সৌমেন সুর: কবি একসময় কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। কিছুদিন অধ্যাপনা করার পর এ চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর তাঁর জন্মস্থান বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে নিযুক্ত হন। কর্মযজ্ঞ যথাযথভাবে চলছিল, কিন্তু আকাশের কোনে কালো মেঘ দেখা দিলো। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু দেশভাগের ফলে তিনি ও তাঁর পরিবার সবকিছু ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন।
কলকাতায় এসে অধ্যাপনার চাকরি খুঁজতে থাকেন, তখন খড়্গপুরের কলেজে অধ্যাপক দরকার--সে বিষয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। হিমাংশু ভূষন সরকার পূর্ববঙ্গ থেকে খড়্গপুরে এসে একটা কলেজে তৈরি করেন। এই কলেজেই জীবনানন্দ অধ্যপক হিসেবে নির্বাচিত হন। সালটা ১৯৪৮। সেই সময়ে কবির অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ--মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির। এই সময় খড়্গপুর কলেজে একমাত্র ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন সরোজ কুমার ভট্টাচার্য। তাঁর একার দ্বারা এই বিভাগ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। ১৯৫০ সালে কবি নির্বাচিত হন এই বিভাগে। কলকাতা থেকে খড়্গপুরের দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। খড়্গপুরকে ভালোবেসে ফেলেন কবি। তিনি ছিলেন নির্জনতাপ্রিয় ও স্বল্পভাষী। পরিবেশের সঙ্গে তিনি মানিয়ে নিয়ে ছিলেন সুন্দরভাবে। খড়্গপুর রেল কোয়াটার্স, রেল কারখানা, লাল মাটির পথ, পুকুর, ধানক্ষেত এসব দেখে কবি মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন।
শোনা যায়, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের জন্য তাঁর মন উতলা হয়ে যেতো। প্রতি সপ্তাহের শেষে তিনি কলকাতায় চলে আসতেন। অসুস্থ স্ত্রীর জন্য একদিন তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এইভাবে চলতে চলতে কলেজের চাকরীতে অনিয়ম এসে যায়। একদিন তিনি বাধ্য হয়ে চাকরীতে ইস্তফা দেন। কবির জন্মের একশো বছর পুর্তিতে খড়্গপুর কলেজের বাংলা বিভাগের সামনে তাঁর আবক্ষ মুর্তি বসানো হয়। কথা হলো, কবি জীবন সংগ্রামে ছিলেন দায়িত্ববান মানুষ। সংসার ও কাব্য সমানভাবে চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ভাগ্যের লিখনে মানুষের Destiny বিধাতা লিখে রাখেন আগেই। কবির জীবনেও বুঝি তাই ছিল। যাই হোক খড়্গপুর কলেজে তাঁর কার্যকাল ছিল মাত্র পাঁচমাস বারো দিন। [তথ্যঋণ--অর্নব মিত্র]
সৌমেন সুরঃ এগারো বছর ন' মাস বয়সে ১৮৭৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) উপনয়ন হয়। তাঁর পরিবার ব্রাক্ষ্ম হলেও আদি ব্রাক্ষ্মসমাজে উপনয়নের রীতি আছে। যথাসময়ে রবীন্দ্রনাথের পৈতে হওয়ায় তাঁকে নেড়া হতে হয়। এই অবস্থায় স্কুলে গেলে, বিশেষ করে ফিরিঙ্গি স্কুলে-তারা ক্ষেপাতে ছাড়বে না। স্কুল সে যাবে না-মনে মনে এই পণ করলো। ঠিক এইসময় পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (Debendranath Tagore) রবির অবস্থা বুঝে তাঁকে হিমালয় ভ্রমণে নিয়ে যাবেন ভাবছেন।
