
সৌমেন সুর:- ব্রেখট ১৮৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জার্মানীর বাভারিয়ার আউগসবুর্গে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সম্পন্ন পরিবারের মানুষ ছিলেন। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শ্রেণির প্রতি বিতৃষ্ণা বাড়তে থাকে। ব্রেখট চেয়েছিলেন বাভারিয়ায় ভালোমানুষ রূপে জীবনটা কাটাতে। একটি মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। ব্রেখট নিজেকে ঠাট্টা করে বলতেন, হতভাগ্য বে বে। তাই পরে একটি কবিতায় লিখেছিলেন, বেচারা বে বে-এর জন্ম এক অন্ধকার যুগে।
ব্রেখটের বাবা ছিলেন স্থানীয় কাগজ কারখানায় অধিকর্তা। বাবার প্রভাবের জোরে ব্রেখট একটি সামরিক হাসপাতালে কাজ পান। যুদ্ধ ফেরত আহত সৈনিকদের সেবা করাই ছিল তার কাজ। মাত্র ২০ বছর বয়সে যুদ্ধোন্মত্ত কাইজারের হিংস্র চেহারা উলঙ্গ করে লিখেছিলেন ব্রেখট, মরা সৈনিকের ব্যালাড। যাতে দেখানো হয় শাসকের স্বার্থে রণক্ষেত্রে নিরীহ সৈনিককে বীর শহীদ দেশপ্রেমিক তকমা দেওয়া হয়। ১৯২৪ সালে ব্রেখট লিখেছিলেন লাইফ অব এডওয়ার্ড ও টু অব ইংল্যান্ড নাথক নাটক।
তাঁর চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল রুশবিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ে বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণি সম্পর্কে। ১৯২৮ সালে ব্রেখট দ্য থ্রি পেনি অপেরা লিখে বিখ্যাত হয়। বাংলার স্বনামধন্য নাট্যগোষ্ঠী নান্দীকার-দ্য থ্রি পেনি অপেরা অবলম্বনে তিন পয়সার পালা নাটকটি প্রদর্শিত করেন দীর্ঘদিন ধরে। নাটকের নায়ক ম্যাকিজুল ব্রেখটের বিবরনে বুর্জোয়া ডাকাত। ব্রেখটের মতে পুঁজিবাদী সমাজের মহান ও ইতিবাচক নায়কের তত্ত্বটি ১টি বিরাট ধাপ্পা।
সৌমেন সুর: ঘোড়ার গাড়িতে করে সেদিন উড়িয়ে দেওয়া হলো ছাপানো হ্যান্ডবিল। তটস্থ হয়ে উঠলো সমগ্র কলকাতা। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ। উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের মোড়ে মানুষের হাতে হ্যান্ডবিল, তাতে লেখা- 'অষ্টম আশ্চর্য দেখুন। যাহা কেহ কল্পনা করিতে পারেন নাই, তাহাই সম্ভব হইয়াছে। ছবির মানুষ, জীবজন্তু জীবন্ত হাটিয়ে চলিয়া বেড়াইতেছে।' ১৮৯৬ সাল, উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে বাঙালি বাবুদের জমজমাটি ভিড়। কী নেই এ অঞ্চলে! নাটক থেকে কবিগান। পালা থেকে তরজা। স্টার থিয়েটারে গিরিশচন্দ্রের নতুন নাটক। পাশাপাশি রয়েছে রসরাজ অমৃতলালের নাটক। এখানে ওখানে চলছে তর্কবিতর্কের ঝড়।
কোন নাটক কেমন, কে কেমন অভিনয় করছে ইত্যাদি। এরই মধ্যে হ্যান্ডবিল দেখে চমক। কলকাতায় পা রাখলেন স্টিফেন সাহেব। উপস্থিত হলেন স্টার থিয়েটারে। সাহেব সাজ-সরঞ্জাম দেখে সবাই অবাক। ঝোলা থেকে যন্ত্র বের করে সাহেব বললেন, আমার এই যন্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে আছে জ্যান্ত সব ছবি। নাটকের লোকগুলো হইহই করে উঠলো, সাহেব যন্ত্রটা চালাও। আমরা দেখতে চাই জীবন্ত ছবি। শুরু হলো বায়োস্কোপ, উত্তর কলকাতার স্টার থিয়েটারে। এই কলকাতায় আরও একজন উদ্যোগীর কথা মনে পড়ে। তিনি হলেন অধ্যাপক ফাদার লাঁফো। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ান।
এদেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সাজসরঞ্জাম তিনিই প্রথমে আনেন। তখন প্রচার ঠিক হয়নি, তিনি কয়েকজন ছাত্রকে ডেকে জ্যান্ত ছবি দেখান। উদ্দেশ্য হলো চলচ্চিত্র সম্পর্কে অবহিত করা। এখানে প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন- এদেশে বায়োস্কোপ আনার পক্ষে প্রথম ফাদার লাঁফো তারপর স্টিভেন।
