত, স্লোগানিং, বলছে সিপিএম নেতৃত্ব। স্বাভাবিকভাবেই ছুটির সকালে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁশদ্রোণী থাকা এলাকায়।
যদিও বাঁশদ্রোণী থানার দাবি, বসিরহাট জেলা পুলিসকে সহযোগিতা করতে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রাক্তন বিধায়ককে। বসিরহাট জেলা পুলিসের প্রতিনিধি এসে সিদ্ধান্ত নেবেন। সূত্রের খবর, টাওয়ার লোকেশন দেখেই ছেলের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় নিরাপদ সর্দারকে। উল্লেখ্য সন্দেশখালিকাণ্ডে মোট ১১১ জনের নামে এফআইআর দায়ের হয়েছে, আর একদম একনম্বরে নাম প্রাক্তন সিপিএম বিধায়কের।
যদিও প্রাক্তন বিধায়কের দাবি, সন্দেশখালিতে জনতার বিক্ষোভের সময় তিনি এলাকাতেই ছিলেন না। নানা জায়গায় দলীয় কাজে ব্যস্ত ছিলেন নিরাপদবাবু। প্রাক্তন বিধায়কের স্ত্রীর মন্তব্য, পুলিস এসে নিরাপদবাবুকে থানায় নিয়ে যায়। সিএন-র কাছে প্রাক্তন বিধায়ককে ফাঁসানোর অভিযোগে সরব নিরাপদ সর্দারের স্ত্রী।
এদিকে প্রাক্তন বিধায়কের হয়ে সওয়াল করতে বাঁশদ্রোণী থানায় উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী ফিরদৌস শামিম। বাইরে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বিক্ষোভ দেখান সিপিএম নেত্রী মধুজা সেন রায়, শতরূপ ঘোষ থেকে কৌস্তভ চট্টোপাধ্যায়ের মতো নেতৃত্ব। প্রত্যেকেই বাংলাজুড়ে জঙ্গলরাজের অভিযোগে তুলে সন্দেশখালিতে নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে সরব ছিলেন। মধুজা সেন রায়ের মন্তব্য, নিরাপদ সর্দারকে গ্রেফতার করে রাখলে গোটা রাজ্যে পথে নামবে সিপিএম। ক্ষমতা থাকলে পুলিস প্রশাসন আটকে দেখাক, এভাবেই চড়া সুর সিপিএম নেত্রীর। অপর এক সিপিএম নেতা তথা তরুণ মুখ শতরূপ ঘোষেরও সুর চড়া।