শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়: পুরনো দিল্লির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী 'করিমস'-এর জিভে জল আনা রাজকীয় মোগলাই খাবার এখন উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে বাঙালির হাতের নাগালে।
পুরনো দিল্লির জামা মসজিদের কাছে অবস্থিত ১০৯ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী করিমস রেস্তোরাঁর মোগলাই ও নবাবি খাবারের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। বিশ্ব বিখ্যাত টাইমস ম্যাগাজিন এক সমীক্ষায় করিমস-কে এশিয়ার সেরা মোগলাই রেস্তোরাঁর স্বীকৃতি দিয়েছে। উনিশ শতকে মহম্মদ আজিজ নামে এক রন্ধনশিল্পী দিল্লির বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরের ব্যক্তিগত রাঁধুনি ছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফর মহম্মদ আজিজের হাতের তৈরি রাজকীয় মোগলাই খাবারের বিশেষ ভক্ত ছিলেন।
কিন্তু বাহাদুর শাহ জাফরের রাজত্বের পতন হওয়ার পর ইংরেজরা তাঁকে নির্বাসিত করলে তাঁর প্রিয় রাধুনি মহম্মদ আজিজ দিল্লি শহর ছেড়ে তাঁর দেশ মিরাটে চলে যান। মহম্মদ আজিজের পুত্র হাজি করিমউদ্দিন তাঁর বাবার কাছ থেকে রাজকীয় মোগলাই ঘরানার খাবার তৈরি করা শিখেছিলেন। করিমের মাথায় একটা পরিকল্পনা অনেকদিন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, দিল্লিতে গিয়ে এইসব রাজকীয় মোগলাই খাবার আয়ত্বের মধ্যে দামে সর্বসাধারণের জন্য বিক্রি করবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, করিম দিল্লিতে এসে জামা মসজিদের কাছে ১৯১৩ সালে সর্বসাধারণের জন্য আয়ত্বের মধ্যে দামে মোগলাই ঘরানার রাজকীয় খাবার খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে নিজের নামেই করিমস রেস্তোরাঁ চালু করেন। খোলার কিছুদিনের মধ্যেই করিমস-এর জিভে জল আনা সুস্বাদু মোগলাই খাবারগুলি তামাম খাদ্যরসিকদের মন জয় করে ফেলে সহজেই। যত দিন গেছে, ততই করিমস-এর রাজকীয় মোগলাই খাবারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কালের গতিতে ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।
আগে বাঙালি খাদ্যরসিকরা দিল্লি গেলে অনেকেই করিমস-এ গিয়ে সেখানকার বিখ্যাত খাবারগুলি খেয়ে আসতেন। আমি উত্তমপুত্র গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গল্প শুনেছিলাম যে মহানায়ক উত্তমকুমার দিল্লিতে গেলে করিমস-এ গিয়ে ওখানকার মোগলাই খাবার খেতে খুব ভালোবাসতেন। মেমসাহেব ছবির শুটিংয়ে উত্তমকুমারের সাথে দিল্লি গিয়েছিলেন গৌতম। শুটিংয়ের ফাঁকে একদিন গৌতমকে সঙ্গে নিয়ে উত্তমকুমার করিমস-এ গিয়ে খুব তৃপ্তি করে খাওয়াদাওয়া করেছিলেন।
খাদ্যরসিক বাঙালির রাজকীয় মোগলাই খাবারের সন্ধানে আর দিল্লি যেতে হবে না। এখন উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে অরবিন্দ সরণির উপরে দিল্লির বিখ্যাত করিমস-এর শাখা খুলেছে। সুন্দর অন্তঃসজ্জাবিশিষ্ট বাতানুকূল এই রেস্তোরাঁ উপর-নিচ মিলিয়ে একসঙ্গে অনেক মানুষ বসে খেতে পারেন। এখানে অনেক রকমের কাবাব ও গ্রেভি আইটেম আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পদের কথা বলব।
কাবাবের মধ্যে চিকেনের দিল পসন্দ শিক কাবাব (২ পিস ২০০ টাকা, ৪ পিস ৩৫০ টাকা ), মটন বড়া কাবাব (৪ পিস ৩৯০ টাকা) ও চিকেন টাংরি কাবাব (৪ পিস ৩৮০ টাকা)। এই তিনটি কাবাবই স্বাদেগন্ধে অতুলনীয়। তবে এখানকার গ্রেভি আইটেমের স্বাদ কাবাবকে ছাপিয়ে যায়। করিমস-এ এলে যে তিনটি ডিশ অবশ্যই চেখে দেখবেন, সেগুলি হল এখানকার খামিরি রুটি (৩০ টাকা) সহযোগে মাটন স্টু বা দিল বাহার দো পিয়াজা ( ৪ পিস ৪৭০ টাকা) অনবদ্য। এই পদটিতে ৪ পিস মাটন থাকে দুই বা তিনজনে ভাগ করে খাওয়া যায়। সুজি, কলা, কাজুবাদাম বাটা, ময়দা, মাখন দিয়ে তৈরি সুস্বাদু মিষ্টি মিষ্টি রগনি নান (৯০ টাকা) সহযোগে এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত পদ চিকেন জাহাঙ্গিরির (৪৯০ টাকা) স্বর্গীয় স্বাদ হৃদয় জুড়িয়ে দেবে। চার পিস চিকেন থাকে দুজন থেকে তিনজন ভাগ করে খেতে পারেন। এছাড়া মাটন কিমা ও চার পিস মাটন দিয়ে তৈরি সুস্বাদু মাটন রারা (৪৮০ টাকা) এক কথায় অনবদ্য। আর মশলাদার মাটন নিহারি (৪৮০ টাকা) ও স্বাদেগন্ধে অতুলনীয় একটি পদ। রারা ও নিহারি দু'টি পদই খামিরি রুটি সহযোগে জমে যাবে। দুই থেকে তিনজন দু'টি পদই ভাগ করে খেতে পারবেন। বিরিয়ানিপ্রেমীরা মাটনের গোস্ত বিরিয়ানি বাহিস্তি (৪৮০ টাকা) চেখে দেখতে পারেন। শেষ পাতে শাহী টুকরা (৯০ টাকা) মন ভরিয়ে দেবে। সবার শেষে এখানকার অনবদ্য মকটেল পান মজিতো অবশ্যই পান করবেন, শরীর ও মন ভরিয়ে দেবে। এখানকার সুস্বাদু খাবারের সাথে কর্মীদের ব্যবহার ও পরিবেশ খুবই ভালো।