প্রসূন গুপ্ত: মঙ্গলবার থেকে খবরের বাজারে চমকদার বিষয় মুকুল রায়। বেশ কিছুদিন ধরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন রাজনীতি থেকে। যদিও তিনি বর্তমানে কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভার বিধায়ক। বিধানসভা নির্বাচনের পরে তিনি হারান স্ত্রীকে। পরবর্তীতে ইনি সপুত্র যোগ দেন তৃণমূল কংগ্রেসে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তাঁকে বরণ করে নেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বিধানসভার পাবলিক একাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করতে চান। কিন্তু বিজেপির তরফে তীব্র আপত্তি এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা তুলে এই প্রস্তাব সায় পায়নি। তবে মুকুলের দলবদলের পরপরই আরও অনেক বিধায়ক বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং এই তালিকায় নামজাদা নাম।
এদিকে, শোনা যায় মাঝেমধ্যে মুকুল রায় নাকি সল্টলেকের বাড়ি ছেড়ে কাঁচরাপাড়ায় নিজের বাড়িতে থাকছেন। তাঁর ছেলের দাবি, বাবা পারকিনসন ও ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত। অবশ্য মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সামনে একাধিকবার সাক্ষৎকারে দিয়েছেন মুকুল রায়। সেই মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। এরপরে সোমবার সকাল থেকে ফের খবরের শিরোনামে মুকুল রায়। তিনি হঠাৎ রবিবার সন্ধ্যা থেকে 'নিখোঁজ' হয়ে যান। পরে সিসিটিভিতে তাঁর ছবি ধরা পরে দিল্লি বিমানবন্দরে। জল্পনা ওঠে তিনি নাকি ফের ফেরত যাচ্ছেন বিজেপিতে। এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুত্র শুভ্রাংশু জানান, তাঁর বাবা অসুস্থ। তিনি পুলিসে অপহরণ ডায়রি করেন। অবশ্য ততক্ষণে মুকুল রায় রাজধানী নয়াদিল্লিতে। এরপর বিভিন্ন মিডিয়া জানাতে শুরু করে, মুকুল রায়ের সঙ্গে নাকি অমিত শাহের কথা হয়েছে।
যদিও মুকুল রায় সিএন-কে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বলেন, 'তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি বিজেপির এমএলএ।' কিন্তু এখানেই রাজনৈতিক টুইস্ট। একেবারে দলের অন্দর থেকে জানা গিয়েছে, নাড্ডা বা শাহ মুকুলকে প্রাথমিকভাবে আমল দেয়নি। মুকুলের কথা হয়েছে নাকি পুরোনো বন্ধু কৈলাস বিজয়বর্গীর সঙ্গে। অন্যদিকে বঙ্গ বিজেপির একটি গোষ্ঠীর নাকি ঘোরতর আপত্তি আছে মুকুলের বিষয়। আবার অন্য গোষ্ঠীর ইচ্ছা তিনি ফিরুন। তবে জল্পনা যাই হোক না কেন, আজকের মুকুল কিন্তু প্রাক্তন মুকুলের ছায়া মাত্র। অতএব ...
