
সৌমেন সুর: বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ঘটনা। সাহিত্যে সবকিছু নতুন করে পাওয়ার আশায় যেন রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ ঘটলো। উনি চিনিয়ে দিলেন গল্পে সংলাপের সন্নিবেশে শব্দের জাদুকাঠি। বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা গদ্য ও বিহারীলাল চক্রবর্তীর বাংলা পদ্য যেন রবীন্দ্রনাথের কলমে পরিণত বয়সে পদার্পণ করলো।
শৈশবে বিশাল বারান্দা বিশিষ্ট বাড়ির অন্তঃপুরে বন্দী জীবন আর চার দেয়ালে বদ্ধ ক্লাসরুমের হাত থেকে মুক্তি পাবার পর, একের পর এক রবীন্দ্র প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে শুরু করলো। কখনো তিনি কবি, কখনো নাট্যকার, কখনো প্রাবন্ধিক, কখনো গল্পকার আবার কখনো তিনি সংগীত স্রষ্টা। তবে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক উপলব্ধির মহোত্তম প্রকাশ তাঁর সঙ্গীতে। ভারতীয় মার্গ সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের মিলন ঘটিয়ে তিনি সংগীতে এক নতুন পথ সৃষ্টি করেন, যা পরবর্তীতে 'ভাঙা গান' নামে পরিচিতি পায়।
জমিদারি কাজে যখন শিলাইদহে কবি অবস্থান করেন, তখন বেশ কিছু বাউলের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় এবং বাউল সম্প্রদায়ের গানের আধ্যাত্মিক চেতনা ও তার সাহিত্য কবির মনকে উত্তাল করে দেয়। লালন ফকিরের একটি গান 'আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে' গানটি কবিকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এরপর কবি লালনের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ছটফট করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে লালনের সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ হয়নি।
অন্যদিকে কবি চিঠি লিখতেন সযত্নে, চিঠিতে থাকতো গভীর অনুভূতি। তাঁর লেখা চিঠি অবশেষে পত্রসাহিত্য হয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। উপন্যাস লেখার বুননের থেকে কবি গল্পে অত্যন্ত বেশি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পরিশীলিত ভাষা, পরিমার্জিত কাহিনীর বুনোট। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ অজেয়। এক নতুন দিক নির্দেশ করে দিয়েছিলেন কবি। আধুনিকতাতেও তিনি পিছিয়ে নেই। চ্যালেঞ্জবশত লিখলেন ' শেষের কবিতা'। যে উপন্যাস মানুষের মনে এক বিশিষ্ট স্থান আদায় করে নেয়। সাহিত্যের দরজায় মহাকবি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম একজন সৃষ্টিশীল প্রতিভাধর মানুষ হয়ে, মানুষের মনে চিরকাল বিরাজ করে থাকতেন।
সৌমেন সুর: এই বিষয়টি নব প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই। তারাই দেশের আগামী শেকড়। তাদেরকে সুন্দরভাবে বাঁচতে হবে। বাঁচতে গেলে রসদ চাই। সেই রসদের একটা অংশ- সাহিত্য। সাহিত্যকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। এই প্রজন্ম, মন্মথ রায় কে জানে না। রমাপদ চৌধুরীকে চেনে না, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের নাম শোনেনি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনে না- শুনে আমি ভীষণ স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এরপর ভাবলাম, আমার কর্তব্যটুকু অন্তত করি। সাহিত্যের উপযোগিতাটা তুলে ধরি। প্রথমে বলি, ' Feeling is not a particular content, but the whole universe Subspecie intuition। ' সাহিত্য সমাজের দর্পণ, তবে হুবহু অনুকরণ নয়, এর সাথে আছে কবি- সাহিত্যিকের আপন মনের মাধুরী, তখনই সৃষ্টি হয় ধ্রুপদী সাহিত্য। সাহিত্যের অর্থ হলো পারস্পরিক যোগ। একেরসঙ্গে বহুর মিলন ঘটিয়ে সাহিত্য আত্মীয়তার সূত্র তৈরি করে। তবে বর্তমানে ব্যস্ত জীবনে সাহিত্য পাঠের অবকাশ কমলেও এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। মানুষ আর প্রকৃতি নিয়েই সাহিত্যের জীবন। সাহিত্য না পড়লে জ্ঞান সঞ্চয় হয় না। একজন জ্ঞানী মানুষ আর একজন অজ্ঞান মানুষ আকাশ পাতাল তফাৎ।
সাহিত্য সমাজের মাটিতে ফোঁটা ফুল। তবে হুবহু দর্পণ নয়, তার সঙ্গে মিশে আছে আপন মনের মাধুরী। সাহিত্য সমাজের একটি বিচিত্র সুন্দর সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালা থেকে আহরণ করে নিতে হবে অজানা তত্ত্ব। আসলে পড়তে হবে। পড়লে দোষ কোথায়! পড়লে বরং জ্ঞান বাড়ে। না পড়লে অজ্ঞানী হয়ে থাকতে হয়। কোনটা শ্রেয়, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। কে নাট্যকার, কে কবি, কে সাহিত্যিক, কে লেখক- তারা কি লিখেছেন, তারা কেন নক্ষত্র, এগুলো বুঝতে হবে। জানতে হবে।
