
সৌমেন সুরঃ মারা যাওয়া পেনশন প্রাপকের বদলি লোক কিংবা গ্রামের অন্য কেউ প্রকিস দিয়ে পেনশন তুলছে। সুতরাং হার্শেল সাহেব তার হুগলি বিদ্যেটা কাজে লাগালেন। তিনি ঘোষণা করলেন, পেনশন প্রাপকের সাক্ষর ছাড়াও আঙুলের ছাপ দিতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে কাজ শুরু হবার পর ফল হাতেনাতে পাওয়া গেল। পেনশন প্রাপকদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে আরম্ভ করলো। এই ঘটনায় হার্শেল সাহেব উৎসাহিত হয়ে দলিল রেজিস্টেশনের ক্ষেত্রেও আঙুলের ছাপ নিতে আরম্ভ করলেন, যাতে বিক্রেতা অস্বীকার করতে না পারে এবং ক্রেতাও বিক্রেতার সই জাল করে জমি আত্মসাৎ করতে না পারে। কিন্তু হার্শেলের দুর্ভাগ্য কয়েদিদের শনাক্তকরনের ক্ষেত্রে তিনি এই পদ্ধতি প্রয়োগ সরকারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেন। তা না হলে সেইসময় ১৮৬০/৬২- তেই ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কার স্বীকৃত হতে পারতো।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং পূর্ণাঙ্গ হাতের ছাপ নিয়ে নানান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও প্রকৃত ফিঙ্গারপ্রিন্টের তদন্তের আনুষ্ঠানিক সূচনা কলকাতা থেকেই। বিখ্যাত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো অধিকর্তা বিদ্যুৎ নাগের একক প্রচেষ্টায় আজ প্রমণিত, কলকাতাই ফিঙ্গারপ্রিন্টের তদন্তের উৎস। এই প্রসঙ্গে তাঁর বর্ণনায় পাই, কর্মব্যস্ত একজন ইংরেজ আই সি অফিসার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি পুলিস ইনসপেক্টার জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব নিয়েই তিনি অপরাধী শনাক্তকরনে উঠেপড়ে লেগে যান।
বিজ্ঞানী গ্যালটনের প্রমাণিত সূ্ত্র ধরে হেনরি ফিঙ্গারপ্রিন্টকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিলেন শনাক্তকরনের ব্যাপারে। ফ্যান্সের দেহাঙ্গমিতির সংশোধিত রুপটি হেনরির চেষ্টায় বাংলা তথা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রশংসা পায়। ১৮৯৬ সালে পুলিসের সার্কুলারে আঙুলের ছাপকে প্রধান করে। হেনরি অবশেষে স্বীকার করেন, 'অঙ্গলিছাপ' সূ্ত্রটি একশো শতাংশ নির্ভুল রুপে মত দেন দুজন বাঙালি সাব ইন্সপেক্টর। একজন আজিজুল হক, অন্যজন হেমচন্দ্র বসু। তবে সূ্ত্রটি আজও হেনরি পদ্ধতি নামে সারা বিশ্বে প্রচলিত। ১৮৯৭ সালে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যাপারে অনুমোদন পাওয়ার পর ভারতবর্ষে বাংলার মূখ্যকার্যালয় রাইটার্স বিল্ডিং-য়ে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। (সমাপ্ত) তথ্যঋণ/ বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধায়
সৌমেন সুর: ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রথম সূ্ত্রপাত ১৮৫৮ সালে একটু ভিন্ন আকারে দেখা গিয়েছিল। উইলিয়াম হার্শেল তখন হুগলির কালেকটর ডাকাবুকো আইসিএস। মাত্র ২০ টাকার চুক্তিপত্র করে ঘুটিং সরবরাহ করার জন্য রাজ্যধর কোনাইকে অর্ডার দিলেন। কিন্তু অনেক সময় সরবরাহকারীরা চুক্তিপত্র ও সই অস্বীকার করে বিপদে ফেলেন। তাই সতর্ক হার্শেল সাহেব ঠিক করলেন, রাজ্যধরকে একটা প্রস্তাব দেওয়া যাক যে, তাঁকে চুক্তিপত্রর উপর হাতের ছাপ দিতে হবে। অফিসে স্ট্যাম্প দেওয়ার