এই প্রস্তাবে রবি কি রাজী? রবি এই প্রস্তাব শুনে খুশীতে ফেটে পড়ে। চোখ বুজে রাজী হয়ে যায়। পিতার সঙ্গে এই প্রথম ভ্রমন। চারদেওয়ালকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতির মুক্ত পরিবেশে নিজেকে যুক্ত করতে চলেছে। স্কুল আর বাড়ির চৌহদ্দির মধ্য়ে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন রবি। যাই হোক বীরভূম জেলায় বোলপুর গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েক বিঘে জমি কিনেছিলেন। সেই জমির ওপর একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। বাড়িটার নাম দিয়েছিলেন 'শান্তিনিকেতন'। হিমালয় যাবার আগে এখানে কয়েক দিনের জন্য় অবস্থান হলো। চারদিকে ধূ ধূ প্রান্তরে সবুজ শ্য়ামলীমার নৈসর্গিক দৃশ্য় রবিকে বিমোহিত করে দেয়। দূরে তালবনের সারি। আঁকাবাকা লাল মাটির মেঠো পথ। রবির খুব ভাল লাগতে থাকে জায়গাটা। এক একাই ঘুরতে থাকেন।
মুক্তির আনন্দে সে বিহ্বল। কলকাতার লোকজনের কোলাহল থেকে নিঃসীম শান্তিতে এই শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের ভীষন ভাল লেগে গেল। এতদিন পিতা ছিলেন দূরের মানুষ। এখন বরফে ঢাকা পাহাড় তাঁকে অন্য় জগতে নিয়ে যায়। পিতার সাহচর্যে আজ রবীন্দ্রনাথ যেন প্রকৃতি প্রেমিক। ডালহৌসির দিগন্ত বিস্মৃত মোহময় দৃশ্য়ের মধ্য়ে পিতা তাকে একটি একটি করে নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে ডুবে যায়। পিতার কাছে রোজ সকালে জ্য়োর্তিবিদ্য়া অঙ্ক, ইতিহাস, সংস্কৃত শিখতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে এক নতুন দিগন্তের পথ খুলে যায়। পিতার কাছে অনেক কিছু শিখে জ্য়োতিষ বিদ্য়ার ইংরেজী বই থেকে বাংলা অনুবাদ কোরে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। লেখাটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ছাপা হয়। সম্ভবত এটিই তার প্রথম রচনা। মুক্তির আলোয় রবীন্দ্রনাথ মুক্ত হয়ে বিভিন্ন রচনার জন্য় তৈরী হন। পরবর্তীকালে আমরা সমৃদ্ধ হই তাঁর রচনাবলীতে।
সৌমেন সুরঃ যে কোনো বিষয়ে শেষের যেমন শেষ আছে, তেমনি আরম্ভেরও আরম্ভ আছে, ড: সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত মহাশয় সে ব্য়াপারটা তলিয়ে দেখেন নি। বিশ্ববিদ্য়ালয়ের নথিপত্র থেকে আংশিক তথ্য়াহরন করেই তিনি আশুতোষের বিরুদ্ধে পাঁক ছেটাবার ব্য়বস্থা করে ফেললেন। ড: সেনগুপ্ত দুটো তারিখের ওপর নির্ভর করে তাঁর যুক্তি খাড়া করেছেন। ১৩ নভেম্বর ও ১৫ নভেম্বর হলো তাঁর প্রধান অস্ত্র। তবে অনেকেরই একথা জানা নেই যে, কোনো ব্য়াপারে পূর্ব প্রস্তুতি না নিয়ে আঁটঘাট না বেঁধে হঠাৎ সিদ্ধান্ত করা আশুতোষের প্রকৃতি বিরুদ্ধ।
কবিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মান জ্ঞাপনের কথা বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলেন। এই ভাবনা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর লর্ড কারমাইকেলের মাধ্যমে চান্সেলর লর্ড হার্ডিঞ্জের সম্মতি আদায়ের যে চেষ্টা করেছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ ৫ই অক্টোবর ১৯১৩ দার্জিলিং শৈলাবাস থেকে আশুতোষকে লেখা কারমাইকেলের চিঠি। অবশেষে হার্ডিঞ্জের অনুমতি পাওয়া গেল নোবেল প্রাইজ ঘোষণার ১৭ দিন আগে।