সবশেষে বলি, সাহিত্য হল আমাদের আনন্দের আশ্রয়, অবকাশের সঙ্গী, দুঃখের সান্ত্বনা এবং ন্যায় বিচারের হাতিয়ার। সাহিত্য আমাদের হৃদয়কে প্রস্ফুটিত করে। নব প্রজন্মকে অনুরোধ- সাহিত্যকে মনে প্রাণে ভালোবেসে- অফুরন্ত জ্ঞান আহরণ কোরে, নিজেকে প্রকাশ করুন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে।
সৌমেন সুর: বাংলা কবিতার দেশ। আধুনিক কালে বাংলার শ্যামল স্নিগ্ধ নরম মাটিতে জন্ম নিলেন সর্বকালের সর্বদেশের আর এক উজ্জ্বল বিস্ময়। তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ, আকাশের মতোই তিনি বিরাট, নদীর মতোই তিনি গভীর, অনন্ত। নিঃসন্দেহে তিনি বরেণ্য কবি। এরপর বাংলা কবিতার প্রবাহে এক নতুন ঢেউ উঠলো। সবাই শুনলেন নতুন এক কন্ঠস্বর। বিস্ময়ের আর সীমা রইল না। হাজার বছর ধরে পথহাটা ক্লান্ত প্রাণ এক কবি। চোখে তার শতাব্দীর নীল অন্ধকার। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই সেই কবি ব্য়ক্তিত্ব হয়ে উঠলো সকলের একান্ত প্রিয়। সেই কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্র উত্তর যুগের এক ব্য়তিক্রমী কবি।
জীবনানন্দের কবিতার বিষয়-বিষন্ন প্রকৃতি, ইতিহাসের ধূসর পটভূমি, আত্মমগ্ন সৌন্দর্য চেতনা, রোমান্টিক মনন, মানব মনের জটিল রহস্যময়তার স্বরূপ উপলব্ধি। তাঁর কাব্য়ে শুনতে পাই চিরন্তন বাংলার প্রাণের স্পন্দন। এমন নিবিড় মমতা দিয়ে আর কোনও কবি বাংলার প্রাণ প্রতিমা রচনা করেননি। বাংলার কত খাল-বিল, মাঠ-প্রান্তর, ঘাস-লতাপাতা, পাখি তাঁর কবিতায় অমূল্য় সম্পদ হয়ে উঠেছে।
এই বাংলার সঙ্গেই কবির জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। এখানেই তাঁর আশা আকাঙ্খা, ব্য়র্থতা-সফলতা। এর আকর্ষণ দুর্নিবার। জন্ম-জন্মান্তরেও এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। বারবার তিনি ফিরে আসতে চান, "ধানসিড়িটির তীরে-এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়/হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব, এ কাঁঠাল ছায়ায়।" (চলবে)
সৌমেন সুর: উপন্যাস এমন একটি শিল্পকর্ম যেখানে কাহিনীর সূত্র ধরে অজস্র চরিত্রের আনাগোনা ও স্রষ্টার জীবনদর্শন মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। 'তৃণখন্ড' থেকে শুরু করে 'হরিশচন্দ্র' পর্যন্ত সাহিত্য পরিক্রমায় বনফুল প্রায় ৬০টির মতো উপন্যাস লিখেছেন। এছাড়া লিখেছেন অজস্র ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটক। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস বিষয় বৈচিত্র্য অনন্য, তাঁর লেখার মধ্যে ছিল বিজ্ঞানীর বিশ্লেষনী দৃষ্টি। বনফুলের কষ্টিপাথর উপন্যাসটি পত্রের আকারে রচিত।
প্রায় ৫৩টি চিঠির মধ্যে দিয়ে এর কাহিনী উদ্ধৃত। এই উপন্যাসের মূল বিষয় নারী স্বাধীনতা ও সমাজে নারীর অবস্থান। অমিত ও হাসির দাম্পত্য সম্পর্ক ধরে বিষয়টি তিনি উপস্থাপন করেছেন। 'ডানা' উপন্যাসে প্রায় ১৫০ পাখির নাম আছে। এছাড়াও আছে তাদের নানা রঙের, নানা আকারের ডিমের কথা। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নতুন কিছু বলতে চেয়েছেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল কর অবজেকটিভ সাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর বিশেষত্বের কথা বলেছিলেন।
বনফুলের ছোটগল্পেও বৈচিত্র্যের সমাবেশ। এ বৈচিত্র্য বিষয়ে, আঙ্গিকে। জীবনে তিনি বহু ধরনের মানুষ দেখেছেন। জাতপাত ধর্মের বিচার না করে বহু মানুষের সঙ্গে তিনি মিশেছেন, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনার শরিক হয়েছেন। নানারকম মানুষের কথাই তাঁর ছোটগল্পের বিষয়। 'নিমগাছ' তাঁর অনবদ্য একটি গল্প। নিমগাছের উপর কত অত্যাচার হয়ে চলেছে। কিন্তু নিমগাছ তার প্রতিবাদ করে না। সবই নীরবে সহ্য করে। প্রথম থেকেই একটা টানটান আকর্ষন। শেষে দেখা যায়, এ তো নিমগাছের কথা নয়। গোটা নিমগাছটাই আমাদের পরিচিত পরিবারের সর্বংসহ গৃহবধূর প্রতীক হয়ে গিয়েছে। পরিবারের কাঠামো ভাঙছে, পুরোনো দিনের উদার উদার হৃদয় মানুষগুলোকেও আর দেখা যাচ্ছে না।