সৌমেন সুরঃ মারা যাওয়া পেনশন প্রাপকের বদলি লোক কিংবা গ্রামের অন্য কেউ প্রকিস দিয়ে পেনশন তুলছে। সুতরাং হার্শেল সাহেব তার হুগলি বিদ্যেটা কাজে লাগালেন। তিনি ঘোষণা করলেন, পেনশন প্রাপকের সাক্ষর ছাড়াও আঙুলের ছাপ দিতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে কাজ শুরু হবার পর ফল হাতেনাতে পাওয়া গেল। পেনশন প্রাপকদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে আরম্ভ করলো। এই ঘটনায় হার্শেল সাহেব উৎসাহিত হয়ে দলিল রেজিস্টেশনের ক্ষেত্রেও আঙুলের ছাপ নিতে আরম্ভ করলেন, যাতে বিক্রেতা অস্বীকার করতে না পারে এবং ক্রেতাও বিক্রেতার সই জাল করে জমি আত্মসাৎ করতে না পারে। কিন্তু হার্শেলের দুর্ভাগ্য কয়েদিদের শনাক্তকরনের ক্ষেত্রে তিনি এই পদ্ধতি প্রয়োগ সরকারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেন। তা না হলে সেইসময় ১৮৬০/৬২- তেই ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কার স্বীকৃত হতে পারতো।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং পূর্ণাঙ্গ হাতের ছাপ নিয়ে নানান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও প্রকৃত ফিঙ্গারপ্রিন্টের তদন্তের আনুষ্ঠানিক সূচনা কলকাতা থেকেই। বিখ্যাত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো অধিকর্তা বিদ্যুৎ নাগের একক প্রচেষ্টায় আজ প্রমণিত, কলকাতাই ফিঙ্গারপ্রিন্টের তদন্তের উৎস। এই প্রসঙ্গে তাঁর বর্ণনায় পাই, কর্মব্যস্ত একজন ইংরেজ আই সি অফিসার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি পুলিস ইনসপেক্টার জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব নিয়েই তিনি অপরাধী শনাক্তকরনে উঠেপড়ে লেগে যান।
বিজ্ঞানী গ্যালটনের প্রমাণিত সূ্ত্র ধরে হেনরি ফিঙ্গারপ্রিন্টকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিলেন শনাক্তকরনের ব্যাপারে। ফ্যান্সের দেহাঙ্গমিতির সংশোধিত রুপটি হেনরির চেষ্টায় বাংলা তথা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রশংসা পায়। ১৮৯৬ সালে পুলিসের সার্কুলারে আঙুলের ছাপকে প্রধান করে। হেনরি অবশেষে স্বীকার করেন, 'অঙ্গলিছাপ' সূ্ত্রটি একশো শতাংশ নির্ভুল রুপে মত দেন দুজন বাঙালি সাব ইন্সপেক্টর। একজন আজিজুল হক, অন্যজন হেমচন্দ্র বসু। তবে সূ্ত্রটি আজও হেনরি পদ্ধতি নামে সারা বিশ্বে প্রচলিত। ১৮৯৭ সালে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যাপারে অনুমোদন পাওয়ার পর ভারতবর্ষে বাংলার মূখ্যকার্যালয় রাইটার্স বিল্ডিং-য়ে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। (সমাপ্ত) তথ্যঋণ/ বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধায়
সৌমেন সুর: ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রথম সূ্ত্রপাত ১৮৫৮ সালে একটু ভিন্ন আকারে দেখা গিয়েছিল। উইলিয়াম হার্শেল তখন হুগলির কালেকটর ডাকাবুকো আইসিএস। মাত্র ২০ টাকার চুক্তিপত্র করে ঘুটিং সরবরাহ করার জন্য রাজ্যধর কোনাইকে অর্ডার দিলেন। কিন্তু অনেক সময় সরবরাহকারীরা চুক্তিপত্র ও সই অস্বীকার করে বিপদে ফেলেন। তাই সতর্ক হার্শেল সাহেব ঠিক করলেন, রাজ্যধরকে একটা প্রস্তাব দেওয়া যাক যে, তাঁকে চুক্তিপত্রর উপর হাতের ছাপ দিতে হবে। অফিসে স্ট্যাম্প দেওয়ার জন্য ভুসো কালির ব্যবহার করা হতো। তাই হাতে কালি মাখিয়ে রাজ্যধরের হাতের ছাপটা চুক্তিপত্রের উপর নেওয়া হল। রাজ্যধরও মজা পেলো সাহেবের এই অদ্ভুত প্রস্তাবে। কিন্তু এই হাতের ছাপটা আজকের বিশ্ব শনাক্তকরনের চূড়ান্ত পন্থা হিসেবে আঙুলের ছাপ ব্যবহারের গোড়াপত্তন করলো। হার্শেল সাহেব আরও অনেকের হাত ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতেন। তবে সবাই এটাকে হার্শেল সাহেবের পাগলামি বলে ধরে নিয়েই হাতের ছাপ দিতেন।
বিষয়টি যে পাগলামি ছিল না, তার প্রমাণ হাতে হাতে পেয়ে গেলেন হার্শেল সাহেব। দু'বছর পর নদীয়া জেলার ডিস্ট্রিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি সবে বদলি হয়েছেন। দেখলেন, মাসের প্রথম দিকে সিপাহি বিদ্রোহ যারা সরকারকে সাহায্য করেছিল, সেসব পেনশন প্রাপকের সংখ্যা বেশ ভালই। যদিও তারা সকলেই বেশ বয়স্ক, তবুও সংখ্যাটা কিছুতেই কমছে না। কিছুদিন পর তিনি বুঝতে পারলেন, মারা যাওয়া পেনশন প্রাপকের বদলি লোক প্রক্সি দিয়ে পেনশন তুলছে হাসিমুখে।