বিশ্ববিদ্যালয় তখন সরকারি সংস্থা। ভাইসরয়, গভর্নর, হাইকোর্টের বিচারপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক এক বিশাল মাপের মানুষ জড়ো হলেন। রবীন্দ্রনাথ এই দেশি-বিদেশী বিদগ্ধ মানুষের কাছে একটু আরষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। যাইহোক এই সবার পাঁচদিন পর কবি সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে চিঠিতে লেখেন, 'আমার কাব্যলক্ষ্মীর মাথায় এতদিন যে ঘুমটা ছিল সে ভালই ছিল- কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সেটাকে সভাস্থলে উন্মোচন করিয়া যখন তাহার মাথায় পাগড়ি পরাইয়া দিবে, তখন সেটা কিছুতেই মানাইবে না।' এই চিঠি নোবেল পুরস্কার ঘোষণার ১১ দিন আগের লেখা।
তথ্য়ঋণ- দীনেশ চন্দ্র সিংহ
জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রাণকে খুঁজে পান নরম ধানের গন্ধে, ঘ্রাণে, হাঁসের পালকে, চাঁদা সরপুটিদের সুবাসে, কিশোরীর চাল ধোঁয়া ভিজে হাতে, লাল লাল বটফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতায়। বিষন্ন চড়াই, শ্যামার গান, কাকের শব্দ, কুকুরের উদাস ডাক, খঞ্জনার নাচ, গাঙশালিখের ঝাঁক, ধবল বক, লক্ষ্মী পেঁচা, শঙ্খ চিল, আম কাঠাঁলের গাছ, কীর্তন-ভাসান-রুপকথা-যাত্রা-পাঁচালীর নিবিড় ছন্দ। এমনি আরও কত অন্তরঙ্গ ছবি তাঁর কবিতার বিষয়, প্রিয় অনুষঙ্গ।
তাঁর কবিতায় বিষন্নতা আছে, আছে স্বপ্নালোকের অভিসার বাসনা। কিন্তু স্বপ্নাভিসারই তাঁর কাব্যের শেষ কথা নয়। তাঁর শেষ পর্বের অনেক কবিতায় কঠোর বাস্তবতার স্পর্শ রয়েছে। সমাজের নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত কবিমনে ঢেউ তোলে। বাস্তবের নানা জটিলতা ঘাত-প্রতিঘাতের নানা তরঙ্গে তিনিও বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। তবে তা কখনই সোচ্চার নয়। কবিতায় চির যৌবনের জয় দৃপ্ত ঘোষণা নেই, নেই অগ্নিবীনার সুর। তিনি সমাজের রুক্ষতায়, মানুষের আচরনে ব্যথা পান। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হতাশার ছবিও উঁকি মারে। এ যুগে কোথাও কোনও আলো, কোনও ক্লান্তিময় আলো চোখের সমুখে নেই যাত্রিকের।
তবে হতাশাই শেষ কথা নয়। এরপরেও আছে আশার আলো। বিশ্বাসের ছবি। জীবনানন্দের কবিতাতে শুনি সেই আশ্বাসের সুর। তাঁর লেখায় ধ্বনিত হয় গভীর প্রত্যয়ের ঝরনা। জীবনানন্দ গতানুগতিক প্রবাহের কবি নয়। তিনি হলেন বিরল কবিদের একজন। তাঁর কবিতায় ভাষারীতি হলো বিশিষ্ট। তাঁর ছন্দ, শব্দ ব্যবহার আমাদের অভিভূত করে। প্রতীক ও চিত্রকল্প ব্যবহারে তিনি অনন্য। জীবনানন্দ দাশের প্রধান ও প্রথম পরিচয় তিনি কবি। কবিতার সাধনাতেই তিনি অধিকাংশ সময় মগ্ন থেকেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা সবার জন্য নয়, কবিতা রসিকদের জন্যই তাঁর কবিতা।
সৌমেন সুর: বাংলা কবিতার দেশ। আধুনিক কালে বাংলার শ্যামল স্নিগ্ধ নরম মাটিতে জন্ম নিলেন সর্বকালের সর্বদেশের আর এক উজ্জ্বল বিস্ময়। তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ, আকাশের মতোই তিনি বিরাট, নদীর মতোই তিনি গভীর, অনন্ত। নিঃসন্দেহে তিনি বরেণ্য কবি। এরপর বাংলা কবিতার প্রবাহে এক নতুন ঢেউ উঠলো। সবাই শুনলেন নতুন এক কন্ঠস্বর। বিস্ময়ের আর সীমা রইল না। হাজার বছর ধরে পথহাটা ক্লান্ত প্রাণ এক কবি। চোখে তার শতাব্দীর নীল অন্ধকার। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই সেই কবি ব্য়ক্তিত্ব হয়ে উঠলো সকলের একান্ত প্রিয়। সেই কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্র উত্তর যুগের এক ব্য়তিক্রমী কবি।
