সৌমেন সুর: মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর সময় হলো শৈশব। কোন পিছুটান নেই। শুধু খেলা, মজা আর আনন্দ। তবে সবার জীবন সমান নয়। কারো কারো জীবনে আনন্দের লেশমাত্র নেই। প্রখ্যাত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলা কেমন ছিল সেটাই আজ আলোচনা করবো। প্রথম পর্বের পর...
ঈশ্বরের দুষ্টুমির জন্য় পাড়ার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে যেতো। কখনও কারও বাগানে ঢুকে চুপি চুপি ফল খেয়ে ফেলতেন। কেউ কাপড় শোকাতে দিলে, সেই কাপড়ে ময়লা দাগ লাগিয়ে দিতেন ঈশ্বর। কখনও ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে, ধানের শিষ মুখে দিয়ে চিবাতেন তিনি। একবার যবের শিষ চিবাতে গিয়ে গলায় কাঁটা আটকে যায়। দূর্গাদেবী অনেক চেষ্টা করে গলায় আঙুল দিয়ে সেই কাঁটা বের করেন। ঈশ্বরের আবার কোনওকিছুতে ভয় ছিল না। এমনকি বাবাকেও ভয় পেতেন না।
বাবা যা বলতেন তার বিপরীত কাজ করতেন ঈশ্বর। এমন গোঁ ছিল তাঁর। যাই হোক আট বছর পর্যন্ত কালীকান্তের পাঠশালায় পড়াশোনা করলেন। একদিন গুরুমশাই ঠাকুরদাসকে ডেকে বললেন, 'ঈশ্বরের যা মেধা, আমার মনে হয় কলকাতার স্কুলে পড়াশোনা করলে অনেক বিদ্বান হবে। এখানে ওর প্রয়োজন নেই'। ঠাকুরদাস অনেক চিন্তা করে ঈশ্বরকে নিযে এলেন কলকাতা। একদিন বীরসিংহ থেকে বেড়িয়ে পড়লেন কলকাতার উদ্দেশে পায়ে হেঁটে।
ভাবুন পথটা! যাত্রায় ঠাকুরদাস, ঈশ্বরচন্দ্র আর গুরুমশাই কালীকান্ত। হাঁটতে হাঁটতে ঈশ্বর খেয়াল করলেন, রাস্তার পাশে লঙ্কা বাটার মতো পাটা পোঁতা। ঈশ্বর প্রশ্ন করলেন বাবাকে, এটা কী? ঠাকুরদাস বলেন, এটাকে বলে মাইলস্টোন।কলকাতা থেকে এক মাইল অন্তর পাথর পোঁতা আছে। যাতে মানুষের পথ মাপতে বুঝতে অসুবিধা না হয়। মেধাবী ঈশ্বরচন্দ্র পরের পোঁতা পাতর দেখে বলে দেয়, কত মাইল তাঁরা হেঁটে চলেছে। গুরুমশাই কালীকান্ত ঈশ্বরের মেধা দেখে আর্শীবাদ করে বলেন, 'এই ছেলে একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে'। (চলবে)
সৌমেন সুর: হিন্দু কলেজের শিক্ষা সমাপ্ত করার পর, ১৮৬১ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে মহেন্দ্রলাল সরকার আই.এম.এস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৬৩ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ডক্টর অফ মেডিসিন ডিগ্রির অধিকারী হন। ভারতে সুশৃঙ্খল প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান চর্চার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, "বঙ্গদেশকে যত লোক উঁচু করে তুলেছেন এবং শিক্ষিত বাঙালিদের মনে মনুষ্যত্বের আকাঙ্ক্ষা দীপ্ত করেছেন, তাঁদের মধ্যে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন অন্যতম। এরকম বিমল সত্যানুরাগী, সাহসী ও দৃঢ়চেতা অতি অল্প বাঙালিই দেখাতে পেরেছেন। এইরকম জ্ঞানানুরাগ মানুষ বঙ্গদেশে দুর্লভ।"
যাই হোক, এম.ডি ডিগ্রি পাওয়ার পর ডাক্তার সরকার প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। তাঁর অসামান্য রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের খ্যাতি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যসাগর তাঁর অত্যন্ত গুণগ্রাহী ছিলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের ক্যানসার রোগের চিকিৎসার জন্য, তাঁর ভক্তরা ডাঃ সরকারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। জীবনের প্রাথমিক পর্বে হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে তাঁর অনাস্থার প্রধান কারণ ছিল- ওই পদ্ধতিতে অ্যানাটমি ও ফিজিওলজির তেমন গুরুত্ব না থাকা। পরবর্তীতে বিদ্যাসাগরের প্রেরণায় নিজের চিকিৎসার ধারা পাল্টে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা হোমিওপ্যাথি বিশেসজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার।
ডাক্তার সরকারের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল 'ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন ফোর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স' প্রতিষ্ঠা করা। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সমকালের সেরা ছাত্রদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চায় যাতে মগ্ন থাকে তারই জন্য এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তাঁরই ভাইপো অমৃতলাল সরকার। তাঁর সময়েও এই প্রতিষ্ঠানের প্রভূত উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। প্রতিষ্ঠানটি যাদবপুরে অবস্থিত। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার সেই সময়ের রোগ নিরাময়ে ছিলেন ধন্বন্তরী, তাইতো আজও তাঁকে ভুলতে পারিনি আমরা।