একটা পরিবার। তিন তুখোড় প্রজন্ম। বাপ বলে আমাকে দেখ; ঠাকুর্দা বলে বাপের বেটা তুই, আর ছেলে বলে 'আও কাভি হাভেলি পে'। এরকম একই পরিবারের তিন জিনিয়াস; বিশ্বে খুব কম আছে। ঠাকুর পরিবার আর রায় পরিবার; গোটা একটা গ্রহে বাঙালি নামক একটি জাতির অস্তিত্ব টের পাইয়েছে। তবে আজ ঠাকুরদের খানদানি গল্প না। আজ বরং রায় পরিবারের সেই ছেলেটা-কে নিয়ে গল্প হোক; আজ যাঁর মৃত্যুদিন; বং-রা যাকে 'রে' বলে ডাকে। যাঁর চিত্রনাট্য 'চুরি' করার অপবাদ আছে স্পিলবার্গের ঘাড়ে। যাঁর সৃষ্ট ফেলুদা-কে নিয়ে ছবি করার ইচ্ছা হয়তো বা টেরান্টিনোর।
নিউ ওয়েভ মানে যদি বাই-সাইকেল থিফ্ হয়, তাহলে নিউ ওয়েভ মানে অপু ট্রিলজি; গুপি বাঘার গল্পও বটে। কেন হবে না? জোগার-যান্তি করে 'গরিবি বেচা'র আর্ট; একমাত্র রায় পরিবারের ওই ছেলেটা দেখিয়েছিল। যাঁকে সমঝে চলতেন খোদ শাবানা আজমি। যাঁর সঙ্গে কাজ করার শখ ছিল: এমন স্বীকারোক্তি কৌন বনেগা ক্রোড়পতির সেটে করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য যে চরিত্র লিখতেন; আর মহানায়ক আঁকা অরিন্দম মুখার্জিকে 'top'-এ তুলেছিলেন যিনি; তিনি আবার ভূতের রাজা সেজে গোটা একটা ইন্ডাস্ট্রিকে বর দিয়েছিলেন। বাংলা ছবির 'টলিউড'-এ উত্তরণ হয়তো তাঁর বর পেয়েই।
ঋতুপর্ণ ঘোষ সঞ্চালিত ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানিতে এসে ধৃতিমান বলেছিলেন, মানিকবাবু যাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে উনি চিত্রনাট্য হাতে ছেড়ে দিতেন, আর কয়েকজনকে হাতে ধরে শট বোঝাতেন। আমি ভাগ্যবান প্রথম দলে পড়েছিলাম।
অতএব 'মগজাস্ত্র' খাটিয়ে বার করা তাঁর প্রতিটা সৃষ্টি বাঙালির রেকারিং। গড়পার রোড থেকে রজনী সেন রোড; বাঙালিকে হাত ধরে চিনিয়েছেন সেই ছেলে। যিনি জোর গলায় বলেছিলেন: উত্তমবাবু যদি নায়কে অভিনয় না করে; তাহলে আমি ছবিটাই করবো না। কারণ ওকে ছাড়া যে ছবিটাই হবে না।
আবার রবি ঘোষ এবং তপেন চট্টোপাধ্যায়ের জাত চিনিয়েছিলেন সেই মানিকবাবু। আজ থেকে চার দশক আগে তিনি দেখিয়েছিলেন 'রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারিতা' একমাত্র দড়ি ধরে টান মানলেই খানখান করা সম্ভব। ভূতের নেত্য সম্ভব, সেটাও দেখিয়েছিলেন তিনি।
আমাদের রিঙ্কু দি (শর্মিলা টেগোর), অপর্ণা সেন, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, বরুণ চন্দ, হালফিলের কুশল চক্রবর্তী-- এরা সবাই একজনেরই ব্রেক। দুষ্টু লোক, দুধর্ষ মগনলাল, প্রফেসর হাজরা, মনমোহন মিত্র; প্রফেসর শঙ্কু: আরও আরও কত মণি-মুক্তা ভরা আছে তাঁর ঝোলায়।
এনএফডিসি ছাড়া তাঁর ছিল না কোনও প্রডিউসার। তাই একা হাতেই তাঁকে সব করতে হত। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। জীবনের একদম শেষ পর্বে তিনি শয্যাশায়ী অবস্থায় টিভিতে দেখেছিলেন অস্কারের মঞ্চে ঘোষণা হচ্ছে: and the lifetime achievement awards goes to Mr. Satyajit Ray. তাতে অবশ্য তাঁর কিছুই যায় আসেনি; কারণ যিনি শিল্পী, স্রষ্টা-- বাহবা কুড়নো তাঁর কাজ না; থরে-থরে কীর্তি সাজিয়ে একটা জাতিকে চলচ্চিত্রের পড়ুয়া বানানো কাজ। যে কাজ পড়ে; দেখে বাঙালিরা আজও অস্ফূটে বলে ওঠে শাবাস তোপসে; থুরি শাবাস মানিকবাবু।
আরও একবার ফিরে আসুন; অন্তত একবার এই টেকনোলজির যুগে। অন্তত হলিউড দেখুক 'মহারাজা' আপনি কী জিনিস। আর থ্রি ইডিয়টেসর সেই জাঁহাপনা তুস্সি গ্রেট হো-র ঢংয়ে walt disney; paramount pictures; Fox Star-রা বলুক: মহারাজা তোমারে সেলাম। তোমার কাজের স্বীকৃতি দিতে আমরা টাকার ঝুলি নিয়ে এলাম।