সৌমেন সুর: বরাবরই কাজী নজরুল (Kazi Nazrul Islam) একটু হই হুল্লোড় করে মেতে থাকতে ভালোবাসেন। আর পকেটে টাকা এলে তো ব্যস, কতক্ষণে সেটা খরচ হবে এই ভাবনায় ফুর্তি করে কাটাতেন তিনি। একদিন বন্ধু বান্ধব নিয়ে খেলার মাঠে খেলা দেখতে এসেছেন। সেদিন মোহনবাগান ৭-১ গোলে জেতে বিদেশী দলকে হারিয়ে। খেলা শেষে নজরুল বলেন, 'চলো চন্দননগর যাই।' সবাই তখন একপায়ে রাজী। দলকে তাতিয়ে চাঙ্গা করে রাখছেন নজরুল। পকেটে কিছু টাকা। 'সত্তগাত'-এর অফিস থেকে কিছু টাকা পেয়েছেন। সেই টাকায় চলতে থাকছে আনন্দ আমেজ।
হঠাৎ নজরুল বললেন, 'চলো ঢাকায় যাই।' কিন্তু যাবে কি করে! কারো পকেটে একটা টাকাও নেই। নজরুল বললেন, 'ঘাবড়াও মত্। ম্যয় হু না। যাবো যখন ঠিক করেছি যাবই। সেই রাতে চনন্দনগর থেকে শিয়ালদা স্টেশনে সবাই আসে। এবার ঢাকায় যেতে গেলে তো টিকিট কাটতে হবে। কিন্তু এতজনের টিকিট কাটার মত টাকা নেই নজরুলের কাছে।
নজরুল একটা ফন্দি আটে। সোজা স্টেশন মাষ্টারের ঘরে ঢুকে পড়েন। ঐ ঘরে ঢোকবার আগে কয়েকজন টিকিট পরীক্ষক তাকে চিনতে পেরে ভক্তিভরে নমষ্কার জানায়। জানাবেই না কেন! নজরুলের পরনে সম্পূর্ন গৈরিক বসন। একেবারে সন্ন্যাসীর মতো। যাই হোক, নজরুল স্টেশন মাষ্টারকে বললেন, 'দেখুন আমরা ঢাকা যাবো। কিন্তু যা টাকা আছে সব টিকিটের টাকা আমাদের টাকা নেই। এক কাজ করুন, আমাদের আপনি ভেন্ডারের ব্যবস্থা করে দিন। আমরা ওতেই যাবো।'
যথারীতি ভেন্ডারের ব্যবস্থা হলো। সবাই তাতে চড়ে বসলেন। হাসিঠাট্টা গানবাজনা করে পৌঁছানো হলো গোয়ালন্দ স্টেশনে। এবার জাহাজে চড়ে ঢাকা যেতে হবে। নজরুল একটা টিকিট আর মাদুর কিনে সবাইকে নিয়ে জাহাজে উঠে বসলেন। মাদুর বিছিয়ে তারা বসলেন। শুরু হলো গান গজল। গানের টানে মানুষ সব ভিড় করতে লাগলো নজরুলের কাছে। জাহাজের কাপ্টেন থেকে টিকিট পরীক্ষক নজরুলের গানে মজে গেল। টিকিট চাওয়া ভুলে গেল। পৌঁছে যাওয়া হলো ঢাকায়। এবার থাকবে কোথায়!