বনফুল তাঁর অজস্র সৃষ্টি সম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। জীবনে তিনি অনেক সরকারি বেসরকারি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু পাঠকের ভালবাসাকেই তিনি বড় পাওনা বলে মনে করেছেন। এর কাছে তাঁর 'পদ্মভূষন'-ও ম্লান হয়ে যায়। তিনি সাহিত্য সম্পর্কে যা রেখে গিয়েছেন, তা বাঙালি পাঠক কোনওদিন ভোলেনি, ভুলবেও না।
সৌমেন সুর: জীবনের আয়না হলো সাহিত্য। জীবন চলমান, সাহিত্য়ও চলমান। সমাজ বদলায়, সেই বদলের রং লাগে মানুষের গায়ে। তার শিল্প-সাহিত্য়, তার মননে ভাবনায়, জীবনচর্চায়। আধুনিক জীবনে আধুনিক সাহিত্য় হিসেবে আসে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, প্রহসন, কবিতা। গল্প-উপন্যাস এক জায়গায় থেমে থাকলো না। শুরু হলো পরিবর্তন আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মধু-নবীন বঙ্কিম নতুন আঙ্গিকে নতুন কথা বললেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ একাই সব শাখাতে জোয়ার আনলেন। এর মধ্য়ে তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষন দাবিদার হলেও সেখানে ভাগ বসালেন বনফুল অর্থাত্ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বনফুলের সৃষ্ট সম্ভারে সমৃদ্ধ হলো বাংলা সাহিত্য়ের ভান্ডার। বিশেষ করে গল্প উপন্যাসে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনীয়।
১৯২৭ সালে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পাটনা থেকে ডাক্তার হয়ে বেরোলেন। কলকাতায় এসে ডা চারুব্রত রায়ের কাছে প্যাথোলজিতে বিশেষ ট্রেনিং নিলেন। ডাক্তারি পরীক্ষা দিয়ে তিনি বিয়ে করেন। প্যাথোলজি ট্রেনিং শেষ করে আজিমগঞ্জে মিউনিসিপ্যালিটির হাসপাতালে কাজ নিলেন। বেশি দিন সেখানে থাকলেন না। আজিমগঞ্জের কাজ ছেড়ে দিলেন। এরপর ভাগলপুরে ল্যাবরেটরি তৈরি করলেন এবং সেখানেই প্র্যাকটিস শুরু করলেন। ভাগলপুরেই তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেন। ১৯৬৮ সালে তিনি পাকাপাকিভাবেই ভাগলপুর কলকাতায় চলে এলেন। ততদিন বাংলা সাহিত্যে তিনি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
সৌমেন সুর: সাহিত্য সমাজের(Special story) দর্পন, তার হুবহু অনুকরণ নয়। তবে এর সঙ্গে আছে কবি সাহিত্যিকদের আপন মনের মাধুরী। তখনই সৃষ্টি হয় ধ্রুপদী সাহিত্য, সাহিত্যের অর্থ পারস্পরিক সম্পর্কের যোগ। একের সঙ্গে বহুর মিলন ঘটিয়ে সাহিত্য আত্মীয়তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বর্তমান ব্যস্ত জীবনে সাহিত্যপাঠের(Literature) অবকাশ কমলেও সাহিত্যপাঠের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না।
সাহিত্য সমাজচিত্রের একটি বিচিত্র সংগ্রহশালা। সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক খুব নিবিড়। তাই সাহিত্য সমাজের মাটিতে ফুটন্ত ফুল। তবে হুবহু দর্পন নয়, তার সঙ্গে মিশে আছে সাহিত্যিকের মনস্তাস্ত্বিক বিশ্লেষণ। সাহিত্যিক সমাজ(Special Effect) থেকে উপকরন সংগ্রহ করে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে, গ্রহণ-বর্জন করে দেশ-কাল-পাত্রের বাইরে সময়ের বহমান ধারায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট, সমাজের উপদানে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা।
সমাজ তাকে উপাদান জোগায়। সমাজের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যেরও ঋতুবদল হয়। কিন্তু সূর্য থেকে নি:সৃত আলোয় চাঁদ শুধু আলোকিতই হয় না। সে আলোর বিকিরণও তার এক গৌরবী কৃতি। সমাজ থেকে উদ্ভূত সাহিত্যের তাই আজ আগামীকালের জন্য ঘুম থেকে জাগরনের সাধনা, জীবন থেকে মহাজীবন রচনার প্রেরণা।
সাহিত্য আমাদের আনন্দের আশ্রয়, দু:খের সান্ত্বনা এবং ন্যায়-বিচারের হাতিয়ার। সাহিত্যপাঠ আমাদের হৃদয়কে প্রস্ফুটিত করে। মনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে এবং বুদ্ধিকে তীক্ষ্ণ করে। সাহিত্য এককথায় জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। তাকে কিছুতেই বর্জন করা যায় না।
সৌমেন সুর: 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেহ নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?' শুধু কাব্য বা কবিতায় নয়, রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প ও উপন্যাসে নারীর স্থান হয়েছে উচ্চ আসনে। ধ্বনিত হয়েছে নারীশক্তির জয়গান। প্রথম পর্বের পর...
