যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুন্ডুর নির্মম মৃত্যুতে তোলপাড় দেশের নাগরিক থেকে মিডিয়া মহল। কি বস্তু এই ৱ্যাগিং? সাদা মাথায় বলা যেতে পারে কারুর উপর মানসিক অত্যাচার বিশেষ করে যুবা মহলে তথা কলেজের হোস্টেলে আসা নব্য ছাত্রছাত্রীদের। নতুনরা ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রাবাসে তাদের বোকা বানানো বা মানসিক চাপ দেওয়াই নাকি এই ৱ্যাগিং। কিন্তু কি ভাবে আসলো এই বস্তুটি, স্বাভাবিক প্রশ্ন।
এটি আদি ইতিহাসের অঙ্গ। আমরা মহাভারতের মতো পৌরাণিক কাহিনীতেও এই ৱ্যাগিং-এর ঘটনা পাই। ঋষি দ্রোণাচার্যের আশ্রমে অবসর হলেই মহা পরাক্রমী ভীম সকলের খাওয়া কখনও খেয়ে নিতেন। আবার কৌরবদের শতপুত্রদের অধিকাংশকে একটু 'হাতের সুখ' করার কাহিনীও জানতে পারি। যাক ওসব আদি ইতিহাস। শোনা যায় ব্রিটিশ আমলে নতুন ছাত্রছাত্রীদের যে কোনও শিক্ষা কেন্দ্রে নানান ভাবে বোকা বানানো বা মানসিক চাপ দেওয়াটা একটা রেওয়াজ ছিল।অবশ্যই কান্ডগুলি করতো সাহেবরা ভারতীয়দের উপরেই। কখনও কখনও মাত্রা ছাড়ানো অত্যাচারও হতো। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে বিভিন্ন কলেজের ছাত্রাবাসে এই কান্ডটি হয়ে থাকতো। সারা ভারতেই এই কারবার অলিখিত ভাবে চালু ছিল বিশেষ করে সরকারি কলেজে।
ইঞ্জিয়ারিং কলেজে তো এটা প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল। এ ছাড়া যাদবপুর বা জেএনইউ তে এটি নাকি দস্তুর ছিলই। তবে এক সময়ের বিই কলেজে এই ৱ্যাগিং কে বলা হতো বোরিং অর্থাৎ নতুনদের বোকা বানাও কয়েকদিন ধরে। শিবপুরের ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার পার্থপ্রতিম ঘোষ জানালেন যে এখানে শারীরিক অত্যাচারের প্রশ্নই নেই। কয়েকদিন তাদের নিয়ে মজা হতো তারপর হতো গ্রান্ড ফিস্ট। অর্থাৎ পুরোনো ছাত্ররা নতুনদের খাওয়াতো। পার্থবাবু জানালেন, এতে নতুন পুরাতনদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠতো, একই সাথে একটা লজ্জা ভাব কেটে চনমনে থাকতো নব্যরা। পার্থবাবুর কথায় জটিলতা নেই কিন্তু এটাই সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছে বহুবার এবং তার থেকেই স্বপ্নদীপের মৃত্যু।
শুভশ্রী মুহুরী: প্রাচীন ভারতে বেদব্যাস রচিত মহাকাব্য 'মহাভারত' (Mahabharat)। যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন, এর অন্তর্নিহিত অর্থ। মহাভারতের প্রত্যেকটি চরিত্র জীবন বোধ। ধর্ম-অধর্ম, সত্য-অসত্যের আখ্যান। তাই একবার মহাভারত পড়লে এই প্রত্যেকটি চরিত্রের অতলে যেতে ইচ্ছে করে।বিনোদনের পর্দাতেও এই মহাকাব্য নিয়ে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। এমনকি খোদ পরিচালক সত্যজিৎ রায় মহাকাব্যের পাশা খেলার অংশটুকু নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁর সেই আকাঙ্খা অপূর্ণ থেকে গিয়েছে। কিন্তু যদি সেসময় এই সিনেমা তৈরী হত, তাহলে কারা অভিনয় করতেন এই বর্ণময় চরিত্রগুলিতে?
