ছোট থেকেই বাবাকে দেখেছে কখনও কাঁধে বস্তা নিয়ে। কখনও ট্রলি ভ্যান টেনে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে হাঁক পাড়তে । খাতা বই কাগজ বিক্রি আছে? টিন ভাঙা ,লোহা ভাঙা আছে? এভাবেই কালোয়ার ব্যবসার মাধ্যমে চলে সংসারের অন্ন সংস্থান।
সমবয়সীদের দেখে কিশোর বয়সেই খেলাধুলা করে বড় হবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন রামকুমার সাউ। এরই মধ্যে চলে তাঁর লেখাপড়া । স্কুলের গণ্ডি পার করে পরবর্তীতে তিনি কলেজে পড়াশোনা করে স্নাতক হন । ডুমুরজলা স্টেডিয়ামে মাঠের ধারে বসে অন্যদের খেলা, প্রশিক্ষণ দেখা। দেখতে দেখতে কখন যেন সে চোখ দিয়েই খেলা রপ্ত করে ফেলেছেন। দিনের-পর-দিন মাঠের ধারে উৎসাহী কিশোরকে দেখে একদিন এগিয়ে আসেন তৎকালীন বাস্কেটবল খেলোয়াড় সুকুমনি ওঁরাও। হাত ধরে নিয়ে গিয়ে খেলার ছলেই বাস্কেটবল তাঁর হাতে ধরিয়ে দেন এবং বাস্কেট করতে বলেন রামকুমারকে। যেইনা বলা , তেমনি করা। সেটাই রামকুমারের ছিল অগ্নিপরীক্ষা।
১৩ বছরের রামকুমার প্রথম সুযোগেই দূর থেকে বল ফেলল বাস্কেটে। ব্যাস, রামকুমারকে ঘিরে উৎসাহ হয় বাকি প্রশিক্ষণরত খেলোয়াড়দের। এগিয়ে আসেন কোচ সুবীর মণ্ডল। একজন প্রশিক্ষকের কাছে পারফর্মারেরই কদর। তাই লাইনের ধারে বসে থাকা রামকুমারের স্থান হল কোর্টের মধ্যে। নতুন জীবন যাত্রা শুরু রামকুমারের।
তারপর থেকে জেলা ,রাজ্য স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় একের পর এক সাফল্য। এমনকি খুব তাড়াতাড়িই দল পরিচালনার দক্ষতাও সে অর্জন করে ফেলে। বাস্কেট বল দিয়ে খেলা শুরু। এরপর ধাপেধাপে নেট বল, টার্গেট বল খেলায় সে সমানতালে পারদর্শী হয়ে উঠল। এই তিনটি খেলার সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞ খেলোয়াড় এবং প্রশিক্ষকরা রামকুমারকে ময়দানের রত্ন হিসেবে পেলেন। একদিকে খেলায় পারদর্শিতা, পাশাপাশি দলকে পরিচালনা করার দক্ষতা। এই দুইয়ের মেলবন্ধন ক্রমশ এগিয়ে যেতে সাহায্য করল তাঁকে। এরপর রামকুমারের হাত ধরলেন আরও এক প্রশিক্ষক অলোক চট্টোপাধ্য়ায়। রামকুমার জুনিয়র থেকে প্রবেশ করল সিনিয়র গ্রুপে।
বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্ভুক্ত নেতাজি সুভাষ স্টেট গেমে অংশগ্রহণ। ধাপেধাপে জুনিয়র থেকে সিনিয়র, উভয় গ্রুপের কোচিং করাতে শুরু করলো সে। তাঁর প্রশিক্ষণে জেলা, রাজ্য, ও জাতীয় স্তরের টিম একের পর এক সাফল্য অর্জন করতে শুরু করে। এখন রামকুমারের বয়স ২৯।
যখন সে খেলোয়াড় ছিল তখন সে নিজের জার্সি টুকুও কেনার ক্ষমতা ছিল না। আধপেটা খেয়ে চালাত খেলা। সমর্থন ছিল পরিবারের। বাবা অমরনাথ সাউ সংসারের হাজার অভাব-অনটন থাকলেও ছেলেকে বুঝতে দেননি। ছেলেকে পারদর্শী হয়ে ওঠার জন্য মানসিক সমর্থন ও উৎসাহ জুগিয়েছেন তিনি। কোচ এবং অন্যান্যরা খেলার প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অর্থ ও সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। জানালেন কোচ অলোক চট্টোপাধ্য়ায়।
