একুশে জুলাই তৃণমূলের শহীদ দিবস এলেই বিরোধীদের মুখে শোনা যায় 'ডিম্ভাত' কটাক্ষ। এই বছর শহরের বিভিন্ন জায়গায় দূরের জেলা থেকে কর্মী সমর্থকদের থাকার ব্যবস্থা করেছে শাসকদল।
কসবার গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে থাকছেন মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ থেকে আসা তৃণমূল কর্মীরা৷ তাঁদের জন্য ডিম ভাত থাকছে। সঙ্গে থাকছে সয়াবিনের তরকারি। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে থাকছেন উত্তরবঙ্গ থেকে আাসা তৃণমূল কর্মী সমর্থকরা। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দুই দিনাজপুরের তৃণমূল সমর্থকদের জন্য ডিম ভাতের আয়োজন হয়েছে।
উত্তর হাওড়ার শ্যাম গার্ডেন ও শ্রীরাম বাটিকা এই দুই জায়গায় হাজার পঞ্চাশ মানুষের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলার কর্মী সমর্থকদের জন্য থাকছে ভাত, ডাল, আলু পটলের তরকারি, ডিমের ঝোল। এর বাইরেও ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র, শিয়ালদহেও থাকছেন তৃণমূল সমর্থকরা। সর্বত্রই মেনুতে থাকছে বহুচর্চিত ডিম ভাত। সঙ্গে যাঁরা নিরামিষ খান তাঁদের জন্য কোথাও ডাল, আলুসেদ্ধ, কোথাও তরকারির আয়োজন।
প্রসূন গুপ্তঃ তৃণমূলের মঞ্চে যে মুহূর্তে শিল্পী শুভাপ্রসন্ন এলেন অমনি ভিড়ের চারিধার থেকে আওয়াজ উঠলো 'গদ্দার গদ্দার"। জয়নগরের আজমল বলে উঠলো 'এডারে ডেকেসে কে?' আসলে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে বিবিধ পেশার মানুষের ভিড় থাকেই। চলচিত্র থেকে খেলাধুলার নানান ব্যক্তিত্ব। এটা কিন্তু চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ভিড় বেড়েছে সেলিব্রেটিদের। স্বাভাবিক। সুবিধা নিতে কে না চায়। সিপিএমের জমানায় বহু শিল্পী খেলোয়াড় প্রয়াত মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু দিন পাল্টাতেই তাদেরও পাল্টি খেতে সময় লাগেনি। ২০২১-এর নির্বাচনের আগে বহু সেলিব্রেটি মমতা ক্যাম্প ছেড়ে বিজেপির পতাকা হাতে নিয়েছিলেন। পরে গো-হারান হেরে ফের ফেরত তৃণমূলে। মমতার কোথাও এক অদ্ভুত দুর্বলতা আছে, তিনি দ্রুত ক্ষমা করে দেন। কিন্তু অভিষেকের ডিকশনারিতে ক্ষমা বলে কোনও বস্তু নেই। কাজেই প্রধান বক্তা মমতার সভায় একে একে উপস্থিত হয়ে সলজ্জ মুখে দিব্বি মঞ্চে উঠে পড়ছেন অনেকেই।
কিন্তু এটাই ২১ জুলাইয়ের প্রকৃত দৃশ্য নয়। তৃণমূল দল, সিপিএম বা বিজেপির মতো সংগঠিত দল নয়। এখানে মমতা আবেগটাই বৃহৎ বিষয়। এতো বিতর্কিত কান্ড। গ্রেফতারি বা কোর্টকাছারি হবার পরেও 'মমতা আবেগ' কমেনি বরং যতই গন্ডগোল বা মৃত্যু কিছু কেন্দ্রে হলেও আজকেও মমতা আবেগে পঞ্চায়েতের ভোটের ফল প্রকাশিত হয়েছে।
জেতার আনন্দে মুর্শিদাবাদের কোনও অঞ্চল থেকে শাহিন তার দলবল নিয়ে আগেই উপস্থিত হয়েছে। আগের রাতে ডাল ভাত ডিমের ঝোল খেয়ে আড্ডা মেরে আজ ধর্মতলায়। কোচবিহার থেকে এসেছে প্রদীপ দাস। ৫ বন্ধু নিয়ে এসে উঠেছে বারাসাতের দিদির বাড়িতে। সকালে আর তাদের দেখা নেই, চলে গিয়েছে কাকভোরে ধর্মতলায়।