বলিউডের ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট অনিকেত মিত্র। বলিউডের বেশ কিছু জনপ্রিয় সিনেমার স্টোরিবোর্ড আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সামাজিক মাধ্যমেও তাঁর কাজের জনপ্রিয়তা অনেক। অনিকেত নিজের কল্পনা দিয়ে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ এআই-এর সাহায্য নিয়ে অঙ্কিত করেছেন মহাভারতের চরিত্রে কিংবদন্তি অভিনেতাদের। দেখা যাক অনিকেতের চোখে মহাভারতের চরিত্র নির্বাচন।
মহানায়ক উত্তম কুমারকে অনিকেত বেছে নিয়েছেন অর্জুনের চরিত্রে। ভীষ্মের চরিত্রে তাঁর পছন্দ ছবি বিশ্বাসকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে তিনি দিতে চেয়েছেন দুর্যোধনের চরিত্র। শ্রী কৃষ্ণর চরিত্রে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে কল্পনা করেছেন। অভিনেতা সমিত ভঞ্জকে অনিকেতের পছন্দ কর্ণ হিসেবে। অভিমন্যুর চরিত্রে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। অভিনেতা উৎপল দত্তকে ধৃতরাষ্ট্রর চরিত্রে এঁকেছেন অনিকেত। মামা শকুনির চরিত্রে অনিকেতের নির্বাচন সন্তোষ দত্তকে। যুধিষ্ঠিরের চরিত্রে অনিকেত কল্পনা করেছেন বিকাশ রায়কে।
এখানেই শেষ নয়। জনপ্রিয় অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনিকেত একলব্য হিসেবে চিত্রায়ন করেছেন। গায়ক এবং অভিনেতা কিশোর কুমার উঠেছেন অশ্বত্থামা। মহাভারতের নারী চরিত্রগুলি অনিকেতের কল্পনায় অন্য মাত্রা পেয়েছে। দ্রৌপদীর চরিত্রে মাধবী মুখোপাধ্যায়কে করেছেন শিল্পী। শর্মিলা ঠাকুর তাঁর কলমের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছেন গঙ্গা। চিত্রাঙ্গদার চরিত্রে অনিকেত ভেবেছেন সুচিত্রা সেনকে। সত্যবতীর চরিত্র পেয়েছেন সুপ্রিয়া দেবী। সব শেষে ছায়া দেবীকে শিল্পীর পছন্দ কুন্তীর চরিত্রে।
অনিকেত এই সিরিজের নাম দিয়েছেন, 'ডাইস অব ডেস্টিনি'। ছবিগুলি আপাতত ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে হঠাৎ কেন মহাভারতের চরিত্র নিয়ে এত কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠলেন অনিকেত? এই ছবিগুলি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, 'সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম উনি ভীষণভাবে চাইতেন মহাভারতের কেবলমাত্র পাশা খেলার অংশটি নিয়ে একটি সিনেমা করতে। ওনার সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। কিছুদিন হলো আবার নতুন করে মহাভারত পড়া শুরু করেছি। কল্পনায় বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের চরিত্ররা একে একে এসে আমার মনের প্রেক্ষাগৃহে মহাকাব্যের চরিত্ররূপে দেখা দিতে শুরু করে আবার। মহাভারতের সম্পূর্ণরূপে চরিত্রায়ন করা এক কথায় অসম্ভব কঠিন একটি কাজ। তবুও সেখান থেকেই আমার প্রিয় কিছু চরিত্রকে সাজিয়ে নিলাম নিজের মতো করে।'
ফের বিনোদন জগতে শোকের ছায়া। প্রয়াত হলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা গুফি পেন্টাল (Gufi Paintal)। তাঁকে মূলত 'শকুনি মামা' (Shakuni Mama) হিসাবেই সবাই চেনেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। বেশ কয়েকদিন থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। এরপর ৩১ মে তাঁকে মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু শেষরক্ষা আর হল না। সেখানেই আজ, ৫ জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'মহাভারত'-এ (Mahabharat) শকুনি মামা-র চরিত্রে অভিয় করেছিলেন তিনি। আর সেই চরিত্রের জন্যই তিনি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
