
বিরিয়ানি পছন্দ করেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার! চোখের সামনে মাটন কিংবা চিকেন বিরিয়ানি দেখেও জিভে জল আসে না, এমন মানুষ বড্ড বিরল। এই ছবিটা যে শুধু বাংলার, তা কিন্তু নয়। গোটা ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে বিরিয়ানির প্রতি ভালোবাসা ঠিক এমনই। বিরিয়ানির সুগন্ধি আবেদন মলিন হয়নি এতটুকুও। বিখ্যাত রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায় বলতে হয়, 'একি ভানুমতি! একি ইন্দ্রজাল।' হাজারো ভাষা, বর্ণ, গোত্র, জাতি ও ধর্মে বিভক্ত ভূ-ভারতবাসীকে এক টেবিলে বসাতে পারে বোধহয় দু'টি জিনিস। তার মধ্যে একটি হল ক্রিকেট আর অন্যটি বিরিয়ানি।
এই ঐন্দ্রজালিক বিরিয়ানি প্রথম কীভাবে তৈরি হয়েছিল, জানলে তাজ্জব বনে যাবেন বইকি। প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, 'বিরিয়ানি' শব্দের অর্থ কী? বিরিয়ানি শব্দের উৎপত্তি ফরাসি 'বিরিয়ান' শব্দ থেকে। ফরাসিতে 'বিরিয়ান' শব্দের অর্থ 'রান্নার আগে চাল ভেজে নেওয়া'। বাস্তবেও বিরিয়ানি রান্নার আগে সুগন্ধি চাল ঘি দিয়ে ভেজে নেওয়া হয়। তাই এই নামকরণ।
বিরিয়ানির উৎপত্তি কবে?
অনেকে বলেন, তৈমুর লঙ্গের হাত ধরে ১৩৯৮ সাল নাগাদ ভারতে এসেছিল বিরিয়ানি। মাটির পাত্রে চাল, মশলা আর মাংস মিশিয়ে এক সঙ্গে রান্না করা হত। তখন প্রধানত সৈন্যদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হত বিরিয়ানির এই আদি ‘ভার্সন’। অন্য একটি মতে লঙ্গের বহু আগে ২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরবের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে বিরিয়ানি আসে ভারতে। তামিল সাহিত্যে ‘ওন সরু’ নামে এক ধরনের খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভাত, ঘি, হলুদ, ধনে, মরিচ, তেজপাতা, মাংস দিয়ে তৈরি হত এই খাবার। যার সঙ্গে আধুনিক বিরিয়ানির অনেকটাই মিল পাওয়া যায়।
তবে বিরিয়ানি জনপ্রিয়তা পায় মুঘল সম্রাটদের হাত ধরে। মুমতাজ মহলের রোজকার খাদ্য তালিকায় বিরিয়ানির উল্লেখ পাওয়া যায়। বিরিয়ানি খেতে খুবই ভালোবাসতেন শাহজাহানের এই সুন্দরী বেগম। কথিত, একবার নাকি মুঘল সেনাছাউনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন মুমতাজ। সেখানেই বিরিয়ানি রান্না হতে দেখেন তিনি। রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, সৈন্যদের ‘ব্যালান্স ডায়েট’ দেওয়ার জন্য ভাত ও মাংস মাখানো এই খাবার দেওয়া হয়। নতুন এই খাবারটি চেখে দেখে এর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন মুমতাজ। সেই সূত্রপাত। পরে ভোজনরসিক মুঘলদের খাবার টেবিলে জয়গা পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি সুস্বাদু বিরিয়ানিকে। মুঘলরাই ভারতে যেখানে যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিরিয়ানির স্বাদ। সেটা আবার স্থানীয়দের হাতে পেয়েছে একেকটি নতুন মাত্রা। আর তাই তো পূর্বে ঢাকা থেকে পশ্চিমে পেশোয়ার অবধি বিরিয়ানির এত রকমফের! এত বৈচিত্র্য!
শুধু মুঘল রাজপরিবারই নয়, লখনউ-এর নিজাম প্যালাসেও বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা ছিল মারাত্মক। নিজাম পরিবার থেকেই রকমারি বিরিয়ানির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে যত বাহারি রকমেরই হোক না কেন, সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় 'দম পুখত' বিরিয়ানি। এই বিরিয়ানি তৈরির ক্ষেত্রে সাধারণত সমস্ত উপাদান একসঙ্গে দিয়ে দমে বসানো হয়। অল্প আঁচে, ঢাকা দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হয় এই বিরিয়ানি।