Share this link via
Or copy link
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
সেটা ১৯৮৫ সাল। কলকাতার এয়ারপোর্ট অশোক হোটেলে ওনাকে প্রথম দেখি। সেই সময় শিলিগুড়ি ও কলকাতায় লতা মঙ্গেশকর ও কিশোর কুমার নাইটের আয়োজন করেছিলেন সুপ্রকাশ গড়গড়ি। শিলিগুড়ির অনুষ্ঠান সেরে ওনারা কলকাতায় এয়ারপোর্ট হোটেলে এসে ওঠেন। আমরা কয়েকজন আগে থেকেই হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করছিলাম। লতাজি গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে এলেন, সঙ্গে ভাই হৃদয় মঙ্গেশকর, বোন উষা মঙ্গেশকর সহ আরও অনেকে ছিলেন। পরনে সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। উনি এসে লবিতে দাঁড়াতেই এগিয়ে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিলাম। ওনার সাথে বেশ কিছু কথা বললাম।
উনি জানালেন, শিলিগুড়ির অনুষ্ঠান খুব ভালো হয়েছে। কলকাতার অনুষ্ঠান সম্পর্কেও উনি খুবই আশা ব্যক্ত করলেন। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, যেন স্বপ্ন দেখছি। যাই হোক, কিছু কথা বলার পর বলেছিলাম, দিদি, আপনার একটা সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ পেলে বাধিত হব। তার উত্তরে উনি হেসে বলেছিলেন, এখন শিলিগুড়ি থেকে এলাম, একটু বিশ্রাম নেব। এখন তো আছি, সুযোগ পেলে নিশ্চই সময় দেব। এইভাবেই প্রথম সাক্ষাৎ।
সেই শুরু, এরপর থেকে উনি যখনই কলকাতায় আসতেন, আমি ওনার হোটেলে হাজির হয়ে যেতাম। ওনাকে প্রণাম করে বলতাম, দিদি, আপ ক্যায়সে হ্যায়? উনিও হেসে জিজ্ঞাসা করতেন, আপ ক্যায়সে হ্যায়? এই সময় ওনার সাথে বেশ কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এর পরের বছর আমি বম্বে গিয়েছিলাম রোভার্স কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট কভার করতে। তারই ফাঁকে ফাঁকে স্টুডিওতে গিয়ে ফিল্মের নানান স্টোরি করতাম। সেবার বান্দ্রার মেহেবুব স্টুডিওতে লতাজির গানের রেকর্ডিংয়ে আমন্ত্রণ পাই সঙ্গীত পরিচালক বাপী লাহিড়ীর কাছ থেকে। সেদিন ওনার পরনে ছিল প্রিয় সাদা শাড়ি, ব্লাউজ, কানে সাদা হিরের দুল, ফরাসি পারফিউমের সুবাস ছড়িয়ে লতাজি স্টুডিওতে ঢুকলেন। ঢুকেই বাঙালি রেকর্ডিস্ট অভি ঠাকুরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।
আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপ ইহা কব আয়ে? ওনাকে সব বললাম। তারপরে বললাম, আপনার রেকর্ডিং আছে শুনে চলে এলাম। হেসে আচ্ছা কিয়া বলে ভিতরে চলে গেলেন। আমরাও ওনাকে অনুসরণ করলাম। বাপী লাহিড়ী, অপরেশ লাহিড়ী, পরিচালক শিবু মিত্র সবাই ছিলেন। আগ হি আগ ছবির একটি গান রেকর্ড করবেন সেদিন লতাজি। গানটার কথা ছিল মিলনেসে পহেলে বিছড় গ্যায়ে হাম, কিউ বনকে বিগড় যায়ে, মিতুয়া ও মিতুয়া এই গানটি বাপী লাহিড়ী ট্র্যাকে গেয়ে রেখেছিলেন। সেই গানটা চালানো হলো। লতাজি খুব মন দিয়ে শুনলেন মুখড়াটা। তারপরে ট্র্যাকে প্রথমে মুখড়াটা গাইলেন, তারপরে অন্তরাটা শুনে সেটা গাইলেন। তারপরে সঞ্চারিটা শুনে সেটা গাইলেন। এইভাবে পুরো গানটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গাইলেন। সেদিন কোনও লাইভ মিউজিসিয়ান ছিল না। পুরো গানটাই উনি ট্র্যাকে গেয়েছিলেন।