তথ্যঋণ: বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধায়
সৌমেন সুর: গ্রুপ থিয়েটারে তারা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নাটকে নতুন নতুন রীতির আর্বিভাব ঘটিয়েছে। অন্যদিকে পেশাদার থিয়েটার যেহেতু একটা জায়গায় অবস্থিত এবং যেখানে বৃহস্পতি-শনি এবং রবিবার নাট্য প্রদর্শন হয়, সেহেতু দর্শকসংখ্যা একটা সীমায় আবদ্ধ। চাহিদার তুলনায় জোগান কম। প্রখ্যাত নাট্যধারার বাইরে যেতে পারেনি পেশাদার থিয়েটার। ফলে দর্শক কমতে থাকে। পেশাদার থিয়েটারের অনেক শিল্পীই তো গ্রুপ থিয়েটার বা গণনাট্যে সফলতা এনে দিয়েছেন।
তাহলে পেশাদার থিয়েটারের দৈনদশা ঘোচাতে সচেষ্ট হলেন না কেন? জানতে পারা যায়, শিল্পজ্ঞানহীন ব্যবসায়ী প্রযোজকদের কথা। তাদের রক্তচক্ষুর জন্য এই দুর্দশা। অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় লেখেন, 'শিল্পক্ষেত্রে সাহসিকতা বলতে আমরা বুঝি যে স্রষ্টার পরিকল্পনা আপসহীন ভাবে উচ্চারিত হয়েছে কিনা। উৎপল দত্ত বাংলা নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে অন্যতম দুঃসাহসিক পরিচালক।'
১৯২৭ সালে ৬ জুন 'নাচঘর' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেশাদার রঙ্গশালার রসবোধ ও কলাজ্ঞান নিয়ে বিরক্ত হয়েছিলেন। তার প্রায় ৬০ বছরের মধ্যে একই চিত্র দেখা গিয়েছে পেশাদার থিয়েটারে। ফলে তাঁকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে অনিবার্য ভাবে। ব্যবসায়ীদের মানসিকতাই হল, কোনও একটি ক্ষেত্রে ব্যবসা ভালো না হলে তাঁরা অন্য ক্ষেত্রে টাকা ঢালে। পেশাদারী নাটকে যখন ঠিকঠাক ব্যবসা হচ্ছিল না, তখন তাঁরা থিয়েটার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। তাই থিয়েটারে পেশার বিষয়টি একটি প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আজ।
সৌমেন সুর: সুকুমারী দত্ত, শ্যামা, তিনকড়ি, এলোকেশী, বিনোদিনী, ক্ষেত্রমনি, কুসুমকুমারী, তারাসুন্দরী প্রমুখদের জীবনচর্চা থেকে থিয়েটারে দক্ষ অভিনেত্রী করে তোলার জন্য গিরীশ ঘোষ, অমৃতলাল মিত্র, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির পরিশ্রম উল্লেখযোগ্য। অভিনেত্রীদের দাম কোনওদিনই কম ছিল না। বিশেষ করে নটি বিনোদিনীর নাম। তাঁর আত্মত্যাগ, থিয়েটার গড়ে তোলার স্বপ্ন, মানুষ বহুদিন মনে রাখবে। বর্তমানে শুধু অভিনেত্রীরাই নয়, বহু অভিনেতাও বিভিন্ন নাট্যদলে অভিনয় করে জীবিকা অর্জন করেন।
পেশাদার নাট্যশালার প্রায় সব শিল্পীই চেয়েছিলেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে। অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষতা, অক্ষমতা হয়তো কাজ করেছে, কিন্তু তাদের নিষ্ঠা কম ছিল না। যখন পেশাদার থিয়েটারের শেষ পর্ব, তখন সৌমিত্র চ্যাটার্জী, অপর্ণা সেন, মনোজ মিত্র, গীতা দে, সাবিত্রী চ্যাটার্জী, চিন্ময় রায়, অনুপকুমার, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক মিত্র প্রমুখ বড় বড় শিল্পী পেশাদার নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলা পেশাদার থিয়েটারের দর্শকদের কাছ থেকে মন্তব্য শুনে কতকগুলো ভাবনা কাজ করেছে।
যেমন পেশাদার থিয়েটারকে স্বাস্থ্যকর লড়াই করতে হয়েছে গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে। গ্রুপ থিয়েটারের নতুন নতুন দল, নতুন নতুন নাটক নিয়ে সারা বাংলায় ঘোরে। তাদের বিষয়ে অভিনবত্ব রয়েছে তেমনি বৈচিত্র দর্শকও তারা পেয়েছে। নাটকে তারা নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় নতুন রীতির আবির্ভাব ঘটিয়েছে। (চলবে)