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম নারী চরিত্রগুলো হল আয়েশা, শৈবালিনী, কপালকুন্ডলা, কুন্দনন্দিনী, রোহিণী প্রভৃতি। প্রতিটি নারী চরিত্র পৃথক ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টি ছিল নীতিশাসিত। তিনি সমসাময়িক কালে নারীদের সমস্যাগুলো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ 'কৃষ্ণকান্তের উইল'উপন্যাসের ভ্রমরের চরিত্র। ভ্রমরের যেমন স্বামীপ্রেম, স্বামী নির্ভরতা যেমন অতীব সুন্দর। তেমনই স্বামীর বিশ্বাসহীনতা তাঁকে অভিমানের কঠোর আচ্ছাদনে বেষ্টন করে। ভ্রমর তীব্র প্রতিবাদ জানায় স্বামীকে লেখা এক পত্রে। 'তোমার প্রতি বিশ্বাস আমার অনন্ত। আমিও জানিতাম। কিন্তু এখন বুঝিলাম তাহা নহে। যতদিন তুমি ভক্তির যোগ্য ততদিন আমারও ভক্তি। যতদিন তুমি বিশ্বাসী, ততদিন আমারও বিশ্বাস। এখন তোমার উপর আমার ভক্তি নাই, বিশ্বাসও নাই। এখন তোমার দর্শনে আমার কোনও সুখ নাই।'
পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে নারী চরিত্র স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম অগ্রগণ্য। তাঁর রচিত পুতুল নাচের 'ইতিকথা'র কুসুম চরিত্র এবং পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কপিলার মতো জটিল নারী চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বোধ হয় সৃষ্টি হয়নি। কপিলা স্বামীর ঘর সহজে পায়নি। কিন্তু যখন সে পেলো, তখন পূর্বতন প্রেম তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। অবশেষে কুবেরের সঙ্গে কপিলা দু'জনে এক অজানা দ্বীপের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
আধুনিক প্রজন্মের লেখকরা নারীর সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়াকে সমর্থন করে নারীকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এতে নারী জয়গান ঘোষিত হচ্ছে। আগামি দিনের সাহিত্যে এর নিট ফল সুন্দর।
সৌমেন সুর: 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেহ নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?' শুধু কাব্য বা কবিতায় নয়, রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প ও উপন্যাসে নারীর স্থান হয়েছে উচ্চ আসনে। ধ্বনিত হয়েছে নারীশক্তির জয়গান। তাঁর রচনা শেষের কবিতা, গোরা, পয়লা নম্বর, স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি বিষয়ে নারীদের মধ্যে একটা স্নিগ্ধ বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ লক্ষ্য করা যায়। তাঁরা পুরুষের করুণার সামগ্রী নয়, তাঁরা স্বাধীনচেতা মানুষ। প্রয়োজনে তাঁরা পুরুষকে প্রত্যাখানও করতে পারে। যেমন স্ত্রীর পত্রে অসাধারণ চরিত্র মৃণাল বলিষ্ঠভাবে উক্তি করেছে 'ওরে মেজ বৌ ভয় নেই তোর। তোর মেজ বৌয়ের খোলস ছিন্ন হতে এক নিমেষও লাগে না। তোমাদের গালিকে আর আমি ভয় পাইনে। আমার সম্মুখে নীল সমুদ্র, মাথার উপর আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ। আমি বাঁচবো...আমি বাঁচলুম।'
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারী চরিত্রের মধ্যে দেখতে পাই অন্য রূপ। এক অদ্ভুত আবেগময় উপস্থিতি। রমা, সাবিত্রী, রাজলক্ষ্মী, কমললতা এসব চরিত্র আপন শুচিতায় ভাস্বর। এঁরা অতৃপ্ত হৃদয়বাসনাকে বহন করে দগ্ধ ধূপের মতো নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেয়। আবার অভয়া, অচলা, কমললতার চরিত্রের মধ্যে বিদ্রোহিণী রূপ ফুটে ওঠে। প্রয়োজনে পুরুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে অভয়া রোহিণীর ভালবাসার মর্যাদা দিতে তাঁর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করেন। স্বামী নামক আদর্শের পিছনে সে আর ধাওয়া করে না। শ্রীকান্তকে উপলক্ষ্য করে সে সমাজের কাছে প্রশ্ন করে-'আমাকে যিনি বিয়ে করেছিলেন, তাঁর কাছে না এসে উপায় ছিল না। আবার এসেও উপায় হল না। তাঁর স্ত্রী ছেলেপুলে, তাঁর ভালবাসা কিছুই আমার নিজের নয়, তবু তাঁরই কাছে তাঁর গণিকার মতো পড়ে থাকা থাকাতেই কী আমার জীবন ফলে ফুলে ভরে উঠে স্বার্থক হতো শ্রীকান্তবাবু?' (চলবে)
