সৌমেন সুর: 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেহ নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?' শুধু কাব্য বা কবিতায় নয়, রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প ও উপন্যাসে নারীর স্থান হয়েছে উচ্চ আসনে। ধ্বনিত হয়েছে নারীশক্তির জয়গান। প্রথম পর্বের পর...
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম নারী চরিত্রগুলো হল আয়েশা, শৈবালিনী, কপালকুন্ডলা, কুন্দনন্দিনী, রোহিণী প্রভৃতি। প্রতিটি নারী চরিত্র পৃথক ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টি ছিল নীতিশাসিত। তিনি সমসাময়িক কালে নারীদের সমস্যাগুলো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ 'কৃষ্ণকান্তের উইল'উপন্যাসের ভ্রমরের চরিত্র। ভ্রমরের যেমন স্বামীপ্রেম, স্বামী নির্ভরতা যেমন অতীব সুন্দর। তেমনই স্বামীর বিশ্বাসহীনতা তাঁকে অভিমানের কঠোর আচ্ছাদনে বেষ্টন করে। ভ্রমর তীব্র প্রতিবাদ জানায় স্বামীকে লেখা এক পত্রে। 'তোমার প্রতি বিশ্বাস আমার অনন্ত। আমিও জানিতাম। কিন্তু এখন বুঝিলাম তাহা নহে। যতদিন তুমি ভক্তির যোগ্য ততদিন আমারও ভক্তি। যতদিন তুমি বিশ্বাসী, ততদিন আমারও বিশ্বাস। এখন তোমার উপর আমার ভক্তি নাই, বিশ্বাসও নাই। এখন তোমার দর্শনে আমার কোনও সুখ নাই।'
পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে নারী চরিত্র স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম অগ্রগণ্য। তাঁর রচিত পুতুল নাচের 'ইতিকথা'র কুসুম চরিত্র এবং পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কপিলার মতো জটিল নারী চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বোধ হয় সৃষ্টি হয়নি। কপিলা স্বামীর ঘর সহজে পায়নি। কিন্তু যখন সে পেলো, তখন পূর্বতন প্রেম তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। অবশেষে কুবেরের সঙ্গে কপিলা দু'জনে এক অজানা দ্বীপের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
আধুনিক প্রজন্মের লেখকরা নারীর সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়াকে সমর্থন করে নারীকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এতে নারী জয়গান ঘোষিত হচ্ছে। আগামি দিনের সাহিত্যে এর নিট ফল সুন্দর।
সৌমেন সুর: কপালকুন্ডলা ভালবাসার মানুষকে আগলে রাখতে চায়। তাঁর একমাত্র প্রিয় মানুষটি হলেন নবকুমার। এই নবকুমার আজকাল কেমন যেন বদলে গেছে। কোনও বিবাহিত নারীকে তাঁর স্বামী যদি অযথা সন্দেহ করে, তাহলে বিবাহিত নারীর পরিস্থিতি কেমন হয়, পাঠক আপনারা সেটা অনায়াসে অনুভব করতে পারছেন। কপালকুন্ডলার জীবনে এই অভিশপ্ত মুহূর্ত চলে আসে। কারণ সাংসারিক জীবনে তাঁরা সুখী নয় অযথা সন্দেহের কারণে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তুলে ধরলেন কপালকুন্ডলা নারী চরিত্রের চিরন্তন ত্যাগের প্রতিমূর্তি।