জীবনানন্দের কবিতার বিষয়-বিষন্ন প্রকৃতি, ইতিহাসের ধূসর পটভূমি, আত্মমগ্ন সৌন্দর্য চেতনা, রোমান্টিক মনন, মানব মনের জটিল রহস্যময়তার স্বরূপ উপলব্ধি। তাঁর কাব্য়ে শুনতে পাই চিরন্তন বাংলার প্রাণের স্পন্দন। এমন নিবিড় মমতা দিয়ে আর কোনও কবি বাংলার প্রাণ প্রতিমা রচনা করেননি। বাংলার কত খাল-বিল, মাঠ-প্রান্তর, ঘাস-লতাপাতা, পাখি তাঁর কবিতায় অমূল্য় সম্পদ হয়ে উঠেছে।
এই বাংলার সঙ্গেই কবির জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। এখানেই তাঁর আশা আকাঙ্খা, ব্য়র্থতা-সফলতা। এর আকর্ষণ দুর্নিবার। জন্ম-জন্মান্তরেও এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। বারবার তিনি ফিরে আসতে চান, "ধানসিড়িটির তীরে-এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়/হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব, এ কাঁঠাল ছায়ায়।" (চলবে)
সৌমেন সুর: কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশকালের প্রেক্ষিতে মানুষের অস্তিত্ব মানবতার ধর্মকে খুঁজেছিলেন। চল্লিশের দশকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রগতিশীল আবহে কবিতা লিখলেও এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী কবিদের সঙ্গে সখ্য থাকলেও ওই ধারার কবিতাকে তিনি নিষপ্রাণ ও যান্ত্রিক মনে করতেন। কেন না সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যে রুপ তাঁর ধারনায় ছিল, এসব কবিতায় সে স্ফুলিঙ্গ তিনি খুঁজে পাননি। যে মতবাদ, যে রাজনীতি শোষিত মানুষকে আলো দেখায়, দলিল বঞ্চিত নিঃস্ব নির্যাতিতের কাঁধে হাত রাখে তিনি আজীবন তার পাশে ছিলেন।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সব অর্থে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখক ছিলেন। তাঁর সমস্ত লেখালেখি ছিল অবাণিজ্যিক ছোট কাগজে। পরিচয়,অরনী, অগ্রনী প্রভৃতি পত্রিকা ও পরে বহু লিটল ম্যাগাজিনে তিনি অজস্র বিখ্যাত কবিতা লিখেছেন। কবি অরুণ মিত্র, বিমল চন্দ্র ঘোষ তাঁর কবিতায় প্রশংসা করেছেন। প্রশয়ও পেয়েছেন। পঞ্চাশ ষাটের বহু কবি তাঁর বন্ধু ছিলেন। তারপর সত্তরের তরুণ কবিরা তাঁর কবিতায় প্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি তাদের বুকের গভীরে জায়গা দিলেন। ব্যাগ ভর্তি করে তরুণ কবিদের বই নিয়ে মাঠেঘাটে জনসভায় বিক্রি করতেন, প্রচার করতেন। কবি লিখেছেন, আমি তোদের বুকের মধ্যে ঘুমোতে চাই/মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে নয়/আমি তোদের বুকের মধ্যে জেগে উঠতে চাই/ তোদের মুখের কথা শুনতে নয়। তরুণ কবিরাও পরম ভালবাসায় তাদের প্রিয় কবি বীরেনদা কে বুকের গভীরে ধারন করেছিল।
সৌমেন সুর: উনিশ শতকের মহিলা কবি ও সাহিত্যিক হিসাবে যে স্বীকৃতি তাঁদের প্রাপ্য ছিল, তা তারা পাননি। তৎকালিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা ছিলেন পুরুষদের হাতের পুতুল। শিক্ষা,অধিকার, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা,কিছুই তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি। উনিশ শতকে নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষা নিয়ে যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়েছিল, তারই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বাংলার নারীরা আপন ভাগ্য জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই সেই সময়ে মহিলা কবি সাহিত্যিকদের কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে ব্যক্তিগত প্রেম, ভালোবাসা, প্রতিবাদ বিষাদ, শোক, আত্মকথা, আশা নিরাশা, প্রার্থনা, সুখ-দুঃখ ও পরাধীনতার মুক্তির বার্তা।