তথ্যঋণ: পূর্বাশা মণ্ডল
সৌমেন সুর: নৌকা চলছে নদীবক্ষ দিয়ে। নৌকা চলছে তো চলছেই। অনেকক্ষণ চলার পর নাবিকরা বুঝতে পারেন দিকভ্রম হয়েছে। নৌকায় উপস্থিত যাত্রীরা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। অবশেষে তীরের সন্ধান মেলে। নৌকা ভেড়ে তীরে। অধিকাংশ যাত্রীই খিদেয় কাতর। নৌকায় যা রসদ আচে, সেগুলো উদরস্থ করতে রান্নার প্রয়োজন। রান্না করতে হলে কাঠের প্রয়োজন। এখন এই ঘন বনে কে কাঠ আনবে? কেউ রাজি না হওয়াতে যাত্রী নবকুমার রাজি হয়। চলে যায় গভীর বনে।
সাহিত্য সম্রাট ঠিক এই সময় নবকুমারের চোখে বনমধ্যে এক অপূর্ব নারীমূর্তি দর্শন করালেন। নবকুমার অবাক দৃষ্টিতে দেখলেন খোলা, লম্বা চুল কালো মেঘের ন্যায়, অতি স্থির, স্নিগ্ধ, গম্ভীর অথচ এই নারী যেন জ্যোতির্ময়। রমনী বুঝতে পারলেন, পথিক পথ হারিয়েছে। পথিককে আশ্বস্ত করলেন এক কাপালিকের আশ্রমে নিয়ে এসে। নবকুমার আশ্রয় পেয়ে স্বস্তি পেলেন। কাপালিক এদিকে মনঃস্থির করে ফেলেছেন নবকুমারকে বলি দেবেন।
অর্থাৎ নরবলি। কাপালিক নবকুমারকে বেঁধে রাখলেন। নবকুমার স্থির বুঝতে পারলেন, কাপালিকের কাছে সে বন্দি। তাঁর প্রাণ উৎসর্গ হবে মায়ের চরণে। কিছু সময় পর নবকুমার চমকে ওঠে। এ যে সেই মনমোহিনী কপালকুন্ডলা। তাঁর হাতে একটা খড়গ, রমনী খড়গ দিয়ে নবকুমারের বাঁধন ছিন্ন করে। নবকুমার মুক্ত হলে রমনী তাঁকে পালিয়ে যেতে বলে। এখানে বঙ্কিমচন্দ্র মায়া-মমতা ঘেরা নারী চরিত্র ফুটিয়ে তুললেন কপাল কুন্ডলার মাধ্যমে।
কপালকুন্ডলা নবকুমারকে অধিকারী ঘরে রেখে কাপালিকের কাছে চলে যেতে চায়। অধিকারী মানা করেন, সেখানে গেলে কাপালিকের দংশনে মৃত্যু হতে পারে। একমাত্র বিবাহ, কপালকুন্ডলাকে ধর্মপত্নী যদি নবকুমার করে তাহলেই একপ্রকার মুশকিল আসান। অতএব অধিকারীর নির্দেশে ওদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। কপালকুন্ডলা তাঁর বন, জঙ্গল ফেলে চললো নবকুমারের সঙ্গে। এবার নবকুমার মেদিনীপুরে কপালকুন্ডলার জন্য এক রক্ষক দাসী নিযুক্ত করলেন, সেটা অধিকারীর ধন বলে। রাতের শেষ প্রহরে কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ হয়, নবকুমার ছুটে এসে যা দেখে তাতে স্তম্ভিত হয়ে যায়। অপূর্ব সুন্দর এক নারী নাম মতি বিবি। সাহিত্য সম্রাতের লেখনি যেন ইতিহাসের প্রেমস্পর্শের প্রতিচ্ছবি, কপালকুন্ডলা তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি উপন্যাসে নিয়ে আসেন সেলিম, মেহের উন্নিসার মতো চরিত্র। তাঁর চরিত্র চয়ন যেন প্রেমস্পর্শের ইতিহাসের সাক্ষী। (বাকি অংশ আগামি পর্বে)
প্রসূন গুপ্ত: বাঙালির খাওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনও কাল নেই, এক আড্ডায় এক সময়ে বলেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। ওনার গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ পড়তে গেলে খাবারের কত রকম যে বিবরণ পাওয়া যায় তার তুলনা নেই। ব্যোমকেশের গল্পেই বর্ষাকালে তেলেভাজা বা খিচুড়ি ও ডিমভাজার গপ্পো শোনা যায়। বাংলার আবহাওয়ার একটি দিক আছে। শীত ও বসন্তকালে বাংলার আবহাওয়া শুষ্ক থাকে বলেই এই সময়ে পেটের রুগীদের পর্যন্ত নানা খাবার বা রান্না হজম হয়ে যায়। অনেকেই বলে গ্রীষ্মকাল নাকি হজমের পক্ষে কঠিন সময়। কিন্তু এই ধারণা আংশিক সত্যি। আসলে বর্ষকালে ভিজে আবহাওয়ার জন্য হজম শক্তি মানুষের কমে যায়। যে কারণে দেখা যায় যত পেটের গন্ডগোল বা সর্দিকাশির প্রকোপ এই সময়েই বাড়ছে।