তৃণমূলের (TMC) সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। আমি বিজেপিরই (BJP) লোক। কোনওদিন তৃণমূলে যাইনি। আমি অপহৃত নই, স্বেচ্ছায় দিল্লিতে। আমি বিজেপিতে যোগদান কেন করবো, আমি তো বিজেপির সদস্য। সিএন-কে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে অবশেষে এভাবেই নীরবতা ভাঙলেন মুকুল রায় (Mukul Ray)। তিনি জানান, 'কোনও অপহরণের অভিযোগ এক্ষেত্রে সঠিক নয়। বিজেপির হয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মাঠে নামতে চান।' মুকুল জানান, 'শরীর খারাপ ছিল মাঝখানে অসুস্থ ছিলাম। বিজেপি আমাকে কর্মসূচি দিলেই উপস্থিত থাকবো। কোনওদিন তৃণমূলে যাইনি, যাবো না। আমি বিজেপিতে আছি এবং বিজেপির বিধায়ক। আমার সঙ্গে অমিত শাহর কথা হয়েছে।'
তৃণমূলে যোগদান ঘটনাচক্রে হয়েছিল। মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। মানসিক স্থিতি ঠিক ছিল না, তাই তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলাম। এই মন্তব্য এদিন সিএন-কে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে জানান মুকুল রায়। এদিকে, মুকুল রায় নিখোঁজ, এই খবরে মঙ্গলবার সকাল থেকেই সরগরম বঙ্গ রাজনীতি। এদিন সকালে রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে বাবার নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে আনেন শুভ্রাংশু রায়। যদিও দিল্লি বিমান বন্দরে কৃষ্ণনগর উত্তরের বিধায়কের একটি সিসিটিভি ফুটেজ মুকুল-পুত্রের দাবিকে কিছুটা লঘু করে। তারপরেও শুভ্রাংশু রায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে দিল্লি রওয়ানা দেয় বিধান নগর কমিশনারেটের একটি দল। এই বিষয়ে প্রতিবেদন লেখা অবধি মুকুল পুত্র শুভ্রাংশুকে সিএন-র তরফে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে যোগাযোগ করা যায়নি।
প্রসূন গুপ্ত: এখনও আইনগত ভাবে মুকুল রায় বিজেপির বিধায়ক। গত বিধানসভা ভোটে বিজেপির টিকিটে মুকুল কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে জিতেছেন। কিন্তু ভোটের ফল ঘোষণার দিন ইঙ্গিত ছিল মুকুল তৃণমূলে ফিরছেন। অন্তত তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানতেন বিষয়টি। এরপর নাটকীয় ভাবে খোদ তৃণমূল নেত্রীর উপস্থিতিতে ঘাসফুলে যোগ দিলেন মুকুল। তাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। একইসঙ্গে মুকুলপুত্রকেও দলে টানেন অভিষেক।
সেই বিধানসভা ভোটে বিজেপির টিকিটে পরাজিত শুভ্রাংশু এখন তৃণমূলের টিকিটে পুরভোটে জিতে বীজপুর পৌরসভার উপপ্রধান। এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। মুকুলকে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানের পদ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির দাবিতে আপাতত সেই পদ নিয়ে প্রচুর জটিলতা তৈরি হওয়ায়। প্যাক কমিটির চেয়ারম্যান পদে রদবদল হয়েছে। এরই মধ্যে মুকুলের পত্নী বিয়োগ হয়েছে। এরপর থেকে তিনি অনেকটাই উদাসীন হয় পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। কেউ কেউ বলেছে, তিনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু মুকুলকে চেনা বড়ই দুষ্কর। ভাইফোঁটার দিন হাসি মুখে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে পুরোনো দিনের মতো ফোঁটা ও উপহার নিয়ে আসেন তিনি। তিনি পাল্টা কী উপহার দিলেন প্রশ্নের উত্তরে মুকুল জানান যে, এখনও দেওয়া হয়নি তবে দেওয়া হবে। তাহলে সেই উপলক্ষ্য কি পঞ্চায়েত ভোট?