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি কামিনী রায়। তিনি যে একদিন কবি হবেন, শৈশবেই তাঁর প্রতিভা দেখে বোঝা গিয়েছিল। মাত্র ৮ বছর বয়সে কবি লেখা শুরু করেন এবং ১৫ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আলো ও ছায়া' প্রকাশিত হয়। পরাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার শৃংখলামোচনে কবি নিজেকে উৎসর্গ করে লিখেছেন-'মা আমার' কবিতায় - 'সেই দিন ও চরনে ডালিদিনু এ জীবন / হাসি-অশ্রু সেইদিন করিয়াছে বির্সজন / হাসিবার কাঁদিবার অবসর নাহি আর / দুঃখিনী জনমভূমি মা আমার মা আমার।'
কবি জানতেন, আত্মশক্তি মানুষের আসল শক্তি। আত্মবিশ্বাস মানুষের মনে শক্তি যোগায়। তাই তিনি মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস জাগাতে লিখলেন-'হাত পা তো সকলেরই আছে / সকলের জোর আছে গায় / মাথা পারে সব খাটাতে / কে কাহার অনুগ্রহ চায়।'
জায়গার অভাবে অনেক কথা ছিল-বলতে পারলাম না। তবে শুধু কামিনী রায় নয়, নীরজাসুন্দরী দেবী, তরু দত্ত, স্বর্নকুমারী দেবী আরো অনেকেই উনিশ শতকে যোগ্য সম্মান পাননি।
সৌমেন সুর: পৃথিবীর মধ্যে যদি কয়েকজন বরণীয় কবিদের (poets) নাম করতে হয়, তাহলে তাঁদের মধ্যে অন্যতম কীটস (John Keats)। কীটসের রোম্যান্টিক কবিতার তুলনা হয় না। আজ কবি কীটসকে নিয়ে আলোচনা। তাঁর কবিতার কতকগুলি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট আছে, যার ফলে তাঁর কবিতার ঘ্রান হয়ে ওঠে বাণীস্বরূপ। কীটস তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিতে লিখেছেন, 'I have loved the principle of beauty in all things' কীটসের কবিতাগুলি যেন সৌন্দর্য চেতনার প্রামাণ্য দলিল। প্রকৃতিতে, প্রেমে, শিল্পে, স্থাপত্যে, সর্বত্রই তিনি উপলব্ধি করেছেন সৌন্দর্য চেতনাকে। তিনি অনুভব করেছেন যে, অন্যান্য প্রাণীদের মতো মানুষও মরণশীল, কিন্তু সৌন্দর্যের মৃত্যু নেই, 'beauty is truth, truth is beauty' কীটসের কবিতায় প্রকৃতি প্রীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রকৃতির গন্ধস্পর্শময় রূপ কবি প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে। প্রকৃতির অনুষঙ্গে তিনি আত্মদর্শন উপলব্ধি করেছেন। 'ওড অন মেলানকলি' (Ode on Melancholy) কবিতায় ঘন মেঘের সঙ্গে বিষন্নতা তুলনীয় হয়ে ওঠে। কবি উল্লেখ করেন সেই সমস্ত ফুলের কথা যাদের ভাবনায় মন খারোপের ঘ্রান জড়িয়ে আছে। অপূর্ব বর্ণনা।
কীটসের কবিতায় অনুভূতি গ্রাহ্যতা গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়। কবির মতে সৌন্দর্য উপভোগ ও প্রকাশের জন্য পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সমান অংশগ্রহণ জরুরি। তাঁর ভাবনা প্রকাশ পায় 'ওড টু এ নাইট অ্যাঞ্জেল' কবিতার এই লাইনগুলোতে, 'but when the melancholy fit shall fall/ sudden from heaven like a weeping cloud/ that foster the droop-headed flowers all/and hides the green hill in an April Shroud.' কবি কীটস চিরন্তন। যতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তাঁর কবিতা মানুষের হৃদয়ে লীন হয়ে থাকবে।