কিন্তু জিভের লালসা এই বর্ষাকালেই বেড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ তেতো খেতে ভালোবাসতেন, তিনি বিভিন্ন মানুষকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার উপদেশ দিতেন। তিনি বলতেন, 'বর্ষাকাল রোমান্টিক সময় কিন্তু খাওয়া দাওয়ার জন্য নয়। তাঁদের কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে পেয়াঁজ রসুন ছাড়া পাতলা মাছের ঝোল রান্না হতো বর্ষাকালে যার রেসিপি পর্যন্ত দেওয়া আছে।' তবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার আবার বর্ষাকালে খিদে পেত বেশি। চানাচুর থেকে আলুকাবলি কোনও কিছুতেই টেনিদার আপত্তি ছিল না। শোনা যায়, নারায়ণবাবুর প্রিয় খাদ্যগুলিই টেনিদার নামে চালাতেন।
সাহিত্যিক বা বিখ্যাতরা যাই বলুন না কেন। সারাদিনের কালো আকাশ এবং ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি। কোনওভাবে অফিসে রেইনি ডে মিললে, ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জন বাঙালি গৃহকর্ত্রী, গিন্নিকে অনুরোধ করবেই আজ একটু খিচুড়ি হয়ে যাক। তা না হয় হলো, কিন্তু খিচুড়ির সঙ্গে খাবে কি? বললেই তো আর বাজারে গিয়ে ইলিশমাছ কিনে আনা যায় না অতএব ডিমের ওমলেট আর খিচুড়ি। ডিমও যদি না থাকে তবে কিছু একটা ভাজাভুজি দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা জম্পেশ করে খাওয়া যায়। আর এসব কোনওটাই হলো না তবে অবশ্যই বিকেলে তেলেভাজা আর মুড়ি মাস্ট। বর্ষার গৃহবন্দী হয়ে এর বিকল্প কিছু আছে নাকি?
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
সেটা ১৯৮৫ সাল। কলকাতার এয়ারপোর্ট অশোক হোটেলে ওনাকে প্রথম দেখি। সেই সময় শিলিগুড়ি ও কলকাতায় লতা মঙ্গেশকর ও কিশোর কুমার নাইটের আয়োজন করেছিলেন সুপ্রকাশ গড়গড়ি। শিলিগুড়ির অনুষ্ঠান সেরে ওনারা কলকাতায় এয়ারপোর্ট হোটেলে এসে ওঠেন। আমরা কয়েকজন আগে থেকেই হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করছিলাম। লতাজি গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে এলেন, সঙ্গে ভাই হৃদয় মঙ্গেশকর, বোন উষা মঙ্গেশকর সহ আরও অনেকে ছিলেন। পরনে সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। উনি এসে লবিতে দাঁড়াতেই এগিয়ে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিলাম। ওনার সাথে বেশ কিছু কথা বললাম।
উনি জানালেন, শিলিগুড়ির অনুষ্ঠান খুব ভালো হয়েছে। কলকাতার অনুষ্ঠান সম্পর্কেও উনি খুবই আশা ব্যক্ত করলেন। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, যেন স্বপ্ন দেখছি। যাই হোক, কিছু কথা বলার পর বলেছিলাম, দিদি, আপনার একটা সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ পেলে বাধিত হব। তার উত্তরে উনি হেসে বলেছিলেন, এখন শিলিগুড়ি থেকে এলাম, একটু বিশ্রাম নেব। এখন তো আছি, সুযোগ পেলে নিশ্চই সময় দেব। এইভাবেই প্রথম সাক্ষাৎ।