সৌমেন সুর: একটি নারী অনন্ত শক্তির অধিকারিণী। নারী এক অসীম, অনন্ত শক্তির আধার। প্রত্যেক নারীর মধ্যে স্নেহ, মায়া, মমতা, ত্যাগ, নিষ্ঠা, স্বার্থপরতার সঙ্গে একটা অনন্য গুণাবলী সহাবস্থান করে। সব অগোছালো জঞ্জাল, পাঁক সরিয়ে এক সুন্দর সমাজ, সংসার গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী নারীর মধ্যে বিদ্যমান। নারীর মধ্যে যে শক্তির অন্তঃসলিলা গঙ্গা প্রবাহিত হয়ে চলেছে সৃষ্টির আদিকাল থেকে, সেকথা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, জেনেছি পড়েছি পুরাণে ইতিহাসে। মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গরাজ্যে যখন ত্রাহি ত্রাহি রব, দেবতারা যখন দিশেহারা, ঠিক সেই সময় আবির্ভূত হলেন এক মহাশক্তি। সেই মহাশক্তি অসীম পরাক্রমশালী দেবী দুর্গা। এই দুর্গাই পরাজিত করেন মহিষাসুরকে।
অরুন্ধতি ভট্টাচার্য। চড়াই-উতরাই নিয়ে তাঁর জীবন কাহিনী। শিক্ষা সমাপ্ত করে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফিনান্স ম্যানেজারের আসনে যোগদান আশির দশকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর উত্থান। ধাপে ধাপে এমডি থেকে হলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রথম মহিলা চেয়ারপার্সন। ২০১৬ আলে ফোর্বস তাঁকে সবচেয়ে শক্তিশালী ২৫ মহিলার তালিকাভুক্ত করে সম্মানিত করে। এশিয়া প্যাসিফিক অরুন্ধতী ভট্টাচার্যকে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী মহিলারূপে মনোনীত করে অনন্য সম্মান দেন। ২০১৭ সালে ইন্ডিয়া টু ডে ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ৫০ জন শক্তিশালী মহিলার একজন বলে শিরোপা দেন। ভারতবর্ষ তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসে অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের মতো ব্যক্তিত্ব বিরল।
যা নারী শক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রথমে বাঙালি তারপর ভারতীয় হিসেবে অরুন্ধতী ভট্টাচার্য আমাদের গর্ব।
সৌমেন সুর: ভারতীয় নৃত্যশাস্ত্রের এক অতি প্রাচীন নৃত্যকলা ভরতনাট্যম। অনেকে মনে করেন ভরত মুনি এর প্রবর্তন করেছিলেন বলে এই নৃত্যকলার নাম ভরতনাট্যম। ভাব,রাগ ও তালের সমন্বয়ে অপূর্ব মিশেলে সৃষ্টি এই নৃত্যকলা। ভরতনাট্যমের ভাবধারা মূলত ধর্মভিত্তিক এবং দেবতা কেন্দ্রীক। মহাদেব শিবকে এই নৃত্যশৈলীর ভগবান বলা হয়। এই অসাধারণ নৃত্যশৈলী বহুদিন যাবৎ মন্দিরের দেবদাসীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে দেবদাসী প্রথা অবলুপ্ত হলে এই অসাধারণ নৃত্যশৈলীর অবলুপ্তি ঘটে।
প্রথম পর্বের পর... রুক্মিণী অরুন্দলে ১৯৫৬ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৬৭ সালে সঙ্গীত নাটক একাডেমির ফেলোশিপ পান। যারা ভারতকে গড়েছেন এমন ১০০ জন ভারতীয়কে তালিকাভুক্ত করে 'ইন্ডিয়া টু ডে'। তার মধ্যে রুক্মিণী দেবী অন্যতম। দক্ষিণ ভারতীয় এই নৃত্যধারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রুক্মিণী কঠোর পরিশ্রম করেন। পুরাণ মতে, মুর দৈত্যকে বধ করে, দেবতাদের এবং স্বয়ং বিষ্ণুকে ভয়মুক্ত করতে দেবী চণ্ডী, দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতী একসঙ্গে মিলিত হয়ে বৈষ্ণো দেবী রূপ নেন।
কোনও অশুভ শক্তিকে নাশ করতে শুধু শক্তি নয়, অর্থ নয়, বিদ্যা ও জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে।। অনিয়ন্ত্রিত শক্তি এবং অর্থ কোনওটাই পৃথিবীকে মঙ্গল করতে পারে না। আর বিদ্যার একমাত্র সুন্দর মাধ্যম হল সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের স্বাদ থেকে নারী কীভাবে বঞ্চিত থাকতে পারে! পৃথিবীর প্রথম দিন থেকে কেন জানি না নারীর চলার পথ অপেক্ষাকৃত বেশি কঠিন, ধরিত্রির মতোই প্রতিদিন প্রতিনিয়ত একের পর এক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে বলেই হয়তো নারীকে সর্বসহা উপাধি দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা চলছে। তবে পথ যত কঠিন, নারীরা তার চেয়েও যে কঠিন এই পরীক্ষা নারী যুগে যুগে দিয়ে এসেছে।
