অমৃত হালদার: রবীন্দ্রনাথ আর নাচ, একে অপরের সঙ্গে কোথাও যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। বঙ্গদেশে নৃত্যের জগতে তাঁর অবদান অস্বীকার করে, এ আর কার সাধ্য!
কলকাতায় সে সময় বাবুদের রাজত্ব। বাবু সংস্কৃতি ভাবাপন্ন মানুষ ক্রমশই দেশীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ছোট নজরে দেখতে শুরু করেন। আর এর ফলস্বরূপ নৈতিকতার অবনমন ঘটেছিল অনেক ক্ষেত্রেই৷ মধ্যবিত্ত অভিজাত সমাজ থেকে সুচারুরূপে নৃত্যকলার সমাদর বর্জিত হল। অবশ্য এ শুধু বাংলারই ছবি নয়, প্রায় গোটা ভারতবর্ষের ছবি ছিল এটাই। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ও প্রচেষ্টার আগে পর্যন্ত শিক্ষিত সমাজে নৃত্যকলার কোনও শ্রদ্ধার আসন ছিল না৷ স্বভাবতই নৃত্যশিল্পের মান ক্রমশই তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
সেই জায়গাতে দাঁড়িয়ে রবি ঠাকুর শিক্ষার অন্যতম বাহনরূপে নৃত্যশিল্পের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে লিখেছিলেন-‘ব্যাপকভাবে এই সংস্কৃতি অনুশীলনের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে দেব, শান্তিনিকেতন আশ্রমে এই আমার অভিপ্রায় ছিল। আমাদের দেশের বিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তকের পরিধির মধ্যে জ্ঞানচর্চার যে সংকীর্ণসীমা নির্দিষ্ট আছে কেবলমাত্র তাই নয়, সকলরকম কারুকার্য, শিল্পকলা, নৃত্যগীতবাদ্য, নাট্যাভিনয় এবং পল্লীহিত সাধনের জন্যে যে সকল শিক্ষা ও চর্চার প্রয়োজন, সমস্তই সংস্কৃতির অন্তর্গত বলে স্বীকার করব।’ তৎকালীন সমাজে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে নৃত্যকলার স্বীকৃতি। এবং এই প্রয়াসই আজকের নৃত্যকলার অনুশীলন ও প্রসারের মূল কারণ।
‘জাভা যাত্রীর পত্র’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-"মানুষের জীবন বিপদ-সম্পদ-সুখ-দুঃখের আবেগে নানাপ্রকার রূপে ধ্বনিতে-স্পর্শে লীলায়িত হয়ে চলেছে, তার সমস্তটা যদি কেবল ধ্বনিতে প্রকাশ করতে হয়, তাহলে সে একটা বিচিত্র সঙ্গীত হয়ে ওঠে, তেমনি আর সমস্ত ছেড়ে দিয়ে সেটাকে কেবলমাত্র যদি গতি দিয়ে প্রকাশ করতে হয়, তাহলে সেটা হয় নাচ৷ ছন্দোময় সুরই হোক আর নৃত্যই হোক তার একটা গতিবেগ আছে, সেই বেগ আমাদের চৈতন্যে রসচাঞ্চল্য সঞ্চার করে তাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে রাখে।" এই চৈতন্যকে গতিশীল করার সাধনায় ছন্দ প্রয়োগের প্রথম প্রয়াসেই যে নৃত্যের উৎস. তাও রবি ঠাকুর সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন। কোথাও তিনি বলেছেন, ‘‘মানুষ তার প্রথম ছন্দের সৃষ্টিকে জাগিয়েছে আপন দেহে। কেননা তার দেহ ছন্দ রচনার উপযোগী। আবার নৃত্যকলার প্রথম ভূমিকা দেহসঞ্চালনে অর্থহীন সুষমায়৷ তাতে শুধুমাত্র ছন্দের আনন্দ।"
অর্থাৎ গুরুদেবের এই ধরনের নান উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে নৃত্যকলার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ও শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। এই কারণে কবিগুরুর কাছে নৃত্যকলা মর্যাদা পেয়েছিল দেহের চলমান শিল্পরূপে৷ তাঁর মনকে অনাবিল আনন্দে আমোদিত করেছে এর ছন্দের আনন্দে। আর সেই কারণে তিনিই আধুনিক ভারতে প্রথম গড়ে তুলেছিলেন শান্তিনিকেতনে নাচের একটি প্রাণবান আন্দোলন।