একদিন নবকুমার দেখে, রাত্রি দুই প্রহরে কপালকুন্ডলা একাকিনী হেঁটে চলেছে। কোথায় যাচ্ছো কপালকুন্ডলা। নবকুমারের মনে সন্দেহের বীজ বপন হতে থাকে। নবকুমারের সন্দেহের আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার জন্য এই সময় কাপালিকের আগমন হয়। সে নবকুমারকে তিক্ত করে তোলে, ভুল বোঝায়। কপালকুন্ডলার দিকে তাকিয়ে বলে সে ব্যাভিচারিণী। নইলে কোনও নারী এত রাতে বাইরে বেরোয়। এমন নারীর বেঁচে থাকার কোনও অর্থ নেই। তাকে বলি দেওয়ার প্রয়োজন আছে।
বলির সময় উপস্থিত। কাপালিক নবকুমারকে মদিরার নেশায় জর্জরিত করে দিয়েছে। বলির আগে স্নান করাতে হয় বলে নবকুমার কপালকুন্ডলাকে নদীর কাছে নিয়ে আসে। এই সময় নবকুমার তার পায়ে আছড়ে পড়ে বলে, 'বলো বলো তুমি অবিশ্বাসিনী নও। একবার বলো। তাহলে আমি তোমাকে ঘরে নিয়ে যাই।' কপালকুন্ডলা এক বুক অভিমান করে বলে, 'আপনি যাকে আমার সাথে গভীর রাতে দেখেছিলেন সে হলো পদ্মাবতী।'
নবকুমারের ভুল ভাঙে, কপাল কুন্ডলার জন্য দু'হাত প্রসারিত করে। ঠিক এই সময় সাহিত্য সম্রাট বর্ণনায় নারী চরিত্রকে তুলে ধরলেন এক অভিমানী রূপে। যে স্বামী তাকে সন্দেহ করে, যার সঙ্গে মনের কোনও সম্পর্ক নেই, তার সঙ্গে থাকার কোনও অর্থ হয় না। জীবন বিসর্জন দেওয়া এর থেকে অনেক ভালো। কপালকুন্ডলা নদীর উত্তলিত তরঙ্গে ঝাঁপ দিলেন। নবকুমারও পরজীবনের ভালবাসার খোঁজে তলিয়ে গেলেন।
নারীরূপের রহস্যের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির বহিঃপ্রকৃতি এবং অন্তঃপ্রকৃতির গভীর রহস্যময়তা ঘিরে রয়েছে এই উপন্যাসে। কাব্যময়তা কপালকুন্ডলাকে এনে দিয়েছে স্নিগ্ধতর ভিন্ন এক সুষমা। এই উপন্যাসের সর্বাঙ্গে রয়েছে গর্জমান জলতরঙ্গের সুর এবং সেই অরণ্যের রহস্যঘন তন্ময়তা। যার ফলে গল্পটি আমাদের আকর্ষণ করে।
সৌমেন সুর: নৌকা চলছে নদীবক্ষ দিয়ে। নৌকা চলছে তো চলছেই। অনেকক্ষণ চলার পর নাবিকরা বুঝতে পারেন দিকভ্রম হয়েছে। নৌকায় উপস্থিত যাত্রীরা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। অবশেষে তীরের সন্ধান মেলে। নৌকা ভেড়ে তীরে। অধিকাংশ যাত্রীই খিদেয় কাতর। নৌকায় যা রসদ আচে, সেগুলো উদরস্থ করতে রান্নার প্রয়োজন। রান্না করতে হলে কাঠের প্রয়োজন। এখন এই ঘন বনে কে কাঠ আনবে? কেউ রাজি না হওয়াতে যাত্রী নবকুমার রাজি হয়। চলে যায় গভীর বনে।
সাহিত্য সম্রাট ঠিক এই সময় নবকুমারের চোখে বনমধ্যে এক অপূর্ব নারীমূর্তি দর্শন করালেন। নবকুমার অবাক দৃষ্টিতে দেখলেন খোলা, লম্বা চুল কালো মেঘের ন্যায়, অতি স্থির, স্নিগ্ধ, গম্ভীর অথচ এই নারী যেন জ্যোতির্ময়। রমনী বুঝতে পারলেন, পথিক পথ হারিয়েছে। পথিককে আশ্বস্ত করলেন এক কাপালিকের আশ্রমে নিয়ে এসে। নবকুমার আশ্রয় পেয়ে স্বস্তি পেলেন। কাপালিক এদিকে মনঃস্থির করে ফেলেছেন নবকুমারকে বলি দেবেন।
অর্থাৎ নরবলি। কাপালিক নবকুমারকে বেঁধে রাখলেন। নবকুমার স্থির বুঝতে পারলেন, কাপালিকের কাছে সে বন্দি। তাঁর প্রাণ উৎসর্গ হবে মায়ের চরণে। কিছু সময় পর নবকুমার চমকে ওঠে। এ যে সেই মনমোহিনী কপালকুন্ডলা। তাঁর হাতে একটা খড়গ, রমনী খড়গ দিয়ে নবকুমারের বাঁধন ছিন্ন করে। নবকুমার মুক্ত হলে রমনী তাঁকে পালিয়ে যেতে বলে। এখানে বঙ্কিমচন্দ্র মায়া-মমতা ঘেরা নারী চরিত্র ফুটিয়ে তুললেন কপাল কুন্ডলার মাধ্যমে।