সৌমেন সুর: চৌকিদার হবে একজন মহিলা! শুনতে খটকা লাগছে না? এতদিন শুনেছি চৌকিদার সাধারণত হয়ে থাকে একজন পুরুষ। কিন্তু ঘটনাটা সত্যি সত্যি ঘটেছে। কিন্তু মহিলা চৌকিদার, অসম্ভব! স্বাস্থ্যবতী বিধবা মহিলা কোলে একটা শিশু নিয়ে অসহায় অবস্থায় গ্রামের কিছু লোকের সঙ্গে শহরে এসে পুলিস দফতরে দরখাস্ত জমা দেয়। দরখাস্ত দেখে পুলিস দফতর হেসে কুটোকুটি। একজন মহিলা হবে চৌকিদার! সবাই তাচ্ছিল্য করতে থাকে।
একদা বর্ধমান জেলার কালনা বিভাগের মধ্যে আবাদী দুর্গাপুর নামে ছোট একটি গ্রাম। মুসলিম এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বাস এই গ্রামে। বৈকুণ্ঠ সর্দার হলেন এই গ্রামের চৌকিদার। দ্রবময়ী হলেন বৈকুণ্ঠের স্ত্রী। বৈকুণ্ঠ তাঁর স্ত্রীকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুব জোরদার লাঠিখেলা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। কখনও বৈকুণ্ঠের শরীর খারাপ হলে দ্রবময়ী গ্রাম পাহারা দিতেন। একথা গোটা গ্রাম জানত, কিন্তু কখনও পুলিসের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানায়নি। একদিন হঠাৎ বৈকুণ্ঠ এক অজানা অসুখে মারা যান। দ্রবময়ী অথৈ জলে পড়েন। কী করে সংসার চলবে? বাবা মা, একটা ছোট শিশু নিয়ে সংসার! মনকে প্রস্তুত করেন, চৌকিদারের কাজ তাঁর চাই-ই চাই।
পুলিসের বড় সাহেব দ্রবময়ীকে অন্যদের মতো হাসির পাত্র না করে, বর্ধমান পুলিসের বড় সাহেবের কাছে দরখাস্ত সমেত দ্রবময়ীকে পাঠিয়ে দেন। বড় সাহেব একটু চিন্তায় পড়লেন, চৌকিদারের কাজে মহিলা নিয়োগ কী করে করবেন। এই চাকরিতে লাঠি খেলায় চোস্ত হতে হবে। একটা পরীক্ষা করে দেখা যাক, লাঠিখেলায় এই মহিলা কতটা পারদর্শী। সেদিন পুরুষের সঙ্গে এই মহিলার লাঠিখেলা দেখতে প্রচুর ভিড় জমে মাঠে।
১৯১৮ সালে 'আর্যাবর্ত' পত্রিকায় এই লাঠিখেলা প্রসঙ্গে সুন্দর বর্ণনা করেছিল। দ্রবময়ী ভীষণ সাহসে লাঠি খেলতে মাঠে নেমে পড়েন। মহিলা দ্রবময়ী পুলিস সাহেবকে সেলাম ঠুকে লাঠি নিয়ে প্রস্তুত। কিন্তু পুরুষ লাঠিয়াল একটু হালকা চালে লাঠি খেলে। এই দৃশ্য দেখে দ্রবময়ী আবেদন করেন প্রকৃত লাঠিখেলা যেভাবে হয়, সেভাবে খেলতে। তিনি জানান, প্রয়োজনে দু'জনকে লড়তে বলুন আমার বিরুদ্ধে। অবশেষে সাহেব সংকেত দেয়, লাঠিখেলা শুরু হয়। দ্রবময়ী অনেক কসরতে ধরাশায়ী করেন দু'জন কনস্টেবলকে। উপস্থিত দর্শক আনন্দে-উল্লাসে দ্রবময়ীকে সেদিন আশীর্বাদ করেছিল। পুলিস সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আলোচনা করে দশ টাকা ইনাম ঘোষণা করেন এবং এক সের মিঠাই বাচ্চাটার জন্য।
তখনকার পুরুষশাসিত সমাজে দ্রবময়ী দাসী নামে একজন সাধারণ মহিলা অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে, মৃত স্বামীর চাকরিতে নিজে বহাল হয়েছিলেন। সেইসঙ্গে স্বীকৃতি পান দেশের প্রথম মহিলা চৌকিদার দ্রবময়ী দাসী।
বিশ্বকাপ টি-২০ জমে উঠেছে। আচমকাই রবিবারের মস্ত ধাক্কা টুর্নামেন্টের রং পাল্টিয়ে দিল। ছুটির দিনে অনেকেই দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। রবিবারের একমাত্র খেলায় ধরে নিয়েছিল ভারতীয় দর্শকরা যে ভারত কোনও ভাবে জিম্বাবোয়েকে হারাক, শান্তিতে ভারত এক নম্বর হয়ে সেমিফাইনালে যাক। লোকের ধারণা আর কি বা রয়েছে রবিবাসরীয়তে? কারণ আজকের একটি খেলা দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম নেদারল্যান্ড, যেখানে টুসকি দিয়ে জিতে যাবে আফ্রিকানরা। আর খেলে বলতে পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ যেখানে ফল নিয়ে কি লাভ, কারণ এরা তো কেউই তো আর সেমিফাইনালে যাবে না। কিন্তু ক্রিকেট এক বলের খেলা, কখন কি হয়ে যাবে কেউই কি বলতে পারে?