রেকর্ডিং হয়ে যাবার পরে আমরা সবাই ভিতরে গেলাম। বাপী লাহিড়ীকে জিজ্ঞেস করলেন ঠিক ছিল কিনা। বাপীদা বললেন, খুব ভালো হয়েছে। সেদিন খুবই ভালো মুডে ছিলেন। আমি বললাম, দিদি মন ভরে গেল শুনে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এরপরে উনি অনেক কথাও বলেন। ওনার সাথে বিভিন্ন সময় নানান বিষয়ে কথা হয়েছিল। সঙ্গীতের বাইরেও নানান বিষয়ের প্রতি ওনার গভীর অনুরাগ ছিল। লতাজি জানিয়েছিলেন, উনি খুব ভালো ছবি তুলতেন, ওনার খুব ফোটোগ্রাফির শখ ছিল। ভালো রান্না করতেন, রান্না করে পরিবারের লোকজন ও প্রিয়জনদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন। ভালো পারফিউমের প্রতি দুর্বলতা ছিল। সর্বদাই বিখ্যাত ফরাসি পারফিউম ব্যবহার করতেন। সাহিত্যচর্চার প্রতিও ছিল ওনার গভীর অনুরাগ।
একবার প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার বাংলা গান শুনলে বোঝাই যায় না আপনি অবাঙালি, এটা কী করে সম্ভব? উত্তরে বলেছিলেন, নানান ভাষা শেখার ওনার মধ্যে আগ্রহ রয়েছে। তবে যেহেতু উনি অনেক বাঙালি শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালকের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাই বাঙালিদের প্রতি ওনার একটা আলাদা টান ছিল। আর সর্বোপরি উনি বাংলা সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়ের প্রায় সব উপন্যাসের মরাঠি অনুবাদ ওনার বাড়িতে ছিল। উনি বলেছিলেন, বাংলা যেহেতু খুব মিষ্টি ভাষা, তাই সেই বাংলা ভাষা ভালো করে জানতে এবং যাতে তিনি ভালো করে বাংলা উচ্চারণ করে বাংলা গান গাইতে পারেন, সেই জন্য কিছুদিন বাংলা ভাষা শিখেছিলেন।
লতাজি বলেছিলেন, তিনি বাংলা বুঝতে পারেন এবং মোটামুটি বাংলা বলতেও পারেন। তাঁর মতে, তাঁর সঙ্গীত জীবনে অনিল বিশ্বাস, শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, রাহুল দেব বর্মন থেকে বাপী লাহিড়ি প্রমুখ সবার অবদান রয়েছে।
এরকম অনেক কথা ভিড় করে আসছে মনে। যাই হোক, আবার মেহবুব স্টুডিওর রেকর্ডিংয়ের স্মৃতিতে ফিরে যাই। রেকর্ডিংয়ের পরে সবার সাথে কথা বলে উনি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। বাপী লাহিড়ীর বাবা অপরেশ লাহিড়ী ওনাকে এগিয়ে দিতে গেলেন। পিছন পিছন আমিও অনুসরণ করলাম। মেহেবুব স্টুডিওর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আমরা সবাই নামলাম। লতাজি ওনার সাদা রঙের প্রিমিয়ার পদ্মিনী ফিয়েট গাড়ির দরজা খুলতেই অপরেশ লাহিড়ী মজা করে বলেছিলেন, লতা, তুম কিউ নেহি এক ফরেন কার খরিদতে হো? শুনে হেসে অপরেশ লাহিড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, কেয়া হোগা দাদা? হামারা সওয়ার ঠিক হোনেসে সব ঠিক হ্যায়, বলে আমাদের সবার দিকে হাত নেড়ে চলে গেলেন।