অবশেষে বুদ্ধদেব বসু তার আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। তখন জাতিভেদ প্রথা আর ব্যর্থ কৌলিন্যের বড়াই সমাজে বর্তমান। ঠিক করা হল একটা ব্যবস্থা। নজরুলের গেরুয়া বসন, ঝাঁকড়া চুল আর টানা চোখে, ওকে করা হলো বেলুড মঠের 'রামানন্দ বাবাজী।' চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। অনেক মানুষ তার দর্শনলাভের জন্য জড়ো হতে লাগলো।
নজরুলের ছিল বহুমুখী প্রতিভা। বেদ বেদান্ত উপনিষদ রামায়ন মহাভারত থেকে স্লোক আওড়ে সবাইকে করলেন মুগ্ধ। মাঝে মাঝে গীতার স্লোক আর সময় সুযোগ বুঝে শ্যামাসংগীত গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। বেশ কয়েকদিন এইভাবে চলতে লাগল। ধর্মালোচনা শুনতে মানুষ আসতে থাকলো। আর এই পরিস্থিতিতে পড়ে স্বয়ং নজরুল 'রামানন্দ বাবাজী' হয়ে থাকতে বেশ আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন।
নজরুল পরিবারে শোকের ছায়া। প্রয়াত হলেন কাজী নজরুল ইসলামের (Kazi Nazrul Islam) পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী (Kalyani Kazi)। শুক্রবার প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট নজরুলগীতি শিল্পী। বিদ্রোহী কবির কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধকে বিয়ে করেছিলেন কল্যাণী কাজী। নজরুল গীতির অন্যতম ধারক ও বাহকের প্রয়াণ ঘটল। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
কল্যাণী কাজী বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। তাঁর লড়াই চলছিল ব্লাড ক্যানসারের সঙ্গে। আবার সম্প্রতি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। শহরের বেসরকারি হাসপাতাল তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। শুক্রবার তাঁর মাল্টি অরগান ফেইলিউর হয়, চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেও তাঁকে আর ফেরাতে পারেননি। সমস্ত লড়াই শেষ করে অমৃতের পথে যাত্রা করলেন নজরুল পুত্রবধূ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
গায়িকা এবং নজরুল পুত্রবধূর প্রয়াণে শোক জ্ঞাপন করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। টুইটারে মমতা লিখেছেন, 'বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী এবং কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ তথা কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী কল্যাণী কাজীর প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি আজ সকালে কলকাতায় প্রয়াত হয়েছেন। বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।'
মমতা আরও লিখেছেন, 'তাঁর অসামান্য গায়কীতে গাওয়া নজরুলগীতি শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৫ সালে তাঁকে 'সঙ্গীত মহাসম্মান' প্রদান করে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ কাজী নজরুল ইসলাম আকাদেমির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যা ছিলেন।' বিশিষ্ট গায়িকার পরিবারের সদস্যদের গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিকে কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়, ওপার বাংলার নজরুল গীতি শ্রোতারাও কল্যাণী কাজীর প্রয়াণে শোকাহত।'
পাইকপাড়ার বাড়িতে কল্যাণী কাজীর মরদেহ নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে শায়িত রাখা হবে পিস হেভেনে। জানা গিয়েছে, মেয়ে অনিন্দিতা কাজী নিউ জার্সি থেকে দেশে ফিরলে পার্ক সার্কাসে কবর দেওয়া হবে কল্যাণী কাজীকে।
সৌমেন সুরঃ প্যারোডি গানে একমসয় দর্শককে মাতিয়ে রেখেছিলেন শিল্পী মিন্টু দাশগুপ্ত, দীপেন মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত রায়, অমল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। মিন্টুবাবুর গলায় বিষাদের সুর, 'আমাদের গান শেষ হয়ে গেল।' তাঁর আক্ষেপ যে ভুল নয় আজকের সংগীত জগতের দিকে তাকালে তা মর্মে-মর্মে টের পাওয়া যায়। নতুন প্রজন্মের এই ধরনের গানের ব্যাপারে তেমন কোনও আগ্রহ নেই।
প্যারোডি গান মিন্টুবাবুর হাত ধরে আসেনি। ওর মতে এ ধরনের গান-এর স্রষ্টা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু হাসির গান লিখেছেন। কাজী নজরুল ইসলামও পিছিয়ে নেই। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দও অবশ্য গান ভেবে লেখেননি। লিখেছেন কবিতা। সেই কবিতায় দুর্দান্ত সুরের মায়াজালে সনৎ সিংহের গাওয়ার গুনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্যারোডি গানের আলোচনা করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের রচনাতেই। রবীন্দ্রসংগীতের প্যারোডি করেন স্বয়ং কাজী নজরুল।
তিনি রবীন্দ্রসংগীতের আদলে একটি গান লেখেন। জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত 'আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো, নমো হে নমো'-র অনুকরণে নজরুল লেখেন, 'একবার নাম হে নাম।' নজরুলের বাড়িতে প্রায়ই গানের আড্ডা বসতো। সেই আড্ডায় রঞ্জিত রায়ও থাকতেন। যিনি একাধারে অভিনেতা ও গায়ক। গান গাইলেও তিনি মূলত ছিলেন হাসির গানের শিল্পী। একবার 'নাম হে নাম' গানটি শুনে তিনি ঠিক করেন গানটি রের্কড করবেন। করলেনও এবার প্রকাশ হবে কীভাবে। রবীন্দ্রগানের অনুকরণ যেহেতু, তাই গুরুদেবের অনুমতির প্রয়োজন। ঠিক হলো জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যাওয়ার। রঞ্জিতবাবু এইচএমভি রিজিওন্যাল ম্যানেজার হেম সোমকে সঙ্গে নিলেন। যথারীতি প্রণাম ও আলাপ পর্ব শেষে রঞ্জিতবাবু আসল কারণটাই নিবেদন করলেন বিনীতভাবে। (চলবে) তথ্যঋণ/ দীপক মজুমদার।