সৌমেন সুর: আমি চিকিৎসা বিজ্ঞান পর্বে মোট চারজন খ্যাতিমান যশস্বী চিকিৎসককে বেছে আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। এক একটি পর্বে এক একজন চিকিৎসকের প্রসঙ্গ থাকবে। আজ ডাক্তার কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনী। এশিয়ার প্রথম সরকার স্বীকৃত বালিকা বিদ্যালয় বেথুন স্কুল। এই বেথুন স্কুল থেকে কাদম্বিনী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ১৮৭৮ সালে। ১৮৮০ সালে তিনি এফ.এ পাশ করেছিলেন। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখদের আন্দোলনের ফলেও ১৮৭৮ সালে ২৭ এপ্রিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট, নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি লাভের দাবি মেনে নিয়েছিল। এরপরেই ১৮৮২ সালে কাদম্বিনী বসু এবং চন্দ্রমুখী বসু প্রথম মহিলা স্নাতক হয়েছিলেন।
এরপরে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির আগেই দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে কাদম্বিনী বিয়ে করেন। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের মেডিক্যাল কলেজে প্রবেশের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার পর থেকে ডাক্তারি পড়া শুরু করা পর্যন্ত প্রতি পর্যায়ের খবর সরকারি মুখপত্র এডুকেশন গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল। স্নাতক হওয়ার পর কাদম্বিনী গেলেন এম.এ পড়তে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে নিজের শিক্ষক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কাদম্বিনী। সেকালের প্রেক্ষিতে নারীদের ডাক্তারি পড়া কার্যত অসম্ভব ছিল। কিন্তু উনিশ সতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্ত্রী শিক্ষাব্রতী, অবলাবান্ধব পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ এবং কাদম্বিনীর অক্লান্ত প্রয়াসে নারীদের জন্য চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা করার দরজা খুলে যায়।
আর এই দুর্গম পথের প্রথম মশালবাহিকা হলেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ১৮৮৪ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পরীক্ষার সময় কলেজের অধ্যাপক ডাক্তার রাজেন্দ্র চন্দ্র চন্দ্র প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষায় এক নম্বর কম দিয়ে কাদম্বিনীকে ফেল করিয়ে দেন। অবশেষে প্রিন্সিপাল সাহেবের সার্টিফিকেট পেয়ে কাদম্বিনী অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার হয়েছিলেন।
১৮৯০ সালে লেডি ডাফরিন হাসপাতালে চিকিৎসক রূপে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়া কিছু সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৮৯০ সালে রাজমাতার চিকিৎসার জন্য নেপালে যান। সেখানে এই মহৎপ্রাণ মানবীর হাত ধরে আধুনিক জন চিকিৎসার সূত্রপাত ঘটে। ইতিহাসের পাতায় কাদম্বিনী গাঙ্গুলির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সেই সময়ের কথা আজও আমরা ভুলতে পারি না। কাদম্বিনী প্রথম মহিলা চিকিৎসক। (চলবে)
সৌমেন সুর: আমি চিকিৎসা বিজ্ঞান পর্বে মোট চারজন খ্যাতিমান যশস্বী চিকিৎসককে বেছে আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। এক একটি পর্বে এক একজন চিকিৎসকের প্রসঙ্গ থাকবে। আজ ডাক্তার নীলরতন সরকার নিয়ে আলোচনা। নীলরতন সরকার জয়নগর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ক্যামবেল মেডিক্যাল স্কুল থেকে ডাক্তারির প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর সাব অ্যাসিস্টেন্ট সার্জেন্টের চাকরি পাওয়ার পরেও জ্ঞানপিপাসু নীলরতন মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে এফ.এ এবং বি.এ পাশ করেন। কিছুদিন চাতরা হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের চাকরি করার পর, মেডিক্যাল কলেজে ফিরে এসে এখানে এম.এ ও এম.ডি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন।
এই সময় থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে তাঁর সাফল্যের সূত্রপাত। ১৮৯৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলো নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত উপাচার্য ছিলেন। চিকিৎসক হিসেবে নীলরতন সরকারের নাম-যশ-খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এই খ্যাতির কারণে দেশীয় শিল্পোদ্যোগী হিসেবে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা কম আলোচিত। এদেশে তিনি প্রথম বিজ্ঞানসম্মত দূষণমুক্ত ট্যানারি, সার ও সাবান কারখানা স্থাপন করেন। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতি হিসেবে আসীন হওয়ার পর বহু যুবককে শিল্পে নিযুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেন।
একমাত্র নীলরতন সরকারের প্রচেষ্টায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল স্কুল ও যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণা; 'সিরোসিস অফ লিভার ইন চিলড্রেন।' তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন সবচেয়ে বেশি যশস্বী। অন্যদিকে ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অনেক সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এই চিকিৎসক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক বেশ আস্থাভাজন ছিলেন ডাক্তার এনআরএস। মধ্য কলকাতার শিয়ালদহে এনআরএস সরকারি হাসপাতাল তাঁর নামাঙ্কিত এবং নীলরতন সরকারের দান। এই হাসপাতালের সূত্রে এবং নামী চিকিৎসক হিসেবে নীলরতন সরকারের নাম মানুষের কাছে চির অক্ষয় হয়ে থাকবে।
(চলবে)