গুফি পেন্টালের পুত্র হ্যারি পেন্টাল তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, ৫ জুন সকাল ৯ টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন, 'অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমার বাবা শ্রী গুফি পেন্টাল আর এই দুনিয়ায় নেই। পরিবারের মাঝে শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যু হয়েছে তাঁর।'
বর্ষীয়ান অভিনেতা গুফি পেন্টাল ছোট পর্দায় কাজ করা ছাড়াও একাধিক সিনেমাতেও কাজ করেছেন। ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনী অভিনীত 'দিল্লগি'-ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে নজর কেড়েছিলেন। 'রাফু চক্কর', 'ময়দান-ই-জং', 'দেশ পরদেশ', 'সুহাগ' এবং 'সম্রাট অ্যান্ড কোং'-র মতো ছবিতেও অভিনয় করেছেন গুফি। তবে ছোটপর্দায় অনেক বেশি উজ্জ্বল অভিনেতা। বিআর চোপড়ার জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'মহাভারত'-এর 'শকুনি মামা'-র চরিত্র দাগ কেটেছিল প্রত্যেকের মনে। তাঁকে শেষবারের মতো টিভি ধারাবাহিক 'জয় কানহাইয়া লাল কি'-তে দেখা গিয়েছিল।
সৌমেন সুর: সমগ্র ভারতবাসীর কাছে আজও মহাভারত চিরায়ত সাহিত্য হিসেবে গণ্য। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আধুনিকতম রচনা এই মহাভারত। কী নেই এই সাহিত্যে! জীবনের নীতিবোধ থেকে শুরু করে হিংসা, ঈর্ষা, লোভ, কাম, ক্রোধ প্রভৃতির শিল্প সম্মত ব্যবহার এবং অজস্র চরিত্র নিজের গুনে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। রয়েছে অজস্র নারীর আখ্যান। যারা নানা বৈশিষ্ট্যে মানব মনে এখনও অমলিন।
শকুন্তলার কথা ধরা যাক। শকুন্তলার জন্ম মেনকার গর্ভে। ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র একবার কঠিন কঠোর তপস্যা করাতে স্বর্গে ইন্দ্রের আশঙ্কা হয়, যদি বিশ্বামিত্রের কারণে তাঁর সিংহাসনচ্যুত হয়। তখন ইন্দ্র স্বর্গের মহা অপ্সরা মেনকাকে নিয়োগ করেন বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গের জন্য। মেনকা যথারীতি বিশ্বামিত্রের কাছে এসে এমন নৃত্য প্রদর্শন করেন যে তাঁর তপস্যা ভঙ্গ হয়। চোখের সামনে এমন অপরূপা নারীকে দেখে বিশ্বামিত্র মেনকার সঙ্গে আলিঙ্গনবদ্ধ হন এবং মেনকার গর্ভে শকুন্তলার জন্ম হয়।
এই শকুন্তলা ধীর, স্থির, নম্র স্বভাবের তপোবন দুহিতা। দুই প্রিয় সখী অনসূয়া, প্রিয়ংবদার সঙ্গে হাসিঠাট্টা, গান, খেলায় দিন কাটান। বনের পশু পাখিরা তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। এক স্নেহশীলা কল্যাণী স্বরূপা রমণী। অথচ এই নারী পরিস্থিতির চাপে পড়ে কতখানি তেজস্বিনী হতে পারেন এবং নিজের অধিকার রক্ষার জন্য অপরের কাছে কতখানি অপ্রিয়ভাষিনী হতে পারেন, তারই বর্ণনা রয়েছে মহাভারতে। মহাকাব্যজুড়ে এমন বহু নারীর সন্ধান আমরা পাই। যেমন কুন্তী, দ্রৌপদী, গান্ধারী, সুভদ্রা প্রমুখ। সবার প্রতিবাদ যে সোচ্চার এমনটা নয়। নীরবে সত্যের আশ্রয়কে বুকে করে অধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন।
(বাকিটুকু আগামী পর্বে)