পর্দা আসতে আসতে অনেকটাই সরছে। সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে, মঙ্গলবার নদীয়া সফরে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেদিন রাতে নাকি মুকুল রায়ের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন মমতা বলে এমনটাই গুঞ্জন রাজ্য রাজনীতিতে। প্রশ্ন এটাই মুকুল কি ফের ২০১৩-র মতো পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য বড় দায়িত্ব পাচ্ছেন? সেটা সময় বলবে, তবে এই প্রতিবেদককে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের আগে মুকুল আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, নদিয়ার দায়িত্ব পেলে ভালো হতো কারণ নদিয়া জেলাকে হাতের তালুর মতো মতো নাকি চেনেন তিনি।
সেবার দায়িত্ব পাননি তৃণমূলের একদা সেকেন্ড ইন কমান্ড, কিন্তু এবারে হয়তো ভাবনা শুরু করেছেন মমতা। তাই বোধ করি মুখ্যমন্ত্রীর নদীয়া জেলা সফরে মমতার সঙ্গেই আগের মতোই থাকছেন মুকুল রায়।
প্রসূন গুপ্ত: অনেকদিন বাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ভাইফোঁটা নিতে এলেন এক সময়ের তৃণমূলের চাণক্য মুকুল রায়। যদিও গত বিধানসভা নির্বাচনের আগেই বিজেপিতে সুর বদল করেছিলেন পদ্ম শিবিরের তৎকালীনসহ সভাপতি। শোনা গিয়েছিল, মুকুল তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এই খবর নাকি বিজেপির দিল্লি অফিস জানতো। ভোটের আগে দিল্লি থেকে আদেশ এলো মুকুল রায় এবং দিলীপ ঘোষকে বিধানসভার ভোট দাঁড়াতে হবে।দীর্ঘদিনের আরএসএস করা দিলীপ সটান না করে বলেছিলেন, তিনি যদি রাজ্য সভাপতি হয়ে ভোট যুদ্ধে যান তবে প্রচারে থাকবে কে?
এটাও বাস্তব যে রাজ্য বিজেপি নেতাদের আমল না দিয়ে তৃণমূলকে হারানোর জন্য দিল্লিই প্রচারের দায়িত্ব নিজেদের হাতেই রেখেছিলো। একুশের ফল ঘোষণার পর এই গুঞ্জন রাজ্য রাজনীতির সর্বত্র ঘোরাফেরা করছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সেই মেগা প্রচারাভিযানের ফলস্বরূপ বাংলায় প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছে বিজেপি।
কিন্তু মুকুল নাকি খুবই অসম্মানিত হয়েছিলেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন তাঁকে বাংলা দখলের প্রচার থেকে সরিয়ে একটি কেন্দ্রে আটকে রাখা হচ্ছে। ভোটে লড়েছিলেন এবং কৃষ্ণনগর থেকে জিতেছেন। তারপর মুকুল কোথায় হারিয়ে গেলেন দল থেকে? এরই মধ্যে মুকুলের পত্নী বিয়োগ হয়েছে। কথা নাকি চলছিলই, একদিন নাটকীয় ভাবে মমতার উপস্থিতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ফের তৃণমূলের পতাকা তুলে হাতে তুলে দেন।
এরপর ফের অনেক দিনের বিরতি। মুকুলকে খুব একটা রাজনীতিতে দেখা যেত না। খবর ছিল তিনি নাকি অসুস্থ। মাঝে মধ্যে তাঁকে দেখা গেলেও মিডিয়ার সামনে বেহিসাবি মন্তব্য করতে শুরু করেছিলেন মুকুল রায়। তবে রাজনীতিতে নাটক নাকি, নাটকীয় রাজনীতি? তাই নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে কিন্তু মুকুল ভাইফোঁটার দিন উপস্থিত হলেন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে, ফোটা নিলেন এবং মিডিয়ার সামনে যেভাবে কথা বললেন তাতে কোনও ভাবেই তাঁকে অসুস্থ মনে হল না। এবার সোশ্যাল নেটে ভাইরাল হয় গিয়েছে একটিই খবর যে ফের মুকুল পঞ্চায়েতের কাজে তৃণমূলের হয় পথে নামছেন। মুকুলের কথাতেও তাঁর ইঙ্গিত রয়েছে।
বিরোধীরা নাকি ছন্নছাড়া। তার উপর জেলায় জেলায় নাম চেনা কর্মীদের পাশে মুকুল দাঁড়ালে অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল বলা যেতেই পারে। শাসক দলের অন্দরে এই চর্চা এখন তুঙ্গে।