কলকাতা বিমানবন্দরে কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করা সুদীপ দেব একদিনের বেতন কাটার পরোয়া না করে দৌড়েছে সভাস্থলে। শিলিগুড়ির রূপক বিশ্বাস বেশ কয়েকবার কলকাতায় আসে। ২১ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান কোনও দিন বাদ দেয় নি। গত রাতেই উঠেছে শিয়ালদহের কোনও এক হোটেলে। সভা শেষে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরে ফিরবে। বাঁকুড়ার প্রেম মিশ্র বা কাঁচারাপাড়ার রাহুল চক্রবর্তী বা কলকাতার ঋতম প্রামানিক কিংবা মিঠু ভট্টাচার্যর মিলিত হয়েছে মনুমেন্টের সামনে, একসাথে যেতে হবে।
এই চিত্রের শেষ নেই। আসলে এরাই তৃণমূলের আসল শক্তি। এরা দলের নেতাদের কাছের লোক নয়, চাকরি বা রোজগার করে নিজের কৃতিত্বে। এরাই কিন্তু মমতার সম্পদ যা এতোদিনেও ধরতে পারেন নি বিরোধীরা।
প্রসূন গুপ্তঃ ১৯৯৩-এ বামফ্রন্ট জমানায় ২১ জুলাই ধর্মতলার সন্নিকটে যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযান হয়েছিল এবং আজ ইতিহাসের পাতায় কলকাতার বুকে এক কালো দিনে পরিণত হয়েছে ওই দিনটি। একটা সময়ে চারিদিক থেকে আসা মিছিল আটকাতে না পেরে মেওয়া রোডের কাছে পুলিস গুলি চালালে ১৩ জন কংগ্রেসির মৃত্যু হয়। নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন বিরোধী মুখ আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই থেকে প্রতি বছর এই দিনটিতে শহীদ দিবস পালন করে তৃণমূল কংগ্রেস (আগে যারা যুব কংগ্রেস ছিল)। আলাদা ভাবে অনেকদিন প্রদেশ কংগ্রেসও দিনটি পালন করতো কিন্তু ২০১৬ তে কংগ্রেস ও সিপিএমের জোট হওয়ার পর বন্ধ হয় গিয়েছে কংগ্রেসের শহীদ দিবস পালন। ৩০ বছর হয়ে পার হয়ে গিয়েছে। আজকের দিনে তৃণমূলের আক্রমণের লক্ষ আর বাম বা সিপিএম নেই, এখন টার্গেটে বিজেপি।
বেশ কয়েক বছর আর তথাকথিত শোক অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে। এখন মঞ্চে গান সম্বর্ধনা এবং ভাষণ ইত্যাদি হয়ে থাকে। কিন্তু এই ২১ জুলাইকে কেন্দ্র করে ২০ জুলাই তৃণমূলের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক গ্রুপ চায়ের আড্ডা বসায় বিভিন্ন প্রান্তে অনেকটা গেটটুগেদারের মতোই। সেখানে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের তৃণমূল ভক্তদের হাজিরা থাকে। মূল অনুষ্ঠানটি হয় মধ্য কলকাতার গনেশ এভিনিউতে। মাঝে কয়েক বছর করোনার কারণে বন্ধ থাকলেও গত বছর থেকে ফের শুরু হয়েছে এই চায়ের আড্ডা। এই সোশ্যাল নেটের কর্মীরা একেবারেই সাদামাঠা কিছু দিদি ভক্ত মানুষ। এদের ফেসবুকে দলের প্রচার করাটা একটি নেশা। যদিও বিজেপি বা সিপিএমের মতো কোনও সংগঠিত সংগঠন এদের নেই, দলের তরফ থেকে কোনও সাহায্য এরা আশাই করে না। নিজেদের পয়সায় তারা প্রচার করে এবং চায়ের আড্ডাটিও চাঁদা তুলে নিজেরাই করে থাকে। অবিশ্যি এ বছর অরূপ চক্রবর্তী, জুঁই বিশ্বাস, সাংসদ শুভাশীষ চক্রবর্তী, দেবাংশু ভট্টাচার্য প্রমুখরাও উপস্থিত ছিলেন। এই দলপ্রিয় মানুষগুলির কথা কেউ জানে না।