গরু পাচার মামলায় প্রথম জামিন। ৭ মাস পর দিল্লি হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলেন অনুব্রত মণ্ডলের হিসেব রক্ষক মনীশ কোঠারি। গত ১৩ই মার্চ দিল্লিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন মণীশ। তার পর থেকে তিহার জেলে বন্দি ছিলেন মনীশ।
১৩ মার্চ ইডির তলবে হাজিরা দিতে এসে গ্রেফতার হয়ে যান অনুব্রত মণ্ডলের হিসেবরক্ষক মণীশ কোঠারি। সূত্রের খবর, অনুব্রত মণ্ডল, তার কন্যা সুকন্যা এবং প্রয়াত স্ত্রী ছবি মণ্ডলের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির উৎস থেকে একাধিক ভুয়ো কোম্পানি খোলার কারণ জানাতে পারেননি মণীশ। আমাদের প্রতিনিধি মফিজুল ইসলামের সামনেই তিনি বলেছিলেন, তিনি শুধু ইনকাম ট্যাক্স জমা দিতেন, কোনও অন্যায়ের সঙ্গে তিনি থাকেন না। গ্রেফতার হওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতেও নাটকীয় ভাবে বলেন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়াই তার ভুল হয়েছে।
অথচ অনুব্রত মণ্ডলই জেরায় জানিয়েছেন, তার একাধিক শেল কোম্পানি খোলার বিষয়ে জানেন একমাত্র মণীশই। মণীশই ভুয়ো কোম্পানি তৈরির ক্ষেত্রে অন্যতম মূল পাণ্ডা, এমনই দাবি ইডির। তার পর দীর্ঘ আইনি লড়াই। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার দিল্লি হাইকোর্ট থেকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন মিলল মনীশ কোঠারির। জামিন দিতে গিয়ে আদালতের তরফে জানানো হয়েছে, জামিন তদন্তে সহযোগিতা করতে হবে। পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে। ২৪ ঘন্টা মোবাইল খোলা রাখতে হবে। পাশাপাশি আদালতের শর্ত, তদন্তের প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ডাকলে হাজিরা বাধ্যতামূলক। ঠিকানা পরিবর্তন করা যাবে না। দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
পাশাপাশি, কোনওভাবে তদন্তে অসহযোগিতা করতে পারবেন না। এমনকি তদন্ত বা সাক্ষীদের প্রভাবিত করা যাবে না বলেও জামিনের শর্তে জানানো হয়েছে। এছাড়াও জামিনে থাকাকালীন, এই তদন্তের সাথে যুক্ত কোন ব্যক্তির সাথে দেখা করতে পারবেন না মনীশ। এমনকি এই সময় কোনরকম অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত হতে পারবেন না বলেও স্পষ্ট করে আদালতের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মনীশ কোঠারির জামিনের খবরে স্বাভাবিক ভাবেই উচ্ছসিত অনুব্রত মণ্ডল। মনীশ কোঠারির জামিনে খুশি অনুব্রত মণ্ডল জানালেন তার আইনজীবী সম্পৃক্ত ঘোষাল। ভিডিও কনফারেন্সিং-এ মনীশ কোঠারির জামিনের বিষয়টি অনুব্রত মণ্ডলকে জানিয়েছেন তার আইনজীবী। মনীশ কোঠারির জামিনের ফলে অনুব্রত এবং সুকন্যা মন্ডলের জামিন মামলায় যথেষ্ট সুবিধা হবে বলেই জানান সম্পৃক্তা ঘোষাল। যদিও অনুব্রত ও সুকন্যার জামিন খারিজ হওয়ায় পুজোতে তিহারেই থাকতে হচ্ছে তাঁদের।
রীতিমত ভয় দেখিয়েই কোম্পানির মালিকানা মেয়ের নাম করে ছিলেন, এমনই দাবি কেষ্ট মণ্ডলের (Anubrata Mondal) হিসেব রক্ষক মনীশ কোঠারির (Manish Kothari)। ইডির (ED) জেরায় মনীশ জানিয়েছেন, 'সুকন্যার নামে থাকা একটি খাবারের কোম্পানি আসলে মনীশ কোঠারি এন্ড গ্রুপের। মনীশের সঙ্গে আরও ১৬ জন ছিল এই কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার।
ইডি সূত্রে দাবি, জেরায় মনীশ স্বীকার করেছে ২০১৮ সালে এই কোম্পানিটি জোর করে সুকন্যার নামে হস্তান্তর করতে বাধ্য করেছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। ৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকায় ফুড কোম্পানিটি সুকন্যার নামে হস্তান্তর করেছিলেন মনীশ কোঠারিরা। কোম্পানির নামে থাকা ১৫ কোটি টাকার সম্পত্তি অনুব্রতর নির্দেশে বাধ্য হয়ে দিতে হয়েছে সুকন্যাকে। ইচ্ছে না থাকলেও অনুব্রত মণ্ডলের নির্দেশেই এই কোম্পানি সুকন্যাকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন মনীশরা।