সেই শুরু, এরপর থেকে উনি যখনই কলকাতায় আসতেন, আমি ওনার হোটেলে হাজির হয়ে যেতাম। ওনাকে প্রণাম করে বলতাম, দিদি, আপ ক্যায়সে হ্যায়? উনিও হেসে জিজ্ঞাসা করতেন, আপ ক্যায়সে হ্যায়? এই সময় ওনার সাথে বেশ কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এর পরের বছর আমি বম্বে গিয়েছিলাম রোভার্স কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট কভার করতে। তারই ফাঁকে ফাঁকে স্টুডিওতে গিয়ে ফিল্মের নানান স্টোরি করতাম। সেবার বান্দ্রার মেহেবুব স্টুডিওতে লতাজির গানের রেকর্ডিংয়ে আমন্ত্রণ পাই সঙ্গীত পরিচালক বাপী লাহিড়ীর কাছ থেকে। সেদিন ওনার পরনে ছিল প্রিয় সাদা শাড়ি, ব্লাউজ, কানে সাদা হিরের দুল, ফরাসি পারফিউমের সুবাস ছড়িয়ে লতাজি স্টুডিওতে ঢুকলেন। ঢুকেই বাঙালি রেকর্ডিস্ট অভি ঠাকুরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।
আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপ ইহা কব আয়ে? ওনাকে সব বললাম। তারপরে বললাম, আপনার রেকর্ডিং আছে শুনে চলে এলাম। হেসে আচ্ছা কিয়া বলে ভিতরে চলে গেলেন। আমরাও ওনাকে অনুসরণ করলাম। বাপী লাহিড়ী, অপরেশ লাহিড়ী, পরিচালক শিবু মিত্র সবাই ছিলেন। আগ হি আগ ছবির একটি গান রেকর্ড করবেন সেদিন লতাজি। গানটার কথা ছিল মিলনেসে পহেলে বিছড় গ্যায়ে হাম, কিউ বনকে বিগড় যায়ে, মিতুয়া ও মিতুয়া এই গানটি বাপী লাহিড়ী ট্র্যাকে গেয়ে রেখেছিলেন। সেই গানটা চালানো হলো। লতাজি খুব মন দিয়ে শুনলেন মুখড়াটা। তারপরে ট্র্যাকে প্রথমে মুখড়াটা গাইলেন, তারপরে অন্তরাটা শুনে সেটা গাইলেন। তারপরে সঞ্চারিটা শুনে সেটা গাইলেন। এইভাবে পুরো গানটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গাইলেন। সেদিন কোনও লাইভ মিউজিসিয়ান ছিল না। পুরো গানটাই উনি ট্র্যাকে গেয়েছিলেন।
রেকর্ডিং হয়ে যাবার পরে আমরা সবাই ভিতরে গেলাম। বাপী লাহিড়ীকে জিজ্ঞেস করলেন ঠিক ছিল কিনা। বাপীদা বললেন, খুব ভালো হয়েছে। সেদিন খুবই ভালো মুডে ছিলেন। আমি বললাম, দিদি মন ভরে গেল শুনে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এরপরে উনি অনেক কথাও বলেন। ওনার সাথে বিভিন্ন সময় নানান বিষয়ে কথা হয়েছিল। সঙ্গীতের বাইরেও নানান বিষয়ের প্রতি ওনার গভীর অনুরাগ ছিল। লতাজি জানিয়েছিলেন, উনি খুব ভালো ছবি তুলতেন, ওনার খুব ফোটোগ্রাফির শখ ছিল। ভালো রান্না করতেন, রান্না করে পরিবারের লোকজন ও প্রিয়জনদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন। ভালো পারফিউমের প্রতি দুর্বলতা ছিল। সর্বদাই বিখ্যাত ফরাসি পারফিউম ব্যবহার করতেন। সাহিত্যচর্চার প্রতিও ছিল ওনার গভীর অনুরাগ।
একবার প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার বাংলা গান শুনলে বোঝাই যায় না আপনি অবাঙালি, এটা কী করে সম্ভব? উত্তরে বলেছিলেন, নানান ভাষা শেখার ওনার মধ্যে আগ্রহ রয়েছে। তবে যেহেতু উনি অনেক বাঙালি শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালকের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাই বাঙালিদের প্রতি ওনার একটা আলাদা টান ছিল। আর সর্বোপরি উনি বাংলা সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়ের প্রায় সব উপন্যাসের মরাঠি অনুবাদ ওনার বাড়িতে ছিল। উনি বলেছিলেন, বাংলা যেহেতু খুব মিষ্টি ভাষা, তাই সেই বাংলা ভাষা ভালো করে জানতে এবং যাতে তিনি ভালো করে বাংলা উচ্চারণ করে বাংলা গান গাইতে পারেন, সেই জন্য কিছুদিন বাংলা ভাষা শিখেছিলেন।
লতাজি বলেছিলেন, তিনি বাংলা বুঝতে পারেন এবং মোটামুটি বাংলা বলতেও পারেন। তাঁর মতে, তাঁর সঙ্গীত জীবনে অনিল বিশ্বাস, শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, রাহুল দেব বর্মন থেকে বাপী লাহিড়ি প্রমুখ সবার অবদান রয়েছে।