রামকুমার বলেন, জুনিয়র গ্রুপে হাওড়া জেলার বাস্কেট বলের কোচ হিসেবে ২০১০ সাল থেকে কোচিং শুরু করেন। পরবর্তীতে ওয়েস্টবেঙ্গল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনের রেফারি হলেন অল ক্যাটাগরিতে। তারও পরবর্তীতে জাতীয় স্তরে খেলার সুযোগ পেলেন। রিং বলের দল গঠন হলো সিনিয়র গ্রুপ এর। কোচিং এর দায়িত্ব পেলেন। অল ক্যাটাগরিতে জাতীয় স্তরে রেফারি বোর্ডের আহ্বায়কের পদ পেলেন। পশ্চিমবঙ্গের দলকে ফাইনালে পৌঁছে দিতে সক্ষম হলেন।
তার এই সাফল্যে খুশি সকলে। কিন্তু পেট যে বড় বালাই। পেটের তাগিদে রামকুমার সাউ স্বামী বিবেকানন্দ রোডে এখন ভাড়ায় একটি দোকান নিয়ে আলু, পেঁয়াজ, আদা রসুন বিক্রি করছেন। কাসুন্দিয়া অঞ্চলের স্বামী বিবেকানন্দ রোডে পরিবারের পুরানো দোকান। যেটা থেকে তাঁদের রুজিরুটির সংস্থান হতো একসময় । সেই দোকানটি এখনও বর্তমান।
২০২০ সালে লকডাউনের কিছুদিনের মধ্যেই সংসার প্রতিপালনের চিন্তায় বাবা অমরনাথ সাউর ব্রেন স্ট্রোক হয়। তিনি এখন পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত। স্বাভাবিক কারণেই সংসারের দায়িত্ব এখন রামকুমারের কাঁধে। তাই বাধ্য হয়ে সে আলু পেঁয়াজের পসরা সাজিয়ে তা বিক্রি করে।
চারাবাগান অঞ্চলে একটি ভাড়া বাড়িতে বাবা মা ভাইকে নিয়ে বাস। দশ ফুট বাই দশ ফুট একটি ঘরে নিজেদেরই সংকুলান হয় না। কিন্তু রামকুমারের স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রাপ্ত পদক এবং পুরস্কারে ভরে আছে গোটা ঘর। সাজিয়ে রাখার জায়গার অভাবে, দুটি ক্রেটের ভেতরে পদক আর অন্যান্য পুরস্কার জমা করে রাখতে হয়েছে। ঝুলে ভরেছে সেগুলো। ইঁদুরে কাটছে শংসাপত্র।
মা সুশীলা দেবী সাউ চোখের জল মুছতে মুছতে সংসারের দুর্দশার কথা তুলে ধরলেন। ছেলের উত্থান, বড় হয়ে ওঠা ,পারদর্শী হয়ে ওঠা,সংগ্রাম সবটাই দেখেছেন তিনি। মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে চোখের জল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তাঁদের বাস্তব পরিস্থিতির কথা। এতদসত্ত্বেও রামকুমার মাঠ ভোলেননি। আর ভুলতে পারবেনও না। এমনটাই তার অঙ্গীকার। কারণ, ওটাই তার প্রাণ। এখনো তিনি নিয়মিত মাঠে, প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন জুনিয়র থেকে সিনিয়রদের।
পাশাপাশি রামকুমারের আরও আবেদন, পেট চালানোর জন্য একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুক সরকার। তাহলে তিনি ময়দানে সময়টা আরও বেশি দিতে পারবেন। দেশের কাজের জন্য নিজেকে আরও উজাড় করে দিতে সহজ হবে।