এর আগে সিবিআইয়ের জেরার মুখে অনুব্রতর হিসাব রক্ষক মনীশ কোঠারি জানিয়েছিলেন, 'যখন যা বলতেন অনুব্রত, তখন তাই করতে হতো।' এছাড়া কেন্দ্রীয় সংস্থার জেরার মুখে পড়ে তিনি আরও জানিয়েছিলেন, অনুব্রত মনীশদের পুরোনো কোম্পানির নামে আরও জমি কিনেছিলেন।
এছাড়া তাঁর স্ত্রীর নামেও কেনা হয়েছিল বহু টাকার সম্পত্তি। এই সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র তদন্ত করে উদ্ধার করেছে সিবিআই। যা সিবিআই এর চার্জশিটেও উল্লেখ রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ওই ফুড কোম্পানির নামে কেনা সম্পত্তি তথ্যের এক অংশ সিএন এর হাতে। একইসঙ্গে ইডি সূত্রে খবর, মনীশের মাধ্যমেই আরো এক কোম্পানি নীর ডেভলপার প্রাইভেট লিমিটেড চালু করেন সুকন্যা।
অনুব্রতর(anubrata mondal) পরিচারক বিজয় রজকের লেনদেনের তথ্য ইডির(ed) হাতে, যা দেখে রীতিমতো অবাকই হয়েছেন কেন্দ্ৰীয় সংস্থা। বীরভূমের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের আবিনাশপুর শাখায় অ্যাকাউন্ট রয়েছে বিজয় রজকের, সিএন-র হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী লকডাউনের সময় বিজয়-এর অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে লক্ষ-লক্ষ টাকা। তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬০ লক্ষ টাকা লেনদেন হয়েছে অনুব্রতর পরিচারকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। এই নিয়ে বিজয় রজক অবশ্য জানান, 'আমি এই টাকার বিষয়ে কিছুই জানি না, এমনকি আমি কোনোদিন ওর থেকে টাকা নিইনি।' শুক্রবার বিজয়কে ৬ ঘন্টা জেরা করে ইডি। বিজয়ের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে খবর ইডি সূত্রে। যা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে পারেন রাজ্য রাজনীতির কেষ্ট মন্ডল।
শুক্রবার অসুস্থ থাকলেও শনিবার অপেক্ষাকৃত সুস্থ অনুব্রত। শুক্রবার অনুব্রত আইনজীবীদের জানান,'বুকে সামান্য শ্বাসকষ্ট আছে', সেইমতো শনিবার রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে অনুব্রতর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। প্রাথমিক চিকৎিসার পর চিকিৎসকরা জানান, অনুব্রত অপেক্ষাকৃত সুস্থই আছেন, জেরা প্রসঙ্গে ইডি সূত্রে খবর বেশ কয়েকজন অনুব্রত ঘনিষ্ঠকে তলব করা হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত তাঁরা আসেনি।
ইডি সূত্রে খবর মনীশ কোঠারি ও অনুব্রতকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করতে পারে ইডি। কোঠারি ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে ইডির হাতে। ইডি সূত্রে খবর, তিনি অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে মুখও খুলেছেন। ইডিকে জানিয়েছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কিন্তু, শুধুই কি অনুব্রত মন্ডলের সিএ হিসাবেই কাজ করেছেন মনীশ কোঠারি? না গরু পাচারের অনুব্রত টাকা লেনদেনের পাশাপাশি ভাগ বসিয়ে ছিলেন কালো টাকায়? যা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ইডি।
কারণ, মনীশ কোঠারির সম্পত্তির পরিমান দেখলে চক্ষু চরক গাছ হতে পারে সকলের।। বীরভূম জেলার শুধু বোলপুরের রূপপুর মৌজা, গোপালনগর মৌজা, কংকালীতলা মৌজা, দ্বারকানাথপুর মৌজা, সুরুল মৌজা-সহ বোলপুরের সব মৌজাতেই রয়েছে মনীশ কোঠারির জমি। যার বাজারমূল্য হিসেব করলে হবে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকার অধিক।। সূত্রের খবর অনুযায়ী, আর এই সব জমিই তিনি কিনেছেন ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত।। আর এই সময়কালে অনুব্রত মন্ডলের হিসেব সামলেছেন মনীশ কোঠারি।
যদিও গোটা ঘটনায় এখনও ঘাবড়ানোর চিত্র দেখা যায়নি অনুব্রতর চোখেমুখে, বরং ইডি হেফাজতে থেকেও দলের উপরই ভরসা রাখছেন অনুব্রত। তদন্তকারী অফিসারদের অনুব্রত জানিয়েছেন, আমার পিছনে দল সব সময় আছে। দলের উপর ভরসা আছে,এমনটাই ইডি সূত্রে খবর।