কার্যত রবিবারের রবির রং পাল্টিয়ে ফেললো সমস্ত জল্পনা। ভারতীয় সময় আলো না ফোটা সকালে শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম নেদারল্যান্ডের খেলা। চিরকালের চোকার্স দক্ষিণ আফ্রিকা সদ্য বিশ্ব ক্রিকেটে আসা ফুটবলের চোকার্স দেশ নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলো। জমে গেলো ক্রিকেট। সকলের কাছে মৃত্যু থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কাছে সুযোগ এসে গেল। যে জিতবে সেই যাবে সেমিফাইনালে। এবং এবার আর সুযোগ নষ্ট করলো না পাকিস্তান। বাংলাদেশকে অনায়াসেই হারিয়ে এবারে সেমিতে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি। অন্যদিকে ভারত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইংল্যান্ডের সঙে লড়াইতে।
ইতিহাস কি ফিরে আসে? ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেমিফানালে পৌঁছেছিল। তারপর জিতে ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ইমরান খান বিশ্বকাপের দখল নিয়েছিল। দেখার বিষয় ভারত কি হারাতে পারবে ইংল্যান্ডকে? যদি পারে তবে অন্য খেলা, কিন্তু যদি ইংল্যান্ড ফাইনালে ওঠে? সেবারেও কিন্তু টুর্নামেন্টটি অস্ট্রেলিয়াতেই হয়েছিল ঠিক ৩০ বছর আগে।
মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষ শেষ হয় এবং সূচনা হয় দেবীপক্ষের। মহালয়ার দিনে পিতৃপুরুষদের তর্পণ করার প্রথা প্রচলিত আছে। পিতৃপক্ষের সময় বিদেহী আত্মারা জল গ্রহণের জন্য মর্ত্যে আসেন। তার পর থেকে দীপাবলি পর্যন্ত তাঁরা মর্ত্যেই বিচরণ করেন। দীপাবলির সময় পিতৃলোকে ফিরে যান তাঁরা। কিন্তু যেদিন তাঁরা ফিরে যান সেই দিনটি আসলে অমাবস্যা। এই অন্ধকারে পিতৃপুরুষদের যাতে ফিরে যেতে সমস্যা না-হয়, তাই তাঁদের উদ্দেশে অন্ধকার পথ আলোকিত করে রাখা হয়। তাই ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় প্রদীপ।
এ ভাবে কালীপুজোর সঙ্গে প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা জড়িয়ে পড়েছে। তবে দীপান্বিতা অমাবস্যার সময় কেন কালীপুজো করা হয়, তারও ইতিহাস রয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের স্মার্ত পণ্ডিত ও নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপুজোর বিধান দেন। তবে কালীপুজোর কোনও উল্লেখ করেননি তিনি। এর পর অষ্টাদশ শতকে প্রকাশিত কালী সপর্যাস বিধিতে প্রথম বার দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সপ্তদশ শতকে বাংলায় কালীপুজোর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকেই বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক বলে মনে করা হয়।
এর আগে কালীর উপাসকরা তামার টাটে কালীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে তাঁর পুজো করতেন। অষ্টাদশ শতকে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এর পর উনিশ শতকে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজো জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সৌমেন সুর: ইতিহাসের কত পট পরিবর্তন হয়েছে। সভ্যতা বিবর্তিত হয়েছে, সেই সঙ্গে মানুষের জীবনধারাও পাল্টেছে। তবু হিংসা, বিদ্বেষ থেকে মানুষের মুক্তি ঘটেনি। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ হিংসার ছোবলে প্রাণ হারায়। আজও কত রক্তপাত, দলাদলির নির্লজ্জ বীভৎস ছবি। কেন এত রক্তপাত! কেন আজও হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী! কেন মানুষের ভিতরের হিংস্রতার আদিম পশুটা ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে? জীবনের এটাই কি অপরিহার্য ললাট লিখন?
শুরু হলো বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। মানুষ হাতে পেল ভয়ংকর সব অস্ত্রশস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমা- নাগাসাকিতে খেলা হলো শক্তিশালী অ্যাটম বোম। নিমিষে ধ্বংস হয়ে গেল দুটো শহর। এই দৃশ্যের পরেও শেষ নেই হিংসা-বিলাসের। আজও চলছে উৎপীড়ন। রক্তের হোলি খেলায় সমাপ্তি ঘটলো না। দিন বদলায়। সমাজ পাল্টায়। রাজার রাজত্ব যায়। বিজ্ঞান তার গতিপথে এগিয়েই চলে। জনপ্রতিনিধিরা শাসকের আসনে বসেন। কোথায় গেল শহর সাজে নতুন নতুন উপকরণে। বারে শ্রমজীবীর দল। শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক তিক্ত হয়। অসন্তোষ বাড়ে। শোষিতের দল চায় এক শোষণমুক্ত সমাজ। তার জন্য আন্দোলন, মৃত্যুবরণ। সব রাজনৈতিক দল চায় দেশের মঙ্গল, মানুষের কল্যাণ। কে কাকে টপকে শাসকের ভূমিকা নেবে, তাই নিয়ে চলে রেষারেষি, হিংসা, মারামারি, খুনখারাপি। দলের লোক খারাপ হলেও ভালো। ভালো লোক অন্য দলের হলে খারাপ। এই ভাবেই সমাজ বিরোধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। বর্তমানে ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই ক্ষমতার লড়াইয়ে খুনোখুনি হিংসা বেড়েই চলেছে।
হিংসা মানুষের জীবনে সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়। জীবনে প্রেম, জ্ঞান ও মৈত্রীর পথ দেখিয়েছেন। যে সমস্ত অবতার ও ধর্মীয় মহাপুরুষ দেখিয়েছেন মানুষের মুক্তির পথ, একদিন এদের নির্দেশিত পথে বিকশিত হয়ে মানুষ চেতনার আলোই আলোকিত হবেই। অন্ধ সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ রোগমুক্তির ঠিকানা খুঁজে পাবেই। তখন মানুষ শান্তিতে বিরাজ করবে, নচেৎ নয়।
