সৌমেন সুর: উপন্যাস এমন একটি শিল্পকর্ম যেখানে কাহিনীর সূত্র ধরে অজস্র চরিত্রের আনাগোনা ও স্রষ্টার জীবনদর্শন মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। 'তৃণখন্ড' থেকে শুরু করে 'হরিশচন্দ্র' পর্যন্ত সাহিত্য পরিক্রমায় বনফুল প্রায় ৬০টির মতো উপন্যাস লিখেছেন। এছাড়া লিখেছেন অজস্র ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটক। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস বিষয় বৈচিত্র্য অনন্য, তাঁর লেখার মধ্যে ছিল বিজ্ঞানীর বিশ্লেষনী দৃষ্টি। বনফুলের কষ্টিপাথর উপন্যাসটি পত্রের আকারে রচিত।
প্রায় ৫৩টি চিঠির মধ্যে দিয়ে এর কাহিনী উদ্ধৃত। এই উপন্যাসের মূল বিষয় নারী স্বাধীনতা ও সমাজে নারীর অবস্থান। অমিত ও হাসির দাম্পত্য সম্পর্ক ধরে বিষয়টি তিনি উপস্থাপন করেছেন। 'ডানা' উপন্যাসে প্রায় ১৫০ পাখির নাম আছে। এছাড়াও আছে তাদের নানা রঙের, নানা আকারের ডিমের কথা। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নতুন কিছু বলতে চেয়েছেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল কর অবজেকটিভ সাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর বিশেষত্বের কথা বলেছিলেন।
বনফুলের ছোটগল্পেও বৈচিত্র্যের সমাবেশ। এ বৈচিত্র্য বিষয়ে, আঙ্গিকে। জীবনে তিনি বহু ধরনের মানুষ দেখেছেন। জাতপাত ধর্মের বিচার না করে বহু মানুষের সঙ্গে তিনি মিশেছেন, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনার শরিক হয়েছেন। নানারকম মানুষের কথাই তাঁর ছোটগল্পের বিষয়। 'নিমগাছ' তাঁর অনবদ্য একটি গল্প। নিমগাছের উপর কত অত্যাচার হয়ে চলেছে। কিন্তু নিমগাছ তার প্রতিবাদ করে না। সবই নীরবে সহ্য করে। প্রথম থেকেই একটা টানটান আকর্ষন। শেষে দেখা যায়, এ তো নিমগাছের কথা নয়। গোটা নিমগাছটাই আমাদের পরিচিত পরিবারের সর্বংসহ গৃহবধূর প্রতীক হয়ে গিয়েছে। পরিবারের কাঠামো ভাঙছে, পুরোনো দিনের উদার উদার হৃদয় মানুষগুলোকেও আর দেখা যাচ্ছে না।
বনফুল তাঁর অজস্র সৃষ্টি সম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। জীবনে তিনি অনেক সরকারি বেসরকারি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু পাঠকের ভালবাসাকেই তিনি বড় পাওনা বলে মনে করেছেন। এর কাছে তাঁর 'পদ্মভূষন'-ও ম্লান হয়ে যায়। তিনি সাহিত্য সম্পর্কে যা রেখে গিয়েছেন, তা বাঙালি পাঠক কোনওদিন ভোলেনি, ভুলবেও না।
সৌমেন সুর: জীবনের আয়না হলো সাহিত্য। জীবন চলমান, সাহিত্য়ও চলমান। সমাজ বদলায়, সেই বদলের রং লাগে মানুষের গায়ে। তার শিল্প-সাহিত্য়, তার মননে ভাবনায়, জীবনচর্চায়। আধুনিক জীবনে আধুনিক সাহিত্য় হিসেবে আসে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, প্রহসন, কবিতা। গল্প-উপন্যাস এক জায়গায় থেমে থাকলো না। শুরু হলো পরিবর্তন আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মধু-নবীন বঙ্কিম নতুন আঙ্গিকে নতুন কথা বললেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ একাই সব শাখাতে জোয়ার আনলেন। এর মধ্য়ে তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষন দাবিদার হলেও সেখানে ভাগ বসালেন বনফুল অর্থাত্ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বনফুলের সৃষ্ট সম্ভারে সমৃদ্ধ হলো বাংলা সাহিত্য়ের ভান্ডার। বিশেষ করে গল্প উপন্যাসে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনীয়।
১৯২৭ সালে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পাটনা থেকে ডাক্তার হয়ে বেরোলেন। কলকাতায় এসে ডা চারুব্রত রায়ের কাছে প্যাথোলজিতে বিশেষ ট্রেনিং নিলেন। ডাক্তারি পরীক্ষা দিয়ে তিনি বিয়ে করেন। প্যাথোলজি ট্রেনিং শেষ করে আজিমগঞ্জে মিউনিসিপ্যালিটির হাসপাতালে কাজ নিলেন। বেশি দিন সেখানে থাকলেন না। আজিমগঞ্জের কাজ ছেড়ে দিলেন। এরপর ভাগলপুরে ল্যাবরেটরি তৈরি করলেন এবং সেখানেই প্র্যাকটিস শুরু করলেন। ভাগলপুরেই তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেন। ১৯৬৮ সালে তিনি পাকাপাকিভাবেই ভাগলপুর কলকাতায় চলে এলেন। ততদিন বাংলা সাহিত্যে তিনি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।