এরকম অনেক কথা ভিড় করে আসছে মনে। যাই হোক, আবার মেহবুব স্টুডিওর রেকর্ডিংয়ের স্মৃতিতে ফিরে যাই। রেকর্ডিংয়ের পরে সবার সাথে কথা বলে উনি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। বাপী লাহিড়ীর বাবা অপরেশ লাহিড়ী ওনাকে এগিয়ে দিতে গেলেন। পিছন পিছন আমিও অনুসরণ করলাম। মেহেবুব স্টুডিওর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আমরা সবাই নামলাম। লতাজি ওনার সাদা রঙের প্রিমিয়ার পদ্মিনী ফিয়েট গাড়ির দরজা খুলতেই অপরেশ লাহিড়ী মজা করে বলেছিলেন, লতা, তুম কিউ নেহি এক ফরেন কার খরিদতে হো? শুনে হেসে অপরেশ লাহিড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, কেয়া হোগা দাদা? হামারা সওয়ার ঠিক হোনেসে সব ঠিক হ্যায়, বলে আমাদের সবার দিকে হাত নেড়ে চলে গেলেন।
"দুবার সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার কিংবা এবার পদ্মশ্রী সম্মান পাওয়ায় আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। ৪৫ বছর ধরে যে সমাজের কথা লিখে চলেছি আমার সেইসব সাঁওতাল মা ভাই বোনদের ভালবাসার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে"- পদ্মশ্রী সম্মান প্রাপ্তির পর এই কথা জানালেন সাহিত্যিক কালিপদ সরেন।
সাহিত্য জগতে তাঁর পরিচয় খেরওয়াল সরেন নামে। নিজের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন ছোট থেকেই। তারই ফলস্বরূপ কালিপদ সরেন সাঁওতালি সাহিত্যে প্রথম পদ্মশ্রী সম্মান পেতে চলেছেন। তাঁর বাড়ি বর্তমানে ঝাড়গ্রাম শহরের ভরতপুরে। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মী। সাহিত্য চর্চার জন্য ৩৩ বছরের চাকরি জীবনেও পদোন্নতি নেননি। ২০০৭ সালে চায়না নাটকের জন্য সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। ২০১৯ সালের সাঁওতালিতে সেরা অনুবাদ কাজের জন্য দ্বিতীয়বারের জন্য সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান।
দিব্যেন্দু পালিতের উপন্যাস "অনুভব" সাঁওতালিতে অনুবাদ করেছিলেন তিনি। কালিপদ সরেনের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৯ ই ডিসেম্বর লালগড়ের বেলাটিকরী অঞ্চলের রঘুনাথপুর গ্রামে। ওই গ্রামে কোনও স্কুল ছিল না। বেশ কিছুটা পথ হেঁটে গোপালপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে যেতে হতো। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে মেদিনীপুর সদর ব্লকের চাঁদড়া হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। এরপর ১৯৭৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। এরপর জামবনি ব্লকের কাপগাড়ি সেবাভারতি মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক পড়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরিতে যোগ দেন। ২০১৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি লিখেছেন যাত্রাপালা "নিধানদসা"। কলেজ জীবনে লিখেছেন গল্প, কবিতা, একাঙ্ক নাটক, প্রবন্ধ। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। গল্প, কবিতা, নাটক, যাত্রা মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৩ টি। তাঁর গাওয়া ৪০ টি গানের ৪ টি অডিও সিডি প্রকাশিত হয়েছে। একটি আদিবাসী যাত্রাদলও রয়েছে। ২০১৫ সালের ঝাড়খন্ড রাজ্যে একটি সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন।
প্রথমদিকে বাংলা হরফে সাঁওতালি লিখলেও পরে অলচিকি লিপিতে লেখা শুরু করেন। ২০০৪ সালে অল ইন্ডিয়া সান্তালি রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনে তাঁকে পণ্ডিত "রঘুনাথ মুর্মূ পুরস্কার" এ পুরস্কৃত হন তিনি। ২০০৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল সান্তাল কাউন্সিল থেকে পেয়েছেন সেরা সাহিত্যিকের সম্মান। সাঁওতালি সাহিত্য জগতে একের পর এক পুরস্কারে পুরস্কৃত হওয়ার পর এবার "পদ্মশ্রী" সম্মানে ভূষিত হন তিনি। ঝাড়গ্রামের প্রথম পদ্মশ্রী প্রাপক সাহিত্যিক কালিপদ সরেন।