শিক্ষক (teacher) হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ইতিহাসে অনার্স করে এমএ (MA in History)। বর্তমানে ২০২ টাকা রোজে পুরসভার সাফাই কর্মীদের সুপারভাইজার (Supervisor) হিসেবে কাজ করছেন হাবরার (Habra) ওই যুবক। একাধিকবার এসএসসি (SSC) পরীক্ষা দিয়েও মেলেনি চাকরি (job)।
জানা যায়, ইতিহাস নিয়ে এমএ পাস করেছেন হাবড়ার আশুতোষ কলোনির বাসিন্দা বছর ৪৩ এর গোবিন্দ সাহা। এরমধ্যে কয়েকবার এসএসসি, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা, খাদ্য বিভাগের চাকরির জন্য পরীক্ষা সবই দিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্যে জোটেনি একটিও চাকরি। বর্তমান সময়ে যখন চাকরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় বেনিয়ম, পরীক্ষা না দিয়ে চাকরি পাওয়া অথচ যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা চাকরি পাচ্ছে না এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তখন ইতিহাস নিয়ে এমএ পাস করা বর্তমানে ওই যুবক ২০২ টাকার দিনমজুরিতে জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজ করছেন। গোবিন্দর মতে, সঠিক নিয়োগ হলে তিনি হয়তো তাঁর চাকরিটা পেয়ে যেতেন। স্বপ্ন দেখতেন একজন শিক্ষক হবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতে পারতেন।
বাড়িতে বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও দশ বছরের একটি ছেলে রয়েছে। তাই সংসারের হাল ধরতে চাকরি না পাওয়া উচ্চ শিক্ষিত গোবিন্দ প্রতিদিন সকাল হলেই হাবড়া পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে জঞ্জাল সাফাইয়ের দেখাশোনার কাজে নেমে পড়েন। মাঝেমধ্যে নিজেও জঞ্জাল সাফাইয়ে ও বাড়ি বাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহের কাজে হাত লাগান। রাস্তার পাশে প্রয়োজনে ব্লিচিং ছড়ানো সবই করেন তিনি। সামনে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজো। তবে গোবিন্দের মুখে হাসি নেই, কারণ সপ্তাহে চারটে রবিবার বাদ দিলে প্রতিদিন কাজ করার পর তাঁর মেরে কেটে মাসিক আয় হাজার পাঁচেক টাকা। তা দিয়ে সংসার চালাবেন, না ছেলের পড়াশোনা করাবেন, না ছোটখাটো শখ পূরণ করবেন, ভেবেই পান না গোবিন্দ।
বিজেপির স্থানীয় নেতা অবশ্য বলছেন রাজ্যের কর্মসংস্থান এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে একজন এমএ পাস যুবককেও জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজ করতে হচ্ছে। এমন কাম্য নয়।
এবিষয়ে হাবরা পুরসভার পুরপ্রধান বলেন, পারিশ্রমিক কম থাকলেও সুপারভাইজারের কাজ সম্মানজনক। তাঁর যোগ্যতা থাকলে নিশ্চয়ই তিনি ভালো পরীক্ষায় বসে চাকরি পাবেন।
জামাইষষ্ঠী একটি হিন্দু পরব বা রীতি। শোনা যায়, মা ষষ্ঠীকে পুজো দিয়ে পরিবারের সকলের মঙ্গল কামনা করেন বাড়ির গৃহিণী। তবে জামাইষষ্ঠী নামটি কেন? আসলে সব মায়েরা চান, তাঁর কন্যা বিয়ের পর সুখে থাকুক শ্বশুরালয়ে গিয়ে এবং তাঁর জামাই দীর্ঘজীবন লাভ করুক। সেই কারণেই জামাইষষ্ঠী পালিত হয়ে থাকে।
আগেরদিনে জামাইষষ্ঠী মানে বাড়িতে একটা মিনি উৎসব। যৌথ পরিবার ছিল এক সময়। বাবা-কাকা-জেঠার মধ্যে যাঁরই কন্যা থাকুক, এক বা একাধিক তাঁদের জামাই সহ নিমন্ত্রণ থাকত শ্বশুরালয়ে। বিশাল খাওয়া-দাওয়া সকাল থেকে রাত। তারপর উপহার সহ বাড়িতে ফিরে যাওয়া।
প্রয়াত ফুটবল কিংবদন্তী প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, আরে বাবা, একটা দিন এই ষষ্ঠী, কেমন জানি বিয়ের দিনের খাতির ফিরে আসতো, তো খারাপ কিসে? তিনি বলেছিলেন, তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে উত্তরবঙ্গে। ফলে দারুণ দারুণ টেস্টি রান্নার স্বাদ তিনি সেখানে পেয়েছিলেন। জামাইষষ্ঠী বাদ দিয়েও স্ত্রী আরতির হাতের রান্নাটি ছিল নাকি অভূতপূর্ব।
বামেরা, বিশেষ করে সিপিএম ধর্ম মানে না। কিন্তু তাদের অনেকেই জামাইষষ্ঠীর খাওয়া উপভোগ করেছেন। জ্যোতি বসু খাদ্যরসিক ছিলেন। ওই দিনটিতে বিশেষ কিছু না থাকলেও স্ত্রীর কাছ থেকে নাকি নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি উপহার পেতেন এবং এই দিনে ডিনার বাড়ির বাইরেই সারতেন জ্যোতিবাবু। বিধাননগরের প্রথম দিকের চেয়ারম্যান দিলীপ গুপ্ত ছিলেন গোঁড়া কমিউনিস্ট। তিনি জানিয়েছিলেন, ধর্ম নিয়ে কী হবে। কিন্তু পূর্ববঙ্গীয় শাশুড়ির হাতের রান্না খেতে তাঁর নাকি জিভ বাধা মানত না। মজা করেই বলতেন, তাঁরা বাঙালি। অতএব খাওয়াদাওয়াতে কোনও সিস্টেম মানতে হবে কেন? সদ্য প্রয়াত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের শ্বশুরবাড়ি উত্তর কলকাতায়। বিয়ের পর চুটিয়ে জামাইষষ্ঠীর খাওয়া খেতেন। মোহনবাগানের সভাপতি টুটু বসু আদ্যন্ত ঘটি। কিন্তু টুটুবাবুর শাশুড়ি ছিলেন ওপার বাংলার। ফলে তাঁর হাতের চিতল মাছের মুইঠ্যা খেতে ষষ্ঠীর দিনটিই আদর্শ ছিল।
আজকের দিনে ওই স্মৃতি আগলে লাভ নেই। জামাইষষ্ঠীর অনুষ্ঠান সত্যি কমে গিয়েছে অনেকটাই। দুটি বছর করোনা আবহে অনুষ্ঠান বাতিল ছিল। কিন্তু তাই বলে এই বছর চোব্যচোষ্য জমিয়ে খাওয়া হবে, এমন আশা কই? দামের যা বহর, তাতে কবজি ডোবাবে কোথায় আজকের জামাইরা?