জন্য ভুসো কালির ব্যবহার করা হতো। তাই হাতে কালি মাখিয়ে রাজ্যধরের হাতের ছাপটা চুক্তিপত্রের উপর নেওয়া হল। রাজ্যধরও মজা পেলো সাহেবের এই অদ্ভুত প্রস্তাবে। কিন্তু এই হাতের ছাপটা আজকের বিশ্ব শনাক্তকরনের চূড়ান্ত পন্থা হিসেবে আঙুলের ছাপ ব্যবহারের গোড়াপত্তন করলো। হার্শেল সাহেব আরও অনেকের হাত ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতেন। তবে সবাই এটাকে হার্শেল সাহেবের পাগলামি বলে ধরে নিয়েই হাতের ছাপ দিতেন।
বিষয়টি যে পাগলামি ছিল না, তার প্রমাণ হাতে হাতে পেয়ে গেলেন হার্শেল সাহেব। দু'বছর পর নদীয়া জেলার ডিস্ট্রিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি সবে বদলি হয়েছেন। দেখলেন, মাসের প্রথম দিকে সিপাহি বিদ্রোহ যারা সরকারকে সাহায্য করেছিল, সেসব পেনশন প্রাপকের সংখ্যা বেশ ভালই। যদিও তারা সকলেই বেশ বয়স্ক, তবুও সংখ্যাটা কিছুতেই কমছে না। কিছুদিন পর তিনি বুঝতে পারলেন, মারা যাওয়া পেনশন প্রাপকের বদলি লোক প্রক্সি দিয়ে পেনশন তুলছে হাসিমুখে।
তথ্যঋণ: বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধায়
সৌমেন সুর: ১৮৯৭ সালের জানুয়ারী মাস, রাইটার্স বিল্ডিং তখন ইংরেজদের হেড অফিস। এখানেই প্রথম ফিংগারপ্রিন্টের কার্যালয় স্থাপিত হয়। তবে এখনও পর্যন্ত এফবিআই-এর এডগার নূভারের কর্মশালাটি পৃথিবীর বৃহত্তম সংগ্রহশালা। এই সংস্থার বিপুল ফিংগারপ্রিন্ট সংগ্রহের জন্য আমেরিকায় আজও কোনও অবাঞ্ছিত ব্যক্তি সরকারি চাকরি, মর্যাদাপূর্ন পদ, গুরুত্বপূ্র্ন পদে ঢুকতে পারে না। এভাবেই ওরা নিজেদের দেশকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ফিংগারপ্রিন্টকে বেছে নিয়েছে।
ফিংগারপ্রিন্ট নিয়ে নানা ঘটনা আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্ধমানের নিরুদ্দেশ রাজকুমার প্রতাপচাঁদের পরিচয় দিয়ে এক সন্ন্যাসী ১৪ বছর পরে ফিরে আসে। এই ঘটনা নিয়ো হুগলি আদালতে মামলা হয়। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের বড়দা সঞ্জীবচন্দ্রের বর্ণনায় দেখি-- রাজার এক দুষ্ট আত্মীয় নিজের ছেলেকে বৃদ্ধ রাজার দত্তকরুপে গ্রহণ করেছে বলে নিজে বর্ধমান জমিদারির পুরোটাই কৌশলে হস্তগত করে।
এর বহুদিন পর রাজকুমার সন্ন্যাসীরুপে ফিরে এলে বর্ধমানের জমিদার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাহায্যে তাঁকে জেলে পাঠায়। শেষ জীবনটা সন্ন্যাসীকে খুব দুখ কষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়। সেইসময় ফিংগারপ্রিন্ট সংগ্রহ ও শনাক্তকরন পদ্ধতি চালু থাকলে রাজকুমারকে এভাবে কেউ বিতাড়িত করতে পারতে না। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশই এখন নিজস্ব ব্যক্তিগত পরিচয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ফিংগারপ্রিন্টের সাহায্য গ্রহণ করে। এটা অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার যে, আজ থেকে একশো বছর আগে মহাকরনের একটি অংশ যে গবেষনা ও কর্মদ্যোগের সূচনা হয়েছিল, আজ তা বৃহৎ কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীর অপরাধ বিজ্ঞানীরা এই বিজ্ঞানের উদ্ভাবনের জন্য ভারত তথা বাংলার কাছে ঋণ স্বীকার করেন।
তথ্যঋন: বিশ্বজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়