Share this link via
Or copy link
আজও পুজো দালানে তৈরি হয় এক কাঠামোয় দেবীমূর্তি। আজও এলাকার মানুষ গোটা বছর অপেক্ষায় থাকে নিমতিতা রাজবাড়ির দুর্গার জন্য। জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে গঙ্গা। বাড়ির খিড়কি গুলিতে আছড়ে পড়ে নদীর হাওয়া। গোটা বাড়িজুড়ে সময়ের থাবা। দাঁত বের করে আছে পুরনো ইঁট। মোটা থামগুলি যেন অতীত গৌরব গাথার দলিল। বর্ষায় নদী ফুঁসে উঠলে উঁকি দিয়ে যায় জমিদার বাড়ির উঠোনে। মুর্শিদাবাদের নিমতিতা রাজবাড়ি এবং তাদের দুর্গাপুজো শোনায় ২০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস। গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরী দুই ভাই মিলে ২০০ বছর আগে তৈরি করেন নিমতিতার রাজবাড়ি। ইতালিয়ান ধাঁচের এই বাড়িতে রয়েছে পাঁচটি উঠোন এবং দেড়শো ঘর। এই বাড়িতে একসময় এসেছিলেন বহু গুণীজন। দ্বারকানাথের ছেলে রায়বাহাদুর জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরীর মেয়ের বিয়েতে বরযাত্রী এসেছিলেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। কবিকে নিয়ে আসা হয়েছিল যে গাড়িতে, আজ সেটা পড়ে আছে অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
পুজোর সময় গোটা বাড়িতে আলো ঝলমল করত। পুজোর ক'দিন হরেক অনুষ্ঠান, অঢেল খাওয়াদাওয়া। একবার নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কলকাতার স্টার থিয়েটার গ্রুপকে। তখনও রাজবাড়ির ঝাড়বাতিতে বনেদিয়ানা বর্তমান ছিল। এই রাজবাড়িটি ধরা আছে সত্যজিত রায়ের জলসাঘর, দেবী, সমাপ্তির ফ্রেমে। এরপর কালের নিয়মে কড়িবরগাগুলো দখল নিয়েছে ঘুণপোকায়। এককালে যেখানে আলতা পায়ের ছাপ থাকত, আজ সেখানে আগাছায় ভরে গিয়েছে। বিষাক্ত সরীসৃপরা আশ্রয় নিয়েছে ইটের খোঁদলে। তবুও বাড়ির ঠাকুর দালানে আজও উমা আসেন। ২০০ বছর ধরে হয়ে আসছে মাতৃ আরাধনা।
২০০ বছর প্রাচীন এই রাজবাড়ি ঘিরে জড়িয়ে হাজার গল্প। কে বা কারা নাকি এখনও রয়ে গিয়েছেন বন্ধ দরজার ওপারে। রাত গভীর হলে কাদের যেন পায়ের আওয়াজ ঘুরে বেড়ায় গোটা বাড়িতে। প্রতিটি দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় নূপুরের আওয়াজ। সাহসী অনেক মানুষ নাকি এই বাড়িতে প্ল্যানচেট করতেন এক সময়। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় বাড়ির রূপ। উপলব্ধি করা যায় অন্য পৃথিবীর ইশারা।
২০০ বছর আগে পুজোয় নহবত বসত। পুজো দালানে থরে থরে সাজানো থাকত ভোগ। ভিয়েন বসত সেকালে। এখন সে সবই অতীত। নিয়ম মেনে পুজো হয় বটে। ঢাক ও বাজে। কিন্তু জৌলুষ সব মুছে গিয়েছে। বাড়ির বাসিন্দারা একে একে ভিটে ছেড়েছে প্রত্যেকেই। তাদের দেওয়া টাকায় পুজোটুকু হয় নমো-নমো করে। তবু পুজোর কটা দিন স্থানীয় মানুষরা মায়ের দালানে ভিড় জমান মনের টানে।
বৃদ্ধ, অথর্ব, রিক্ত নিমতিতার রাজবাড়ি আজ শুধুই অতীতের কঙ্কাল। গঙ্গার হাওয়া যখন আছড়ে পড়ে বাড়িতে, তখন ঘুলঘুলিতে ডেকে ওঠে অজানা পাখি। রঙ ঝড়ে গিয়েছে বসন্তর মতো। শ্যাওলার ছোপে জেগে ওঠে অচেনা মানচিত্র। জমিদার বাড়ির পুকুরে ঢেউ ওঠে না সেও প্রায় অনেক দিন হয়ে গেল। তবু আশ্বিনের শারদ প্রাতে কেন যেন বেজে ওঠে আলোক মঞ্জির।