বিরিয়ানি পছন্দ করেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার! চোখের সামনে মাটন কিংবা চিকেন বিরিয়ানি দেখেও জিভে জল আসে না, এমন মানুষ বড্ড বিরল। এই ছবিটা যে শুধু বাংলার, তা কিন্তু নয়। গোটা ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে বিরিয়ানির প্রতি ভালোবাসা ঠিক এমনই। বিরিয়ানির সুগন্ধি আবেদন মলিন হয়নি এতটুকুও। বিখ্যাত রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায় বলতে হয়, 'একি ভানুমতি! একি ইন্দ্রজাল।' হাজারো ভাষা, বর্ণ, গোত্র, জাতি ও ধর্মে বিভক্ত ভূ-ভারতবাসীকে এক টেবিলে বসাতে পারে বোধহয় দু'টি জিনিস। তার মধ্যে একটি হল ক্রিকেট আর অন্যটি বিরিয়ানি।
এই ঐন্দ্রজালিক বিরিয়ানি প্রথম কীভাবে তৈরি হয়েছিল, জানলে তাজ্জব বনে যাবেন বইকি। প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, 'বিরিয়ানি' শব্দের অর্থ কী? বিরিয়ানি শব্দের উৎপত্তি ফরাসি 'বিরিয়ান' শব্দ থেকে। ফরাসিতে 'বিরিয়ান' শব্দের অর্থ 'রান্নার আগে চাল ভেজে নেওয়া'। বাস্তবেও বিরিয়ানি রান্নার আগে সুগন্ধি চাল ঘি দিয়ে ভেজে নেওয়া হয়। তাই এই নামকরণ।
বিরিয়ানির উৎপত্তি কবে?
অনেকে বলেন, তৈমুর লঙ্গের হাত ধরে ১৩৯৮ সাল নাগাদ ভারতে এসেছিল বিরিয়ানি। মাটির পাত্রে চাল, মশলা আর মাংস মিশিয়ে এক সঙ্গে রান্না করা হত। তখন প্রধানত সৈন্যদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হত বিরিয়ানির এই আদি ‘ভার্সন’। অন্য একটি মতে লঙ্গের বহু আগে ২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরবের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে বিরিয়ানি আসে ভারতে। তামিল সাহিত্যে ‘ওন সরু’ নামে এক ধরনের খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভাত, ঘি, হলুদ, ধনে, মরিচ, তেজপাতা, মাংস দিয়ে তৈরি হত এই খাবার। যার সঙ্গে আধুনিক বিরিয়ানির অনেকটাই মিল পাওয়া যায়।
তবে বিরিয়ানি জনপ্রিয়তা পায় মুঘল সম্রাটদের হাত ধরে। মুমতাজ মহলের রোজকার খাদ্য তালিকায় বিরিয়ানির উল্লেখ পাওয়া যায়। বিরিয়ানি খেতে খুবই ভালোবাসতেন শাহজাহানের এই সুন্দরী বেগম। কথিত, একবার নাকি মুঘল সেনাছাউনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন মুমতাজ। সেখানেই বিরিয়ানি রান্না হতে দেখেন তিনি। রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, সৈন্যদের ‘ব্যালান্স ডায়েট’ দেওয়ার জন্য ভাত ও মাংস মাখানো এই খাবার দেওয়া হয়। নতুন এই খাবারটি চেখে দেখে এর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন মুমতাজ। সেই সূত্রপাত। পরে ভোজনরসিক মুঘলদের খাবার টেবিলে জয়গা পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি সুস্বাদু বিরিয়ানিকে। মুঘলরাই ভারতে যেখানে যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিরিয়ানির স্বাদ। সেটা আবার স্থানীয়দের হাতে পেয়েছে একেকটি নতুন মাত্রা। আর তাই তো পূর্বে ঢাকা থেকে পশ্চিমে পেশোয়ার অবধি বিরিয়ানির এত রকমফের! এত বৈচিত্র্য!
শুধু মুঘল রাজপরিবারই নয়, লখনউ-এর নিজাম প্যালাসেও বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা ছিল মারাত্মক। নিজাম পরিবার থেকেই রকমারি বিরিয়ানির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে যত বাহারি রকমেরই হোক না কেন, সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় 'দম পুখত' বিরিয়ানি। এই বিরিয়ানি তৈরির ক্ষেত্রে সাধারণত সমস্ত উপাদান একসঙ্গে দিয়ে দমে বসানো হয়। অল্প আঁচে, ঢাকা দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হয় এই বিরিয়ানি।