কপালকুন্ডলা নবকুমারকে অধিকারী ঘরে রেখে কাপালিকের কাছে চলে যেতে চায়। অধিকারী মানা করেন, সেখানে গেলে কাপালিকের দংশনে মৃত্যু হতে পারে। একমাত্র বিবাহ, কপালকুন্ডলাকে ধর্মপত্নী যদি নবকুমার করে তাহলেই একপ্রকার মুশকিল আসান। অতএব অধিকারীর নির্দেশে ওদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। কপালকুন্ডলা তাঁর বন, জঙ্গল ফেলে চললো নবকুমারের সঙ্গে। এবার নবকুমার মেদিনীপুরে কপালকুন্ডলার জন্য এক রক্ষক দাসী নিযুক্ত করলেন, সেটা অধিকারীর ধন বলে। রাতের শেষ প্রহরে কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ হয়, নবকুমার ছুটে এসে যা দেখে তাতে স্তম্ভিত হয়ে যায়। অপূর্ব সুন্দর এক নারী নাম মতি বিবি। সাহিত্য সম্রাতের লেখনি যেন ইতিহাসের প্রেমস্পর্শের প্রতিচ্ছবি, কপালকুন্ডলা তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি উপন্যাসে নিয়ে আসেন সেলিম, মেহের উন্নিসার মতো চরিত্র। তাঁর চরিত্র চয়ন যেন প্রেমস্পর্শের ইতিহাসের সাক্ষী। (বাকি অংশ আগামি পর্বে)
সৌমেন সুর: জাতীয় সঙ্গীত সব মানুষের অন্তরের মুখের ভাষা, বুকের আশা। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয় সঙ্গীত, জাতিকে দিয়েছে আত্মত্যাগের মহিমা। জাতীয় সঙ্গীতে জাতির স্বদেশপ্রীতি, ভাবাদর্শ, আত্মত্যাগ, স্বপ্নসাধনা মূর্ত হয়ে ওঠে।
প্রথম জাতীয় সঙ্গীত বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে। সেখানে সন্তান দল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। মাতৃবন্দনার মহামন্ত্রে উচ্চারিত হল 'বন্দেমাতরম।' ১৮৯৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ওই মাতৃবন্দনাকেই জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করে। আসলে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে জাতির আত্মপ্রকাশের বীজ প্রকট হয়ে ওঠে। এই মাতৃমন্ত্র উচ্চারণ করে কত মুক্তিযোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জাতীয় সঙ্গীতের গভীরতায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ হয়ে ওঠে সোচ্চার। কোনও শক্তি আত্মত্যাগী স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষকে রোধ করতে পারে না।
স্বাধীনতার পর জাতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত হয়। বলা হয়, 'বন্দে মাতরম' সঙ্গীতটি অত্যন্ত দীর্ঘ এবং সুরসৃষ্টিতে অসুবিধা। তাই এর একটি স্তবকে হয় জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি দান। তবে ১৯৫০ সালের ২০ জানুয়ারি 'জনগণমন' সঙ্গীতের প্রথম অংশ জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি পায়। স্রষ্টা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রত্যেক রাষ্ট্র এবং জাতির থাকে জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় সঙ্গীত তাঁর মর্যাদা এবং অহঙ্কার। জাতীয় সঙ্গীতের অপমান মানে গোটা জাতির অপমান। জাতীয় সঙ্গীতের অমর্যাদা আমাদের কলঙ্ক। বুঝতে হবে মানুষের আত্মদানের মধ্যে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। জাতীয় সঙ্গীত আমাদের প্রাণ, আমাদের বিবেক।