পার্থ ভৌমিক (সেচমন্ত্রী,পশ্চিমবঙ্গ সরকার)ঃ মহম্মদ হাবিব চলে গেলেন স্বাধীনতা দিবসের বিকেলে। অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন। আলজাইমা এবং নানা রোগে মাঠের সিংহ যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। ১৯৬৬-তে আমার প্রিয় ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে যখন এলেন, তখন আমি নেহাতই শিশু। কিন্তু খেলা মানে ইস্ট-মোহনের খেলা থাকলেই বাড়ির বড়রা রেডিওর সামনে বসে যেতেন। আমি অত না বুঝলেও এটা বুঝেছিলাম আমার ভবিষ্যৎ যাই হোক না কেন, ইস্টবেঙ্গলকে সমর্থন করাটা আমার পারিবারিক কর্তব্য। মাঠে যাওয়া শুরু করি ১৫ বছর থেকে ১৯৭৮ থেকে। কি দল ছিল তখন। খেলা বোঝার সময় থেকে কয়েকজন খেলোয়াড়ের অন্ধ ভক্ত ছিলাম, যার অন্যতম বড় মিঞা মানে হাবিব।
সিএন পোর্টালে হাবিব নিয়ে লিখতে বসলে উপন্যাস হয়ে যাবে তাই বেছে নিলাম ১৯৮০। ভয়ঙ্কর ফুটবল বছর ছিল ওই বছরটা। সেবার ইস্টবেঙ্গল থেকে ৯/১০ জন নিয়মিত খেলোয়াড় দল ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। থাকার মধ্যে স্টপারে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আর তেমন কেউ নেই। ক্লাবের সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত নিশীথ ঘোষ। তাঁর সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় নাকি সব বেরিয়ে গিয়েছিলো। আমাদের মতো কট্টর সমর্থকদের তো মাথায় হাত। নিশীথবাবু বুদ্ধি করে কোচ করে নিয়ে আসলেন প্রদীপদাকে। পিকে ব্যানার্জি। পরে প্রদীপদার কাছে শোনা কিছু গল্প শোনাই।
প্রদীপদা প্রথমেই দলে নিলেন পড়ন্ত বিকেলের সুধীর কর্মকার ও হাবিবকে। এরপর অবশ্য দলে আসলেন চ্যালেঞ্জের মজিদ বাসকার, জামশেদ নাসিরীকে। মোটামুটি একটা দল দাঁড়ালো। সেবার এপ্রিল, মে-তে কলকাতায় ফেডারেশন কাপের খেলা ছিল ইডেনে। মজিদ জামশেদ এবং হাবিবের ট্রাওতে দল দুর্দান্ত খেলে ফাইনালে উঠলো। মাঠেতো নিয়মিত গেছিই । বুক দুরুদুরু। কিন্তু প্রথম থেকেই হাবিব খেলা ধরে নিলেন। বয়স হয়েছে কিন্তু নিজের ফরোয়ার্ডের জায়গা ছেড়ে লিঙ্কম্যানে খেলতে শুরু করলেন। প্রবল গরম অন্যদিকে তখন রামজান মাস চলেছে। হাবিব কিন্তু চিরকাল রোজা করে এসেছেন, এবারেও তাই। এক বিন্দু জল না খেয়ে ৯০ মিনিট খেলা ভাবা যায় না। এরমধ্যে একটা আক্রমণ মোহনবাগানের গোলরক্ষক প্রতাপ ঘোষ কোনও রকমে কর্নার করে বাঁচালেন। কর্নার থেকে কলার মতো বাঁকানো শট এলো জামশেদের মাথায়। জামশেদ ফ্লিক করে দিলেন হাবিবের দিকে। স্পট জাম্প করে ওদের স্টপারকে বোকা বানিয়ে বল গোলে। তারপর সম্মিলিত চিৎকার। আর মনে নেই।
কিন্তু সেই বছর আজকের দিনে অর্থাৎ ১৬ অগাস্ট ইডেনে ফের মোলাকাত ইস্ট-মোহনের। প্রথম থেকেই প্রবল গন্ডগোল মাঠে। মজিদকে কাঁচি করে মাঠে বাবলুদা ফেলতেই ইট বৃষ্টি শুরু। তারপর বিদেশ বসুকে (বর্তমানে আমাদের বিধায়ক) আমাদের রাইট ব্যাক দিলীপ পালিত ট্যাকেল করার পর বিদেশদা মাথা গরম করে লাথি মারলেন দিলীপদাকে। ব্যাস স্টেডিয়ামে উত্তাল গন্ডগোল। মৃত্যু হলো ১৬টি তাজা প্রাণের। শোনা যায় প্রশাসনের মারাত্মক ভুলেই নাকি দু দলের সমর্থকদের একসাথেই বসার ব্যবস্থা করেছিল ক্রীড়া বিভাগ।
তবুও সেদিন খেলা পুরো হয়েছিল ওই হাবিবের জন্যই। তিনিই দর্শকদের শান্ত হতে গ্যালারির কাছে দৌড়ে গিয়েছিলেন। আজ সেই মাঠের সিংহ নেই। স্মৃতিতে ছবি হয়ে গিয়েছেন। হাবিব মিঞা অমর রহে। (অনুলিখন- প্রসূন গুপ্ত)
স্বাধীনতা দিবসের দিন শোকের ছায়া নেমে এল ফুটবল মহলে (Football)। প্রয়াত প্রাক্তন ফুটবলার মহম্মদ হাবিব। কলকাতা ময়দান হারাল 'বড়ে মিঞা'-কে। ষাট ও সত্তরে দশকে কলকাতা ফুটবলের অন্যতম বড় তারকা ফুটবলার ছিলেন তিনি।মঙ্গলবার স্বাধীনতা দিবসে বিকাল সাড়ে ৪টে নাগাদ হায়দরাবাদের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি ফুটবলার। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
দীর্ঘদিন ধরে অ্যালঝাইমারে ভুগছিলেন হাবিব। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৬-এর মধ্যে হাবিব ভারতের হয়ে বহু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মাঠে নামেন। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। ২০১৯ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। হায়দরাবাদে জন্ম হলেও তাঁর পুরো ফুটবল জীবনই কেটেছে কলকাতায়।
১৯৬৬ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। নবাবের শহরে জন্ম বলে কলকাতা ময়দানে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘বড়ে মিঞা’ নামে। তারপরে যোগ দেন মোহনবাগানে। বেশিরভাগ সময় ইস্টবেঙ্গলের হয়েই ফুটবল খেলেন তিনি। মাঠে নেমেছেন মহামেডানের হয়েও। ১৯৮৪ সালে মোহনবাগানের হয়ে খেলার পরেই অবসর নেন হাবিব। ফুটবলার হিসাবে অবসর নেওয়ার পর টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিতে কোচিং করিয়েছিলেন হাবিব।